কলকাতা, 3 ডিসেম্বর: প্র্যাকটিস শেষে মাঠের ভেতর ফুটবলারদের সঙ্গে জটলায় কোচ অস্কার ব্রুঁজো । মনে হচ্ছিল পরের ম্যাচের নীল নকশার হদিশ তিনি ফুটবলারদের দিচ্ছেন । বাতিস্তম্ভের আলোর অনেকগুলোই নিভে গিয়েছে । কুয়াশা জড়ানো হেমন্তর সন্ধ্যায় ফুটবলারদের নিয়ে জড়ো হয়ে অস্কার ব্রুঁজোর কথা বলার মধ্যে অনেকেই নতুনত্ব পাননি । ভুল ভাঙল একটু পরে । হুইল চেয়ারে বসে থাকা একজনকে ঘিরে রয়েছেন লাল-হলুদের তারকারা ।
ফটো তোলা হচ্ছে । ভিডিয়ো করা হচ্ছে । ফুটবলাররা যে যার মত ছবি তুলছেন হুইল চেয়ারে বসা লোকটির সঙ্গে । যাকে নিয়ে এত ফটো তোলার ধুম সেই মানুষটি নির্বিকার মুখে উপহার পাওয়া লাল-হলুদ জার্সিটা বারবার মাথায় ছোঁয়াচ্ছিলেন । চুমু খাচ্ছিলেন । পাশে দাঁড়ানো ইস্টবেঙ্গল কোচ অস্কার ব্রুঁজো এবং ফুটবলারদের হাত ধরে বলছিলেন, ‘‘আমরা ঘুরে দাঁড়াব তো ? ভালো খেলব তো ?’’ হাততালি দিয়ে ছেলেটিকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকোস, ক্লেইটন সিলভারা ।
প্রতিবন্ধকতা নিয়েই মাঠে (ইটিভি ভারত)
গণেশ দাস । বাঘাযতীন নিবাসী বছর 46-এর গণেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী । জন্মের পরে থেকেই তাঁর দু’টো পা অচল । ‘‘জন্মের পরেই ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা এবং ভুল ইঞ্জেকশনে পা হারাতে হয়েছে ,’’ বলছিলেন গনেশ । জড়ানো কথা । উচ্চারণের জড়তা নিয়েই গণেশ বলে ওঠেন, ‘‘জয় ইস্টবেঙ্গল !’’
আজ মঙ্গলবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস । তার আগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ফুটবলারদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন গণেশ । ইস্টবেঙ্গল মাঠে আসা নতুন নয় । সেই 1997 সাল থেকে ময়দানে প্রিয় ক্লাবের খেলা দেখতে আসেন । হুইল চেয়ারে চেপে ঠিক হাজির হয়ে যান গলা ফাটাতে । জিতলে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফেরেন । হারলে চোখের জল মোছেন ।
তাঁর হাতে একটি হেলমেট তুলে দেওয়া হয় ক্লাবের তরফ থেকে (ইটিভি ভারত)
ক্লাবের প্রতি আবেগ ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতেই গণেশকে ইস্টবেঙ্গলের পক্ষ থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি স্কুটার কিনে দেওয়া হয়েছে গতবছর । তারপর থেকে সেই স্কুটার চালিয়ে মাঠে আসেন । ময়দান আসলেও এই স্কুটার নিয়ে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ঢুকতে পারেন না । ‘‘সল্টলেক স্টেডিয়ামে এই স্কুটার নিয়ে আমাকে ঢুকতে দেয় না । কতবার বলেছি । কত অনুরোধ করেছি,” দুঃখ করে বলছিলেন গনেশ । তাঁর হাতে একটি হেলমেট তুলে দেওয়া হয় ক্লাবের তরফ থেকে ।
প্রায় তিরিশ বছর মাঠে বসে খেলা দেখছেন । ইস্টবেঙ্গলের প্রতিটি ম্যাচের গল্প-পরিসংখ্যান মুখস্থ । অনেক ফুটবলারকে দেখলেও গণেশের প্রিয় ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া । দেখাও হয়েছে, কথাও । ‘‘বাইচুং ভাই আমাকে খুব ভালোবাসে । ওর সব খেলা দেখেছি এই মাঠে,” উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গণেশের মুখ ।
কীভাবে হল ইস্টবেঙ্গলের প্রতি ভালোবাসা ? গণেশ জানালেন, ‘‘বাবা ইস্টবেঙ্গলের পাগল ভক্ত । ছোট থেকে বাবাকে দেখেই ক্লাবকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম । মাঠে এসেছি সব বাধা পেরিয়ে । আমি বাইরেও ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গিয়েছি । জীবনের লড়াই লড়ব । কিন্তু ক্লাব খারাপ খেললে যে কষ্ট পাই, তা তো এই যুদ্ধের চেয়েও কঠিন !’’
মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ হেডস্যর । ‘‘ওর প্রাণশক্তি দলের প্রেরণা । কঠিন সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ।’’ অস্কার ব্রুঁজো সমর্থকদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসেন । কথা বলে ইচ্ছে-স্বপ্ন-যন্ত্রণাটা বুঝতে চান । নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে জয় ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ফিরিয়েছে । আমরাও পারি এই বোধটা এখন সবার মধ্যে । তারই মাঝে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে গণেশ দাসের লড়াই, প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে এগিয়ে চলার শপথ কোথায় যেন দিয়ামান্তোকোস, ক্রেসপো, আনোয়ারদের চোয়াল শক্ত করে দেয় ।