কলকাতা, 14 ফেব্রুয়ারি: মেয়র ফিরহাদ হাকিম যখন পরিবহণ মন্ত্রী থাকাকালীন গ্লাসগোয় একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ৷ সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, 2030 সালের মধ্যে বাংলার সমস্ত গাড়িকে কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস বা সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত করার লক্ষ্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৷
তবে রাজ্যে সঠিক পরিকাঠামো ছাড়া সিএনজি গাড়ি কেনার উপর জোর দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, সেই নিয়ে বরাবরই আশঙ্কা ছিল বিশেষজ্ঞদের ৷ আর সেই আশঙ্কাই সঠিক প্রমাণিত হল ৷ সম্প্রতি রাজ্যে দেখা দিয়েছে সিএনজির ব্যাপক আকাল ৷ দেশজুড়ে বাড়ছে দূষণের মাত্রা ৷ যদিও বায়ুতে দূষণের মাত্রা ক্রমবর্ধমান হওয়ার বহু কারণ রয়েছে ৷ তবে, সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ওই একাধিক কারণগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হল যানবাহন থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ৷ বিষয়টি আর এখন নতুন নয়। তাই একদিকে দেশজুড়ে যেমন 'গো গ্রিন' ক্যাম্পেনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তেমনই সিএনজি এবং ব্যাটারি চালিত গাড়ি ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও মানুষকে উৎসাহী করা হচ্ছে ৷
রাজ্যেও সিএনজি চালিত গাড়ি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মানুষজনকে উৎসাহী করে তোলে হয়েছে ৷ অনেকেই এই গাড়ি কিনতে উৎসাহী হয়েছেনও ৷ এই জন্য গত অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাজেটে বিশেষ ছাড় দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছিল ৷ তবে, এই রাজ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির থেকে অ্যাপ ক্যাব ও অটো সিএনজির উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল ৷ কারণ, একদিকে যেমন সিএনজির দাম পেট্রোল ও ডিজেলের তুলনায় অনেকটাই কম ৷ অন্যদিকে পেট্রোল বা ডিজেলের থেকে সিএনজি গাড়ি মাইলেজ দেয় অনেক বেশি ৷
তবে, এবার রাজ্যে সিএনজির আকাল পড়ায় কপালে হাত পড়েছে অ্যাপ ট্যাক্সি এবং অটো চালকদের ৷ শহরের যে 11টি সিএনজি স্টেশন রয়েছে, সবক’টিতে গ্যাসের আকাল ৷ গ্যাস ভরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে চালকদের ৷ এর ফলে তাঁরা ভাড়ার জন্য রাস্তায় গাড়ি নামতে পারছেন না ৷ এমনকী স্টেশনগুলিতে দীর্ঘক্ষণ লাইন দেওয়ার পরেও অনেক সময় দিনের শেষে গ্যাস না-নিয়েই ফিরতে হচ্ছে ৷ তাই এর প্রতিবাদে গত সোমবার অ্যাপ ক্যাব চালকরা রুবি মোড়ে অবরোধ বিক্ষোভ দেখায় ৷
কসবা সিএনজি স্টেশনের এক আধিকারিক জানান, "কসবা সিএনজি স্টেশনে প্রতিদিন চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কেজি সিএনজি গ্যাস আসে ৷ এই গ্যাস দুর্গাপুরের পানাগড় থেকে আসে ৷ আর প্রতিদিন সাতশো থেকে সাড়ে সাতশো গাড়ি এখান থেকে গ্যাস ভরায় ৷ তাই দিনের শেষে গ্যাস শেষ হয়ে যায় ৷"
কেন এই সংকট ? এই বিষয় বেঙ্গল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের বিজিসিএলের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ইটিভি-কে জানিয়েছেন, যতদিন না পর্যন্ত পরিকাঠামো সঠিকভাবে গড়ে তোলা হবে, ততদিন এই সমস্যা থেকেই যাবে ৷ তিনি জানিয়েছেন, সিএনজি পাইপলাইনের মাধ্যমে হুক আপ পয়েন্ট পর্যন্ত নিয়ে আসার কথা রয়েছে ৷ সেটির কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে ৷ বর্তমানে পানাগর পর্যন্ত গ্যাস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডে (গেইল) পাইপলাইন এসে গেছে ৷ কিন্তু, তারপর প্রায় 700 থেকে 800 মিটার জমি জটের জেরে কাজ আটকে রয়েছে ৷
বিষয়টি নিয়ে পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী তোপ দাগলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে ৷ তিনি বলেন, "কেন্দ্রের তো 47 সালের পর 'আচ্ছেদিন' আসবে ৷ তাই গেইল পানাগড় পর্যন্ত পাইপলাইন নিয়ে এসেছে ঠিকই ৷ কিন্তু, কলকাতায় সেই লাইন বোধহয় 100 বছর পর প্রবেশ করাবে ৷ এখন আচ্ছেদিনের ডেডলাইন ঠিক করছে কেন্দ্র ৷ এরাও তাই সেইভাবেই কাজ করেছে ৷ দ্রুত যদি এই পাইপলাইন কলকাতায় না প্রবেশ করে, তাহলে কেস কেটের মাধ্যমে পানাগড় থেকে গ্যাস নিয়ে এসে পাম্পে-পাম্পে পৌঁছে দিয়ে তার 24 ঘণ্টা সরবরাহ বজায় রাখাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে ৷" তবে, বিজিসিএল জানিয়েছে যে 11 ফেব্রুয়ারির পর থেকে কসবার পাম্পটি 24 ঘণ্টা খোলা থাকার কথা ৷
মন্ত্রী জানান, "আমি মন্ত্রকের ভার নেওয়ার পর গেইলের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি ৷ তাঁদের এই কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার কথাও জানিয়েছি ৷ তবে, তাদের কাজে কোনও রকম অগ্রগতি কিছুই চোখে পড়ছে না ৷"
ওয়েস্ট বেঙ্গল অনলাইন ক্যাব অপারেটরস গিল্ডের পক্ষ থেকে কসবা পরিবহণ দফতরে একটি গণপিটিশন জমা দেওয়া হয়েছে ৷ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রনীল বন্দোপাধ্যায় জানান, মাত্র 800 মিটারের মতো অংশের কাজ এখনও বাকি রয়েছে ৷ বাকি সবটাই যখন হয়ে এসেছে ৷ তখন শুধুমাত্র এইটুকুর জন্য কাজ আটকে রয়েছে জমি জটের জন্য ৷ আসলে রাজ্য সরকারেরও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলেই মনে করছেন তিনি ৷ এখানে রাজ্য বা কেন্দ্র বলে নয় ৷ যেহেতু সমস্যাটি রাজ্যের, তাই একইভাবে রাজ্য পরিবহণ দফতরকেও প্রাধান্য দিয়ে বিষয়টির সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন তিনি ৷
এছাড়াও তিনি জানান, বিজিসিএলের ক্যাস কেটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বিজিসিএলের 16টি ক্যাস কেটে করে পানাগড় থেকে গ্যাস আনা হয় ৷ তিনি দাবি করেন, একটি নয় অন্তত চারটি সিএনজি স্টেশন যেন 24 ঘণ্টা সক্রিয় থাকে ৷ স্টেশনগুলি খোলা রাখলেই চলবে না, সেখামে যেন গ্যাস থাকে সেটাও দেখতে হবে ৷
প্রসঙ্গত শহর ও শহরতলি মিলিয়ে 11টি সিএনজি স্টেশন রয়েছে ৷ জায়গাগুলি হল, কসবায় 1টি, দু’টি নিউ টাউনে, একটি গড়িয়ায়, চিনার পার্ক, সোদপুর, বেহালা, ঠাকুরপুকুর, তারাতলা, কল্যাণী, মহাবীরতলা ও বেলগাছিয়ায় ৷ এর মধ্যে নিউটানের পাম্পে বেশ কিছু বেসরকারি বাসের গ্যাস ভরানো হয় ৷ পাশাপাশি, বেশিরভাগ সরকারি বাসে গ্যাস ভরানো হয় সেখানে ৷ বিজিসিল ছাড়া হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড ও ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন এই সিএনজি পরিষেবা দিচ্ছে ৷
ভারত সরকারের পেটেন্ট প্রাপ্ত পরিবেশ প্রযুক্তিবিদ সমেন্দ্র মোহন ঘোষ বলেন, "এটা আজ থেকে তিন বছর আগে যখন এই প্রযুক্তি প্রথম আসে, তখনই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন ক্যাসকেটে করে গ্যাস নিয়ে এসে বেশিদিন চালানো যাবে না ৷ এর জন্য একটা মাদার স্টেশনের প্রয়োজন ৷ সেই মাদার স্টেশনে গ্যাস আসবে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ৷ তাই পাইপলাইন তৈরি করতে পারাটাই একমাত্র স্থায়ী সুরাহা ৷"
আরও পড়ুন:
- সিএনজি বাস পরিষেবায় ক্ষতির মুখে মালিকরা, সরকারি সদিচ্ছায় জোর বিশেষজ্ঞদের
- রিলায়েন্সের জন্য 18 শতাংশ কম প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম, অপরিবর্তিত সিএনজি-পিএনজি
- দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজ্যে নামছে প্রায় দুই হাজারের বেশি পরিবেশবান্ধব বাস