বনগাঁ, 18 মে: "আমরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চাই", বলছিলেন মতুয়া পরিবারের ছেলে পবিত্র গোঁসাই ৷ দেশভাগ এবং তার পর 1971 সালে বাংলাদেশ থেকে একপ্রকার প্রাণ হাতে করে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন ৷ তার মধ্যে ছিলেন বিশাল সংখ্যায় নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়, যাঁদের অন্যতম মতুয়ারা ৷ তখন কে কোথায় কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাবেন, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন ৷
কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে এলে কাগজ সঙ্গে রাখতে হবে, তা মাথায় ছিল না অনেকেরই ৷ পবিত্র বলেন, "আমরা বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কোনও কাগজ নিয়ে আসতে পারিনি ৷ একাত্তরের গণ্ডগোলে জীবন বাঁচিয়ে আসাটাই বড় দায় ছিল ৷" একই কথা বলছেন আরেক মতুয়া হরিচাঁদ গোঁসাই ৷ তাঁর কথায়, "রাতের অন্ধকারে মা-বোনদের ইজ্জত এবং ধর্মকে রক্ষা করার জন্য সীমান্ত দিয়ে কে কোথায় কীভাবে পালিয়ে এসেছেন, তার কোনও দিশা ছিল না ৷ চাকরি করতে গেলে ছেলেমেয়েদের কাছে একাত্তর সালের আগের দলিল চায় ৷ কিন্তু আমরা তো তার আগে আসিনি !"
উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে একটি সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেন হরিচাঁদ ঠাকুর ৷ সমাজের নিচু-অস্পৃশ্য মতুয়াদের বাঁচার রাস্তা দেখান প্রথম সঙ্ঘাধিপতি ৷ এরপর সেই ধর্মান্দোলন চালিয়ে যান তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ৷ 1947 সালে পূর্ববঙ্গে মতুয়াদের পরিস্থিতি বদলায় ৷ দেশভাগের ফলে খুলনা, যশোর এবং ফরিদপুর পাকিস্তানে চলে যায় ৷ এই অঞ্চলগুলিতে বাস করত নমঃশূদ্র মতুয়ারা ৷ সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসেন ৷
ভারত সীমান্তের কাছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা এবং মুর্শিদাবাদে বসতি গড়তে থাকেন হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের শিষ্যরা ৷ শুরু হয় নতুন দেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম ৷ সেই সময় বা বলা ভালো দেশভাগের আগে থাকতে তাঁদের বাঁচার পথ দেখিয়েছিলেন আরেক সঙ্ঘাধিপতি, হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রপৌত্র, গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ৷ যিনি পিআর ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত ৷
1947 সালের ডিসেম্বরে উত্তর 24 পরগনার বনগাঁয়, অধুনা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে, এক খণ্ড জমি কেনেন পিআর ঠাকুর ৷ সেখানে চালা বানিয়ে মতুয়াদের জন্য হরিজন কলোনির সূচনা করেন ৷ পরে তাঁর জীবদ্দশাতেই সেখানে তৈরি হয় মতুয়াদের মন্দির, আজকের ঠাকুরনগর ৷ হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের ঘিরে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাকে রাজনৈতিক রূপ দিলেন প্রমথরঞ্জন ৷ ধীরে ধীরে এই ঠাকুরনগর তথা উত্তর 24 পরগনা, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, রাণাঘাটের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকে নিজেদের বাসযোগ্য করে তোলেন মতুয়ারা ৷ তবে যে রাতে ছিন্নমূল মতুয়ারা ভারতে পা রেখেছিলেন সেই রাত থেকেই তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল ৷ সেই কিস্সা আজও চলছে ৷
ভারতে এসে পিআর ঠাকুর কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমে হরিণঘাটা ও পরে হাঁসখালি বিধানসভা থেকে জয়ী হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন ৷ এরপর নাগরিকত্ব ইস্যুতে রাজনীতির নানা রং ঢুকেছে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে ৷ বাংলার ভোটব্যাঙ্কে দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন মতুয়ারা ৷ সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপি- সব দলই নাগরিকত্ব ইস্যুতে ভোট আদায়ে মাঠে নেমেছে ৷
আগামী সোমবার, 20 মে বনগাঁয় আবার একটা ভোট ৷ নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে বনগাঁর বুথে বুথে কণ্ঠি গলায় মতুয়ারা ভোট দেবেন ৷ এখন রাজনীতির বদান্যতায় মতুয়া মহাসঙ্ঘ দ্বিধাবিভক্ত ৷ 2009 সালে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে জন্ম নেওয়া বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হন তৃণমূলের গোবিন্দ চন্দ্র নস্কর ৷ পরের নির্বাচনে 2014 সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন প্রমথরঞ্জন ও বীণাপানি দেবীর বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ৷ 2015 সালের কপিলকৃষ্ণের আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ৷
2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁয় বিজেপির ঝুলিতে ছিল 4 শতাংশেরও কম ভোট ৷ তবে এরপরে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতে ধারাবাহিকভাবে বিজেপি তাদের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ক্রমশ বাড়িয়েছে ৷ 2014 সালে তারা পেয়েছিল 19 শতাংশের সামান্য বেশি ভোট ৷ এরপর 2015 সালের উপ-নির্বাচনে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় 24.17 শতাংশ ৷ আর 2019-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি যে শুধু তাদের ভোটের ঝুলি প্রায় 48.85 শতাংশে ভরিয়েছিল তাই নয়, তারা তৃণমূলকে পরাস্ত করে আসনটি জিতেও নেয় ৷ বনগাঁ কেন্দ্রে গেরুয়া পতাকা ওড়ানো ঠাকুরবাড়ির সন্তান শান্তনু ঠাকুর জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন ৷