বোলপুর, 23 নভেম্বর: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আশ্রম ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী আজ ইউনেসকোর স্বীকৃত 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ'। বিশ্বের একমাত্র চলমান বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব ঐতিহ্যের এই তকমা পেয়েছে । বিশ্বভারতী জুড়ে ছটিয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য । স্থাপনের সময় থেকে সমান ধারায় ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই প্রতিষ্ঠান । তাই সারা বিশ্বে তা সমাদৃত । 19 থেকে 25 নভেম্বর বিশ্ব হেরিটেজ সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের ইতিহাস তুলে ধরলেন অধ্যাপক ও পড়ুয়ারা ৷
বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তথা আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ ভবনের সমন্বায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে জানালেন শান্তিনিকেতন আশ্রম ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ৷
শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
1883 সালের মার্চ মাসে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ছাতিমতলা-সহ 20 বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসীপাট্টা পেয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । উদ্দেশ্য ছিল, অরণ্যবেষ্টিত এই স্থানে একটি ব্রহ্ম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা ৷ তবে জমি পাওয়ার আগে থেকেই এখানে একটি গৃহ ছিল ৷ যা আজ 'শান্তিনিকেতন গৃহ' হিসাবে পরিচিত । এই স্থানেই মহর্ষি শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ৷
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিকাঠামো নিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতাদর্শগত পার্থক্য বরাবরই ছিল ৷ শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর এখানে শুরু হয় ব্রহ্ম উপাসনা ৷ পাশাপাশি পঠন-পাঠন শুরুর চিন্তাভাবনা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ সেই মতো 1901 সালে শুরু হয় বিদ্যালয় অধ্যয়ন । প্রথমে এর নাম ছিল 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম'। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বিশ্বভারতী' নামকরণ করেন ৷ 1918 সাল থেকে বিশ্বভারতী সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করে ৷ তবে 1921 সাল থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিশ্বভারতীর জন্ম হয় ৷ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্ডিত ব্যক্তিদের আহ্বান করে আনেন রবীন্দ্রনাথ । শুরু হয় বিশ্বভারতীর পথ চলা ৷
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা
বিশ্বভারতীকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে হেরিজেট কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন ৷ এরপর ইউনেসকো থেকে একাধিকবার প্রতিনিধি দল আসে বিশ্বভারতীতে । তারা বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে গুরুদেবের পাঁচটি বাড়ি, কলাভবন, সঙ্গীতভবন, উপাসনা গৃহ, সিংহ সদন, শান্তিনিকেতন গৃহ, তালধ্বজ, ছাতিমতলা, ঘণ্টাতলা, পাঠভবন, গৌরপ্রাঙ্গণ, চৈতী বাড়ি ঘুরে দেখেন ৷
সৌদি আরবের রিয়াধে ইউনেসকোর সভা থেকে 2023 সালের 17 সেপ্টেম্বর মহর্ষি ও গুরুদেবের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ' তকমা দেওয়া হয় ৷ বিশ্বের একমাত্র চলমান বিশ্ববিদ্যালয় এই বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পেয়েছে ৷ বিশ্বভারতী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ কর, রামকিঙ্কর বেইজ, কেজি সুব্রহ্মণ্যম ও যোগেন চৌধুরীর শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য ।
বিশ্বভারতীর হেরিটেজ প্রাচীন শান্তিনিকেতন গৃহের ইতিহাস
শান্তিনিকেতন গৃহ থেকেই এই এলাকার নাম 'শান্তিনিকেতন' হয়েছে ৷ অর্থাৎ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই গৃহ ছিল । এমনটা জানা যায় রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহের দলিল থেকে । উপাসনা গৃহ প্রতিষ্ঠার আগে এই শান্তিনিকেতন গৃহতেই ব্রহ্ম উপাসনা হত । 1895 সাল থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সপরিবারে এই গৃহে বসবাস করতেন ।
এই বাড়ির ঐতিহ্য অনেক বেশি । গুরুদেব ছাড়াও এই বাড়িতে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো ব্রাহ্ম পণ্ডিতেরা বাস করেছেন । তাছাড়াও ঠাকুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখও শান্তিনিকেতন গৃহে বাস করেছেন । এমনকি, মহাত্মা গান্ধি, মদনমোহন মালব্য, যদুনাথ সরকার, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের মতো বরিষ্ঠ দেশনেতারাও এখানে ভিন্ন ভিন্ন সময় থেকেছেন । আজও প্রথা অনুযায়ী পৌষ উৎসবের সূচনা সানাই এই গৃহ থেকেই বাজে ।
উপাসনা গৃহ
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল ব্রহ্ম উপাসনার জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার । সেই মতো 1891 সালের 21 ডিসেম্বর 'ব্রহ্ম মন্দির' বা 'উপাসনা গৃহ' প্রতিষ্ঠিত হয় । ঢালাই লোহা ও বেলজিয়ামের কাঁচ দিয়ে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছে 'শিকদার কোম্পানি'। প্রতি বুধবার এখানে ব্রহ্ম উপাসনার রীতি আজও বিদ্যমান । এছাড়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় বিশেষ উপাসনাও হয়ে থাকে ৷ তবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি ৷
সিংহ সদন
1927 সালে রায়পুরের জমিদার সিংহ পরিবারের 11 হাজার টাকা ব্যয়ে এই 'সিংহ সদন' তৈরি হয় । আগে এর নাম ছিল 'সিংহ ভবন'। লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের স্মরণে এই সদন ৷ এখানে একটি বৃহৎ ঘড়ি রয়েছে । এই ঘড়ি ধরেই আশ্রমের কাজকর্ম হয়ে আসছে ৷
বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের গবেষক মেহেলি সাঁই ইটিভি ভারতের জানান সঙ্গীতভবন ও কলাভবনের ইতিহাস ৷
সঙ্গীতভবন
নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চার অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এই সঙ্গীতভবন । সম্ভবত, 1923 সালে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মারাঠি সঙ্গীত শিল্পী ভীমরাও শাস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীতভবন গড়ে ওঠে । বিশ্বভারতীর যাবতীয় বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিতে মূলত এই ভবনের পড়ুয়ারাই অংশ নেন ।
কলাভবন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় 1923 সালে শিল্পী নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে কলাভবন, যা বিশ্বভারতীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির মধ্যে অন্যতম । এক ছাদের নীচে ভিন্ন ভিন্ন শিল্প বিকাশের প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা সেই সময় বিশ্বের কেউ ভাবতে পারেননি । যদিও, এই ভবন গড়তে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ কর, অসিতকুমার হালদারের অবদান স্মরণীয় । প্রথমে মাত্র 14 জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু হয়েছিল শিল্পচর্চা । পরবর্তীতে যোগ দেন রামকিঙ্কর বেইজ ৷ ষড়ঙ্গ বিভাগের শিল্পকলার অন্যতম প্রতিষ্ঠান এটি ৷
এই ভবনে মূল পাঁচটি বিভাগ রয়েছে । পেইন্টিং, স্কাল্পচার, গ্রাফিক্স, ডিজাইন ও হিসট্রি অফ আর্ট । নাট্যঘরের সামনে শ্রীনিকেতন যাওয়ার রাস্তায় নন্দন বাড়িটি হল কলাভবনের মূল অফিস । ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও দেশ-বিদেশের পড়ুয়ারা এখানে পড়াশোনা করেন । কলাভবন
জুড়ে প্রখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম শোভা পায় । দেখা মেলে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের নজিরবিহীন ভাস্কর্যগুলি ।
পাঠভবন
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় মুক্ত আকাশে গাছতলায় শিক্ষাদান শান্তিনিকেতন আশ্রমের এক অনন্য ঐতিহ্য । পাঠভবন হল বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন আশ্রমের ভিত । আশ্রম শিক্ষায় স্কুল স্তরকে বলা হত 'পূর্ব বিভাগ' ও কলেজ স্তরকে বলা হত ‘উত্তর বিভাগ’। প্রথমে পূর্ব বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন জগদানন্দ রায়, পরে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রমোদারঞ্জন ঘোষ ৷ 1923 সালে এই পূর্ব বিভাগের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘পাঠভবন’ নামকরণ হয় । কবিগুরুর সময় থেকে আজও গাছের তলায় ক্লাস হয় এখানে ৷
পাঠভবনের মতোই একই ভাবে 1924 সালে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘শিক্ষাসত্র’। প্রথমে এই শিক্ষাসত্র শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা হলেও 1927 সালে তা শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত করা হয় । 159 জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু হয়েছিল পূর্ব বিভাগ । তাঁদের মধ্যে 30 জন পড়ুয়া ছাত্রাবাসে থাকতেন । তাঁদের দেখাশোনা করতেন প্রতিমা দেবী ও সুকুমারী ঘোষ । এই পাঠভবন বিশ্বভারতীকে আর পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠার থেকে আলাদা ভাবে চেনায় ।
ঘণ্টাতলা
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের । বৌদ্ধধর্মের অনেক কিছুই তিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । যেমন চৈত্য বাড়ি, ঘণ্টাতলা প্রভৃতি । তবে ঘণ্টাতলা প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে । কেউ বলেন, 1901 সালে এটি তৈরি হয়েছিল, আবার অনেকের মত এটি হয়েছিল 1919 সালে । ছাত্রী লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়ের স্কলারশিপের টাকায় তৈরি করা হয় বৃহৎ ঘণ্টা । সেই ঘণ্টা চুরি যায় । পরে আশ্রমিক, আবাসিকরা এটি নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করে । ফের ঘণ্টা লাগান গৌরপ্রাঙ্গণে । সিংহ সদনের কাছে প্রাচীন বটের গোড়া ঘিরেই তৈরি হয়েছিল ঘণ্টাতলা । 2020 সালের 25 আগস্ট ভূমিকম্পে বটবৃক্ষ উপড়ে ভেঙে পড়ে ঘণ্টাতলাটি ৷ সেটিকে পূর্বের ন্যায় নির্মাণ করা হয়েছে ।
রবীন্দ্রভবন
রবীন্দ্রভবনের ভিতরে একটি সংগ্রহশালা রয়েছে । যেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত সামগ্রী, পাণ্ডুলিপি, নোবেল পদকের রেপ্লিকা রাখা রয়েছে । গুরুদেবের ব্যবহৃত পাঁচটি বাড়ি রয়েছে এই উত্তরায়ণ চত্ত্বরে - উদয়ন, উদীচী, কোনার্ক, পুনশ্চ ও শ্যামলী ।
উদয়নের পাশে কবি নির্মাণ করেছিলেন আরেকটি বাড়ি ৷ নাম দিয়েছিলেন কোনার্ক । এই বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । পরে থাকতেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷
কোর্নাকের পাশে রয়েছে শ্যামলী বাড়ি ৷ সেই সময় বীরভূমে অত্যন্ত গরমের হাত থেকে বাঁচতে কবির ইচ্ছানুসারে সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল ৷ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ ও তাঁদের ছাত্ররা ৷ এই বাড়িতে গুরুদেব ছাড়াও মহাত্মা গান্ধি, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মাদার টেরেজা বাস করেছেন ৷
শ্যামলীর পাশে আরেকটি ছোট বাড়ি নির্মাণ করা হয় । চারিদিক খোলা বারান্দাযুক্ত বাড়ির নাম কবি দিয়েছিলেন পুনশ্চ ৷
এর পাশে 1938 সালে চারটি থামের উপর একটি বাড়ি নির্মাণ হয় ৷ প্রথমে কবি এই বাড়ির নাম দেন 'সেঁতুতি'। পরে নিজেই নাম বদল করে বাড়িটির নামকরণ করেন উদীচী । অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, "বিশ্বভারতীর স্থাপত্যশৈলী হল একটা বড় দিক, যা বিশ্বভারতীকে ভিন্ন করে দেখায় ।"
গবেষক ছাত্রী মেহেলী সাঁই বলেন, "বিশ্বভারতীতে শুধু যে পঠন-পাঠন হয় তা নয়, প্রকৃত শিল্প-সংস্কৃতিযুক্ত মানুষ তৈরি হয় এখানে ।"