গঙ্গাসাগর, 15 জানুয়ারি: কেউ দু'দিন ধরে রয়েছেন রিলিফ ক্যাম্পে ৷ আবার কেউ চারদিন ধরে ৷ কারও বয়স 60, তো কেউ আবার 75 উর্ধ্ব ৷ গঙ্গাসাগরে এসে হারিয়ে গিয়েছেন, আবার কারও ছেলে মেয়ে রেখে চলে গিয়েছে ৷ এরকম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শিশুদের মাসিহা এখন বজরং পরিষদ ৷ এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে বাড়ি ফিরছেন পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষজন ৷
বজরং পরিষদের দাবি, গঙ্গাসাগর মেলা শুরু থেকে বুধবার পর্যন্ত 1313 জন তীর্থযাত্রী বা পুণ্যার্থী পরিবার পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন । তাঁদের পরিবারের কাছে ফেরানোর জন্য প্রয়োজনীয় খোঁজ খবর করছে এই সংস্থা ৷ শুধুমাত্র অনুসন্ধান নয়, স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এইসব মানুষজনের থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করছে বজরং পরিষদ । 108 বছর ধরে গঙ্গাসাগর মেলায় এমনই কর্মযজ্ঞ করে আসছে তারা ।
তীর্থযাত্রীদের বাড়ি ফেরাচ্ছে বজরং পরিষদ (ইটিভি ভারত) মকর সংক্রান্তির পুণ্য লাভের আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা ভাষার মানুষ পুণ্য অর্জনের জন্য ছুটে আসেন দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার গঙ্গাসাগরে । রাজ্যের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের বাসিন্দারা আসেন এখানে । অবস্থানগত বিভেদ ভুলে তাঁরা মিলিত হন এই এক বিন্দুতে এসে । কিন্তু বিপত্তি ঘটে বাড়ি ফেরার পথে ৷
কেউ সাগরে ডুব দিয়ে উঠে দেখেছেন সঙ্গীরা উধাও । আবার কেউ স্নান সেরে কপিলমুনির মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার পথে দলছুট হয়ে গিয়েছেন । কেউবা পরিবারের সঙ্গে এসেছেন, ছেলে কিংবা স্বামী তাঁদেরকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলে উধাও হয়ে গিয়েছে । সেরকম পুণ্যার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে বজরং পরিষদ ৷ এমনকি তারা তাঁদের বাড়ি ফেরারও ব্যবস্থা করছে ৷
এ বিষয়ে বজরং পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিলিফ সেক্রেটারি প্রেম নাথ দুবে বলেন, "গঙ্গাসাগর মেলাতে এসে স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষজন ৷ পুলিশ-প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা তাঁদেরকে নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসে । আমরা প্রাথমিকভাবে মাইকিংয়ের মাধ্যমে মেলা চত্বরে স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের পরিবারের লোকজনের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিই । গোটা মেলা চত্বরে মাইকিং করি আমরা । বহু মানুষ আছে যারা চার দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে ৷ পরিবারের লোক তাদেরকে নিতে আসেনি । অনেকে আছে অসুস্থ ৷"
আশ্রয় শিবিরে গঙ্গাসাগরে এসে হারিয়ে যাওয়া তীর্থযাত্রীরা (নিজস্ব ছবি) তাঁর কথায়, "মেলা শেষে সকলকে কলকাতায় নিয়ে চলে যাওয়া হবে ৷ অসুস্থদের চিকিৎসা করার পর তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের ৷ এর পাশাপাশি যারা চারদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন, বাড়ি যেতে পারছেন না, কিংবা পরিবারের লোক তাঁদেরকে নিতে আসছেন না, তাঁদেরকেও আমরা বাড়ি পৌঁছে দেব । পরিবারেরও কিছু মানুষদের গঙ্গাসাগর থেকে নিয়ে যাওয়ার অনীহা রয়েছে ৷ আমরা কিন্তু পৌঁছে দেব তাঁদেরকে । হারউড পয়েন্ট, কচুবেড়িয়া ও নামখানা পয়েন্টে বজরং পরিষদের আশ্রয়শিবির রয়েছে ৷ সেখানে হারিয়ে যাওয়া পুণ্যার্থী রয়েছেন ৷ তাঁদের ধরলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে । থাকা ও খাবার দেওয়ার পাশাপাশি পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে জামাকাপড় এবং শীতের পোশাক । কয়েকজনের চিকিৎসাও করানো হচ্ছে ।"
করুণ চোখে পরিবারের সদস্যদের ফিরে আসার অপেক্ষা করছে ভিন্ন রাজ্য থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা । অনেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন ৷ সেরকম চোখে জল নিয়ে নালন্দা জেলা থেকে আসা সীমা কুমলায়া বলেন, "চার দিন আগে স্বামী, পরিবার এবং গ্রামের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে গঙ্গাসাগরে এসেছি ৷ কিন্তু হঠাৎই কপিলমুনি মন্দির দর্শন করতে গিয়ে আমি আর মেয়ে দল ছুট হয়ে গিয়েছি ৷ এরপর বজরং পরিষদের এখানে এসে অপেক্ষা করছি চারদিন ধরে পরিবারের লোকজনদের । কিন্তু কেউ নিতে আসেনি । কীভাবে বাড়ি ফিরব, সেই বিষয় নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছি ।"
এই বিষয় রাজেশ মণ্ডল নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, "গঙ্গাসাগরে এসে অনেক মানুষকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তাদের পরিবারের লোকজন । পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা আমাদের এই ক্যাম্পে আসে এবং আমরা তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা করাই । অনেকে রয়েছে যারা তাদের নিজেদের প্রিয়জনকে গঙ্গাসাগরে ছেড়ে দেয় ৷ আবার অনেকে রয়েছে তাদের প্রিয়জন কোনও না কোনও কারণে তাঁদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে । আমরা গোটা মেলা জুড়ে মাইকিং করি ৷ অনেকে তাঁদের প্রিয়জনকে এসে নিয়ে যান ৷ আবার অনেকে নিতে আসেন না । অনেকে ইচ্ছা করে গঙ্গাসাগরে ছেড়ে দিয়ে চলে যান তাঁদের প্রিয়জনকে ।"
আরেক পুণ্যার্থী বিহারের পটনা জেলার বাসিন্দা 75 বছরের মুনারক সাউ বলেন, "তিনদিন আগে এক সঙ্গীর সঙ্গে ট্রেনে, বাসে চেপে গঙ্গাসাগরে এসেছিলাম । সমুদ্রে স্নান সেরে উঠে এসে তাকে আর দেখতে পাইনি । সেই সঙ্গীর নাম ধরে মাইকে ঘোষণাও করা হয়েছে । কিন্তু সে আমাকে নিতে ফিরে আসেনি ।"