পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

অবশেষে সুপ্রিম নির্দেশে মিলল জামিন, মুক্তির পথে 104 বছর বয়সি খুনের আসামি - CENTENARIAN GETS BAIL FROM SC

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অবশেষে জামিন পেয়ে মুক্তি পেতে চলেছেন 104 বছর বয়সি খুনের আসামি রসিকচন্দ্র মণ্ডল ৷ তাঁর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় গোটা পরিবার ৷

ETV BHARAT
জামিন পেয়ে মুক্তির পথে 104 বছর বয়সি খুনের আসামি (নিজস্ব চিত্র)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 1, 2024, 5:45 PM IST

মালদা, 1 ডিসেম্বর: ভাইয়ে ভাইয়ে জমি বিবাদ হয়েছিল ৷ তার জেরে গুলি করে ছোট ভাইকে খুনের অভিযোগ উঠেছিল দাদার বিরুদ্ধে ৷ যদিও দাদার পরিবারের দাবি, পারিবারিক ঝামেলার সুযোগ নিয়ে অন্য এক ব্যক্তি ছোট ভাইকে গুলি করে মারে ৷ কিন্তু সেই অভিযোগের দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করে দাদাকে ৷ জেল হয় তাঁর ৷ এরপর কেটে গিয়েছে 36টা বছর ৷

মধ্যে কয়েক বছর প্যারোলে ছাড়া পেলেও মেয়াদ শেষে পুলিশ ফের ধরে নিয়ে যায় তাঁকে ৷ আর ছাড়া পাননি ৷ কলকাতা হাইকোর্টে জামিনের আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি ৷ অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অন্তর্বর্তী জামিন পেলেন 104 বছর বয়সি রসিকচন্দ্র মণ্ডল ৷ এখন তাঁর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় স্ত্রী-সহ গোটা পরিবার ৷

মুক্তির পথে 104 বছর বয়সি খুনের আসামি (নিজস্ব ভিডিয়ো)

1920 সালে মানিকচক ব্লকের দক্ষিণ চণ্ডীপুর পঞ্চায়েতের পশ্চিম নারায়ণপুর গ্রামে জন্ম রসিকচন্দ্রের ৷ সেই গ্রামেই বেড়ে ওঠা ৷ বেশ কয়েক বিঘা জমির মালিক ছিলেন তিনি ৷ গঙ্গার পলি মেশা উর্বর ওই জমি ছিল বহুফসলি ৷ পৈতৃক সেই জমি নিয়েই তাঁর সঙ্গে বিবাদ বাধে ছোট ভাই সুরেশ মণ্ডলের ৷ দুই ভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি ৷ 1988 সালে একদিন নিজের বাড়িতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সুরেশ ৷ সেই ঘটনার তাঁর স্ত্রী আরতি মণ্ডল ভাসুর-সহ মোট 18 জনের বিরুদ্ধে মানিকচক থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ৷

স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় স্ত্রী (নিজস্ব চিত্র)

পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে ৷ সবার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির 302 ও 34 ধারায় মামলা রুজু হয় ৷ শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া ৷ 1994 সালে রসিকচন্দ্র মণ্ডল ও জিতেন তাঁতি নামে দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয় ৷ তখন রসিক মণ্ডলের বয়স ছিল 68 বছর ৷ তারপর থেকে জেলেই ছিলেন দু’জন ৷

বছর তিনেক আগে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে নদীতে ডুবে মারা যান জিতেন তাঁতি ৷ প্যারোলে ছাড়া পেয়ে বেশ কয়েক বছর বাড়িতে ছিলেন রসিক মণ্ডল ৷ তেমনটাই জানাচ্ছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা ৷ কিন্তু প্যারোলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুলিশ তাঁকে ফের সংশোধনাগারে নিয়ে যায় ৷ এই দীর্ঘ সময়কালে তাঁকে মূলত মালদা জেলা সংশোধনাগারেই রাখা হয়েছিল ৷ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারেও কিছুদিনের জন্য তাঁকে রাখা হয় ৷

সুপ্রিম কোর্টে মিলেছে জামিন (নিজস্ব চিত্র)

2018 সালে রসিকচন্দ্র নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানান ৷ কিন্তু তাঁর আবেদন হাইকোর্ট খারিজ করে দেয় ৷ পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টেও তিনি সেই আবেদন জানান ৷ কিন্তু সেখানেও তাঁর আবেদন গ্রাহ্য হয়নি ৷ 2020 সালে 99 বছর বয়সি ওই বৃদ্ধ তাঁর বয়স এবং বয়সজনিত অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে শীর্ষ আদালতে মুক্তির আবেদন জানান ৷ সেই আবেদনের ভিত্তিতে 2021 সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার স্ট্যাটাস রিপোর্ট চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে একটি নোটিশ জারি করে ৷

দক্ষিণ চণ্ডীপুর পঞ্চায়েতের পশ্চিম নারায়ণপুর গ্রামে রসিকচন্দ্রের বাড়ি (নিজস্ব চিত্র)

অবশেষে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চে রসিকচন্দ্রের আবেদনের শুনানি হয় ৷ রসিকচন্দ্র মণ্ডল ও রাজ্য সরকারের কৌঁসুলিদের সওয়াল জবাবের পর ডিভিশন বেঞ্চ 104 বছর বয়সি বৃদ্ধকে অন্তবর্তী জামিন/প্যারোলে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে ৷

সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর বর্তমানে ভূতনি থানার রসিকচন্দ্র পশ্চিম নারায়ণপুর কলোনির বাড়িতে খানিকটা স্বস্তির হাওয়া ৷ ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাঁর বড় ছেলের ৷ বাকি তিন ছেলের দু’জন কর্মসূত্রে দিল্লিতে রয়েছেন ৷ বাড়িতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও ছোট ছেলে ৷ রবিবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই নাতি অপূর্ব ও প্রবীর ঠাকুরদাকে জেল থেকে ঘরে ফিরিয়ে আনার তোরজোরে ব্যস্ত ৷ তাঁরা কেউ ক্যামেরার মুখোমুখি হতে চাননি ৷ শুধু তাঁরা দু’জনই নন, পরিবারের মহিলারাও সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখে কুলুপ এঁটেছেন ৷ পুরোনো ঘটনা তাঁরা কেউ নতুন করে সামনে আনতে চান না ৷

তবে ছোট ছেলে উত্তম মণ্ডল বলেন, "1988 সালে একটি খুনের মামলায় বাবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ৷ এখন তাঁর বয়স 103 বছর ৷ আর কয়েকদিন বাদেই 104 বছরে পা দেবেন ৷ বাবার জামিনের জন্য আমরা অনেকদিন আগে কলকাতা হাইকোর্টে জামিনের আবেদন জানাই ৷ জামিন পেয়ে 12 বছর বাড়িতে ছিলেন ৷ ফের তাঁকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ পরবর্তীতে আমরা আবার হাইকোর্টে তাঁর মুক্তির আবেদন জানাই ৷ কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় ৷ সুপ্রিম কোর্টও সেই আবেদন খারিজ করে দেয় ৷ আইন যাই বলুক, আমার বাবার বয়সি কাউকে কোনও অপরাধে জেলে ভরে রাখা আমি অন্যায় মনে করি ৷ বাবা এখন অসুস্থ ৷ ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না ৷ আগামিকাল হয়তো বাবা ছাড়া পাবেন ৷ তিনি ছাড়া পেলে আমরা খুব আনন্দ পাব ৷"

রসিকচন্দ্রের স্ত্রী মীনা মণ্ডলের বয়সও 85 বছর পেরিয়েছে ৷ কানে ঠিকমতো শুনতে পান না ৷ কোনওরকমে জানালেন, "আগামিকাল স্বামী জেল থেকে ছাড়া পাবে শুনেছি ৷ খুব ভালো লাগছে ৷ ছেলের সংসারে আছি ৷ ওর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছি ৷ চার ছেলের মধ্যে বড়টা অনেকদিন আগেই মরে গিয়েছে ৷"

যাঁর মৃত্যু নিয়ে এত কাণ্ড, সেই সুরেশ মণ্ডলের পরিবার এখন আর গ্রামে থাকে না ৷ সুরেশের স্ত্রী আরতি মণ্ডল ছেলেমেয়েকে নিয়ে বছর ত্রিশেক আগেই বিহারে চলে গিয়েছেন ৷ তাঁরা সেখানেই থাকেন ৷ গ্রামে আর পা দেননি ৷ তবে এলাকার মানুষজন জানাচ্ছেন, রসিকচন্দ্র তাঁর ভাইকে খুন করেননি ৷ খুন করেছিলেন জিতেন মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি ৷ তাঁর সঙ্গে রসিকচন্দ্রের ব্যক্তিগত ঝামেলা ছিল ৷ দুই ভাইয়ের জমি বিবাদের সুযোগ নিয়ে জিতেনই গুলি করে সুরেশকে খুন করে বলে অভিযোগ ৷ কিন্তু ঘটনার যাবতীয় প্রমাণ রসিকচন্দ্রের বিরুদ্ধে যায় ৷

রবিবার মানিকচক থানায় এই মামলার কেস ডায়ারি পাওয়া যায়নি ৷ এতদিনের পুরোনো মামলার নথি কোথায়, কেউ জানে না ৷ মালদা জেলা সংশোধনাগারের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, "সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কপি এসেছে ৷ রসিকচন্দ্র মণ্ডলকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে ৷ কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেলে সোমবারই তাঁকে সংশোধনাগার থেকে ছাড়া হতে পারে ৷"

ABOUT THE AUTHOR

...view details