পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

পদ্ম ঝড়ে উড়ল ঝাড়ু ! 27 বছর পর 'দিল্লি দখল' বিজেপির - DELHI ELECTIONS 2025

রাজধানীর রাজপথে 'গেরুয়া ঝড়' ৷ 1993 বিধানসভা ভোটের পর ফের 2025 ৷ দিল্লির মসনদ দখল করতে ‘মাত্র’ 27 বছর সময় নিল বিজেপি ৷

Delhi Elections 2025
27 বছর পর দিল্লি দখল বিজেপির (ইটিভি ভারত)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 8, 2025, 5:45 PM IST

Updated : Feb 8, 2025, 6:10 PM IST

নয়াদিল্লি, 8 ফেব্রুয়ারি: আর ঝাড়ু নয়, একবার ফের পদ্মে আস্থা রাখল দিল্লির জনতা ৷ তবে দিল্লির মসনদে নিজেদের পুনপ্রতিষ্ঠা করতে 27 বছর সময় নিল বিজেপি ৷ 2025-এ পদ্ম ঝড়ে উড়ে গেল ঝাড়ু !

বুথফেরত সমীক্ষা বলেছিল, দিল্লিতে সরকার গড়ছে ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ দিল্লি দখল যে সময়ের অপেক্ষা, তা বুঝে গিয়েছিল গেরুয়া শিবিরও ৷ ফলত, সুষমা স্বরাজের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা নিয়ে আলাপচারিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল দলের অন্দরে ৷ উঠে এসেছিল রমেশ বিধূড়ী, পরবেশ সাহিব সিং’দের নাম ৷ হাইকমান্ডের এহেন ভাবনা যে নিছক ‘কনফিডেন্স’ নয়, রীতিমতো জটিল অঙ্কের ফসল, তা বোঝা গিয়েছে শনিবার সকাল থেকেই ৷ এদিন গণনা শুরু হওয়ার পর যত বেলা গড়িয়েছে, দেওয়াল লিখনটা ততই স্পষ্ট হয়েছে ৷

বিজেপির দিল্লি দখলের পর সমর্থকদের উল্লাস (পিটিআই)

অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈন, গেরুয়া ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছেন একের পর এক হেভিওয়েট প্রার্থী ৷ মুখ্যমন্ত্রী অতিশী মার্লেনা’কে বাদ দিলে দিল্লির বেশ কিছু অংশে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে আম আদমি পার্টি (আপ) ৷

  • দিল্লিতে ‘দোস্তি’, দিল্লিতেই ‘কুস্তি’

লোকসভা ভোটে একসঙ্গে লড়াই করা কংগ্রেস-আপ, দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ছিল যুযুধান প্রতিপক্ষ ৷ ভোট প্রচারে একে অপরকে তোপ দেগেছে দু’দলের নেতৃত্ব ৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না-হওয়া, ফি বছর দুষণে ঢেকে যাওয়া যমুনা, দুষণে দিল্লিবাসীদের নাভিশ্বাস ওঠা-সহ বিভিন্ন ইস্যুতে আপ সুপ্রিমোকে কার্যত একহাত নিয়েছিলেন রাহুল গান্ধি ৷ এক্স হ্যান্ডেলে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে রাহুল লেখেন, ‘‘কেজরিওয়াল'জী, 2025 এসে গেল । যমুনায় আর কবে ডুব দেবেন ? দিল্লি অপেক্ষা করছে !’’

ওয়াকিবহাল মহল বলছে, দিল্লি’তে দোস্তি, আবার সেই দিল্লিতেই কুস্তি - এই সমীকরণ (পড়ুন ফর্মুলা) ভালোভাবে নেয়নি জনতা ৷ তার প্রভাব সরাসরি পড়েছে ভোটে ৷ খাতাই খুলতে পারেনি কংগ্রেস, আপ’ও নাস্তানাবুদ ৷ এক্স পোস্টে এই নিয়ে কটাক্ষ করেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ৷ ওমর আবদুল্লা লিখেছেন, ‘‘নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যাও ৷’’

  • রাহুলের নেতৃত্ব ও ইন্ডিয়া’র ভবিষ্যত কি ফের প্রশ্নের মুখে ?

একের পর এক নির্বাচনে হারের মাঝেই 2024-এর ভোটে সংসদে বিরোধীদলের তকমা আদায় করে নিয়েছিল কংগ্রেস ৷ রাহুল গান্ধি’কে নিয়ে ফের আশার বাণীও শুনিয়েছিল কংগ্রেস ৷ ইতিমধ্যে কেরালার ওয়েনাড় থেকে রাহুলের ছেড়ে যাওয়া আসনে লোকসভায় জিতে এসেছেন বোন প্রিয়াঙ্কা । তবে, এতকিছুর পর এদিন ফের প্রশ্নের মুখে রাজীব-তনয়ের নেতৃত্ব ৷ 2008 সালে শেষবার দিল্লি দখল করেছিল কংগ্রেস ৷ ঝুলিতে এসেছিল 43টি সিট, 40.31 শতাংশ ভোট ৷ 2013 বিধানসভা ভোটে তা কমে দাঁড়ায় 8টি সিটে ও 24.55 শতাংশে ৷

2015 বিধানসভা ভোট থেকে শতাব্দীপ্রাচীন এই দল শুধু দিল্লিতে আর কোনও আসন জেতেনি তা নয়, তাদের প্রাপ্তভোটের হারও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমেছে ৷ 2015 বিধানসভা ভোটে 9.7 শতাংশ, 2020 বিধানসভা ভোটে 4.26 শতাংশ থেকে এবার তা আরও কমেছে ৷

  • ‘ভুয়ো’ প্রতিশ্রুতি

দল ভালো ফল করতে পারেনি ৷ হেরে গিয়েছেন স্বয়ং অরবিন্দ কেজরিওয়াল ৷ আপ নেতারা যতই বিজেপি’র ‘গণতন্ত্র হত্যা’র দাবি করুক, হারের জন্য কেজরি নিজেই অনেকটা দায়ী ৷ বিনামূল্যে মহিলাদের জন্য বাস পরিষেবা, মহল্লা ক্লিনিক, বিনামূল্যে স্কুলশিক্ষা, দুর্দান্ত নিকাশি ব্যবস্থা, যমুনা পরিষ্কার-সহ একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ৷ এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি যেমন বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, বাস পরিষেবা, স্কুলশিক্ষা বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ছাড়া, আর কোনওটাই দিনের আলো দেখেনি ৷

আপ শাসনের একযুগ পর দিল্লিবাসীর মোহভঙ্গ হওয়া যেন সময়ের অপেক্ষা ছিল ৷ 2020 সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে যমুনা নদীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। কিন্তু, তা পূরণ হয়নি এবং এবারের নির্বাচনের আগে কেজরি তা মেনে নিয়ে আরও একবার সুযোগ চেয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, 2020 সালের ইস্তেহারের তিনটি গ্যারান্টি তাঁরা পূরণ করতে পারেননি এবং এবারের ইস্তেহারে সেগুলি রাখা হয়েছে। যদিও আর ধৈর্য ধরতে পারেনি দিল্লিবাসী ৷

27 বছর পর 'দিল্লি দখল' বিজেপির (ইটিভি ভারত)
  • আর্থিক ও আবগারি দুর্নীতি

12 বছরের শাসনকালে একাধিক দুর্নীতিতে জড়িয়েছে আপ নেতা’দের নাম ৷ আর্থিক তছরূপ মামলায় জেলে যেতে হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনকে ৷ আবগারি কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে জেলে যেতে হয় মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকে ৷ এর পিছনে বিজেপির ‘প্রতিহিংসামূলক’ রাজনীতির কথা বললেও, জেল যাওয়া এবং দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ যে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে কেজরিওয়ালের ভাবমূর্তিতে, তা ভোটের ফলেই স্পষ্ট ৷

খোঁচা দিতে ছাড়েননি সমাজকর্মী আন্না হাজারে। তিনি বলেন, ‘‘আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় প্রার্থীর চরিত্র এবং ভাবমূর্তির উপর কোনও দাগ না-থাকা উচিত । কিন্তু তারা (আপ) তা বুঝতে পারেনি । মদ এবং টাকার মধ্যে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে ৷ এর কারণে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে ৷ সেই কারণেই নির্বাচনে কম ভোট পাচ্ছে ৷ মানুষ দেখেছে যে কেজরিওয়াল ভালো চরিত্রের কথা বলেন, কিন্তু মদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ৷ রাজনীতিতে অভিযোগ তোলা হয় । প্রমাণ করতে হবে যে তিনি দোষী নন ।’’

জামিনে মুক্ত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তনী কেজরিওয়াল। তাঁর চেয়ারে বসেন অতিশী মার্লেনা ৷ কেজরি নিজে না-বললেও আপ নেতারা ভোটপ্রচারে বারবার বলেছিলেন, ভোটে জিতে এলে অতিশী নন, ফের প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব নেবেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালই ৷ দিনের শেষ যদিও একমাত্র অতিশী ছাড়া, আপের কোনও হেভিওয়েট প্রার্থীই জয়ের মুখ দেখেননি ৷

  • সংকল্প সমাচার

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের দু’সপ্তাহেরও কম সময় বাকি ৷ সেসময় সম্পূর্ণ ইস্তাহার প্রকাশ করে বিজেপি । সংকল্প পত্রে ক্ষমতায় আসার 3 বছরের মধ্যে যমুনা পরিষ্কার করা, গিগ শ্রমিকদের জন্য একাধিক কল্যাণমূলক প্রকল্প, দিল্লি মেট্রোতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বার্ষিক 4 হাজার টাকা পর্যন্ত বিনামূল্যে ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল । দেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের 10 লক্ষ টাকার বীমা এবং 5 লক্ষ টাকার দুর্ঘটনা বীমা কভার, স্বচ্ছভাবে 50 হাজার সরকারি পদ পূরণ, 20 লক্ষ আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং বিশাল মহাভারত করিডোর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও ।

দিল্লি জয়ের পর বিজেপি সদর দফতরে নাড্ডা (পিটিআই)

বস্তুত কেজরিওয়ালের বাস্তবায়ন না-হওয়া প্রতিশ্রুতিকেই হাতিয়ার করেছে পদ্মশিবির, সঙ্গে জুড়েছে গেরুয়া ছোঁয়ায় প্রতিশ্রুতির বহর। ভোটারদের মন জয়ে বিজেপির সংকল্প পত্র অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর।

  • বাজেট চাল

দিল্লি নির্বাচনের চারদিন আগে বাজেট পেশ করেন নির্মলা সীতারামন ৷ ওয়াকিবহাল মহল বলছে, ওখানেই অনেকটা বাজিমাত করেছিল পদ্ম-শিবির ৷ করছাড়ের সীমানা বাড়ানোতে ভোটও বাড়িয়ে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা ৷ পাঁচদিন পর দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনেই সমীকরণটা জলের মতো পরিষ্কার ৷ নির্বাচন শুরুর মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেও লোকসভায় বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাষ্ট্রপতির দেওয়া ভাষণের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ‘শিসমহল’ শব্দের ব্যবহার করেন প্রধানমন্ত্রী । ঘুরপথে তিনি যে কেজরিকেই কটাক্ষ করেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই ।

2013-তে দিল্লির রাজনীতি কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতির প্রশ্নে সরগরম । কাঠগড়ায় কংগ্রেসের শিলা দীক্ষিত ও তাঁর একাধিক মন্ত্রী । তার আগে 2011 সালে দিল্লির জন্তরমন্তর চত্বর দেখেছে আন্না হাজারের লোকপাল বিল নিয়ে অনশন ৷ তার পরের বছর আন্নার বিশ্বস্ত সঙ্গী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নতুন দল আম আদমি পার্টির জন্ম । আপ ভূমিষ্ট হওয়ার দু'মাসের মধ্যেই ঘটে যায় নির্ভয়া কাণ্ড । 2012-র ডিসেম্বরের সেই ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে দিল্লি পুলিশের জল কামানের সামনে নির্ভয়ার বিচারের দাবিতে রাজপথে রুখে দাঁড়িয়েছিল আট থেকে আশি । এর ঠিক পরেই উঠে আসে কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতি । দিল্লির কংগ্রেস শাসনে শেষ পেরেক পুঁতে মুখ্যমন্ত্রী হন, আম আদমি কেজরিওয়াল । যদিও বিজেপিকে ঠেকাতে মরিয়া কংগ্রেস 2013-র সেই আপ সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল, তবে অচিরেই এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে কংগ্রেস-আপ জোট আসলে সোনার পাথরবাটি ।

দিল্লি জয়ের পর সমর্থকদের উল্লাস (ইটিভি ভারত)

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করে আপের জন্ম দেওয়া সেই কেজরিওয়ালকে বা তাঁর ঘনিষ্ট সহযোগী এবং দিল্লি সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকে যখন আবগারি দুর্নীতি মামলায় জেলে যেতে হয়, বৃত্তটা তখনই অনেকটা পূরণ হয়ে যায় । এর সঙ্গেই যোগ হয় মোদি-শাহের 'শিসমহল' কটাক্ষ । পরিস্থিতি যে ক্রমশ জটিল হচ্ছে, তা কেজরি হয়তো বুঝেছিলেন । শেষ চেষ্টায় আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন দিল্লির পূর্বাঞ্চলী অভিবাসী ভোটারদের । তাঁদের মন জয়ে আপ সরকার ছট পুজোতে ছুটি ঘোষণা থেকে যমুনার পাড়ে পুজোর ঘাট বানানো - কোনও খামতিই রাখেনি । তবুও ইভিএম খুলতেই পূর্বাঞ্চলী-অধ্যুষিত 27টি বিধানসভার মধ্যে 22টি’তেই ধরাশয়ী আপ । সঙ্গে যোগ হয়েছে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট । প্রাথমিক হিসেবে অনুযায়ী, প্রায় 15টি আসনে ত্রিকোণ লড়াইয়ের বদলে বিজেপি বনাম আপ-কংগ্রেস জোটের একের বিরুদ্ধে একের লড়াই হলে, 2025-এর দিল্লির রায় অন্য রকম হত ।

দিল্লি নির্বাচনের ফলাফলের ছায়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিহার বিধানসভা লড়াইয়ে কতটা পড়ে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ফেলে, সেটাই দেখার ।

আরও পড়ুন

Last Updated : Feb 8, 2025, 6:10 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details