ঝাড়গ্রাম, 24 জুন: পাতা হতো প্রেম-বিয়ের ফাঁদ ৷ ভালোবাসার মোহে অন্ধ হয়ে অনেক মেয়েই ধরতেন কয়েক মাসের চেনা প্রিয়জনের হাত ৷ তারপর খুলে যেত মুখোশ ৷ এক সময়ের প্রেয়সীকেই জোর করে নামানো হতো দেহ ব্যবসায় ৷ না চাইলে চলত শারীরিক নির্যাতন ৷ দীর্ঘ সময় ধরে চলা দেহ ব্যবসা ও নারী পাচার চক্রের মূল পাণ্ডাদের জেলের ভিতর ঢোকালো পুলিশ ৷ 17 বছরের নাবালিকা পাচার, অপহরণ, ধর্ষণ-সহ একাধিক অভিযোগের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এক মহিলা-সহ 4 জন ৷ সোমবার দোষীদের 20 বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন ঝাড়গ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত ও জেলা দায়রা আদালতের বিচারক চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়।
সরকারি আইনজীবী কুণাল কান্তি ঘোষ বলেন, "পুলিশ অত্যন্ত দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট জমা দেয় । সেই তদন্তের উপর ভিত্তি করে মোট 16 জনের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর এদিন বিচারক চারজনের সাজা ঘোষণা করেছেন। কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন, অজয় দাস, বাবর বেগ ও পিঙ্কি বিশাল ওরফে সোনালী বিশাল এই চারজনেরই 20 বছরের সাজা ঘোষণা হয়েছে। যতগুলি ধারা হয়েছিল প্রতিটি ধারায় প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রত্যেকটি ধারায় সাজা ঘোষণা হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, দোষীদের জরিমানা করা হয়েছে । নাবালিকাকে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহা বলেন, "এফআইআর রেজিস্ট্রেশন থেকে সাজা ঘোষণা পর্যন্ত মাত্র 10 মাসের মধ্যে আমরা বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। নারী পাচারের ঘটনায় এত তাড়াতাড়ি সাজা ঘোষণা এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কোথাও নিদর্শন নেই। নারী পাচার বা অপহরণের ঘটনাগুলি আমরা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখি । ভবিষ্যতে এরকম ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করার চেষ্টা করব এবং প্রকৃত দোষীরা যাতে কোনভাবেই ছাড়া না পায় সেই বিষয়টি আমরা সুনিশ্চিত করব"।
জানা গিয়েছে, ঘটনাটি শুরু হয়েছিল 2023 সালের 17 অগস্ট ৷ ঝাড়গ্রাম থানায় 17 বছরের এক নাবালিকার মা অপহরণের অভিযোগ জানান। লিখিত অভিযোগে তিনি জানান, 16 তারিখ থেকে তাঁর মেয়ে নিখোঁজ । ঘটনার তদন্ত নেমে ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ এলাকার বাসিন্দা কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার চাকুলিয়া থানার অন্তর্গত বাসিন্দা অজয় দাসকে গ্রেফতার করে। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর অভিযোগের 10 দিনের মাথায় 26 অগস্ট ঝাড়গ্রাম রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকা থেকে নাবালিকাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরেই সামনে আসে নারী পাচারের চক্রের হদিশ।
এরপরেই পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহার নেতৃত্বে গঠিত হয় সিট। শুরু হয় তদন্ত। এরপর লালগড় থানা এলাকার বাসিন্দা বাবর বেগ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ। সামনে আসে চক্রের আর এক মাথা পিঙ্কি বিশাল ওরফে সোনালী বিশাল নামের এক মহিলা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নারী পাচারের মূল পাণ্ডা ছিলেন পিঙ্কি ৷ কৌশিক, অজয় এদের মত ছেলেদের মাধ্যমে নাবালিকা মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসানো হতো। তারপর নানা কৌশল অবলম্বন করে নাবালিকাদের জোর করে নামানো হতো দেহ ব্যবসায়। কেউ রাজি না থাকলে তার উপর চলত শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। কখনও কখনও নাবালিকাদের খাওয়ানো হতো মাদক জাতীয় ওষুধ।
জানা গিয়েছে, পিঙ্কি বিশালকে গ্রেফতারের পর গত বছর অক্টোবর মাসের 17 তারিখ আদালতে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। চার্জশিট পেশের তিন মাসের মাথায় পুনরায় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। চার্জশিটে যুক্ত করা হয় নারী পাচার, ধর্ষণ, 4 ও 6 নম্বর পকসো-সহ একাধিক ধারা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের 5 তারিখ চার্চ গঠন করা হয় ৷ জানুয়ারি মাসের 29 তারিখ থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। চিকিৎসক নাবালিকা, নাবালিকার মা-সহ মোট 16 জনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর চলতি মাসের 20 তারিখ বৃহস্পতিবার কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন, অজয় দাস, বাবর বেগ, এবং পিঙ্কি বিশাল ওরফে সোনালী বিশালকে দোষী সাব্যস্ত করে ঝাড়গ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত।