কলকাতা, 12 ডিসেম্বর: বিধায়কদের পারফরম্যান্সের জায়গা হল বিধানসভা । ওটাই যেন তাদের কাছে 22 গজ । কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, এই 22 গজে নেমে চার-ছয় হাঁকানো তো দূরের কথা, ব্যাটটাই ধরলেন না অনেকেই । গোটা বছর নীরব দর্শক হয়েই থাকলেন শতাধিক বিধায়ক ৷ আর বিধায়কদের এহেন পারফরম্যান্স শেষবেলায় চিন্তার ভাঁজ ফেলল পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের কপালে । তাই শীতকালীন অধিবেশনের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কার্যত উষ্মা প্রকাশ করলেন তিনি ।
শীতকালীন অধিবেশন মানেই বছরের শেষ অধিবেশন । জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর বাজেট অধিবেশন, বাদল অধিবেশন আর শীতকালীন অধিবেশন মিলে 40 দিন চলেছে রাজ্য বিধানসভা । প্রশ্নোত্তর পর্ব, উল্লেখ পর্ব, জিরো আওয়ার, প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, বিল - এসব ক্ষেত্রে বিধায়কদের প্রশ্ন করা বা আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে । তাৎপর্যপূর্ণ হলেও সত্যি যে, কী শাসকদল কী বিরোধী উভয় ক্ষেত্রেই এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলিকে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি অনেকেই । তাই তাঁরা নীরব দর্শক হয়ে থেকেছেন ৷ শাসক এবং বিরোধী মিলে এই সংখ্যাটা কিন্তু নিতান্তই কম নয় । পরিষদীয় মন্ত্রী বিধানসভার ভেতরে প্রায় 70 জনের কথা উল্লেখ করলেও শাসক-বিরোধী মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় শতাধিক ।
বিধানসভার এই সময় ব্যবহার করা কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বলতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ বলেন, "বিধানসভাই হল নিজের এলাকার সুবিধা অসুবিধা চাওয়া পাওয়া তুলে ধরার জায়গা । একজন বিধায়ককে শুধু তাঁর বিধানসভাতেই মানুষকে পরিষেবা দিলে হয় না, পাশাপাশি ওই বিধানসভা ক্ষেত্রের সমস্যা, মানুষের চাহিদা যদি তুলে ধরতে হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ের পরিকল্পনা নেওয়ার আগে বা বরাদ্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে ওই এলাকার জন্য দাবি আদায় করে নেওয়া যায় । সে কারণেই বিধানসভার অধিবেশনগুলিতে বিধায়কদের সক্রিয় থাকা জরুরি ।"
তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি তেমনটাই শিখেছি । এবং যাঁরা নতুন, তাঁদেরও সে কারণেই বারবার বিধানসভার অধিবেশনকে ব্যবহার করার কথা বলা হয় । এমনকি একজন বিধায়কের সামগ্রিক সাফল্য বা ব্যর্থতার পর্যালোচনা তাঁর বিধানসভার পারফরম্যান্স যুক্ত করেই ধরা হয় । তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় প্রত্যেক বিধায়ককে বেশি করে বিধানসভাকে ব্যবহার করার কথা বলেন ।"
যতদূর জানা যাচ্ছে, বিধায়কদের এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ভালো ভাবে নিচ্ছে না । দলের তরফ থেকে তাদের ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে । বিধানসভাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করেছেন এমন বিধায়কের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা । তাই মাত্র দুই একবার যাঁদের কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছে এমন বিধায়কের সংখ্যাও প্রায় শতাধিক । আর যাঁরা একদম নীরব ছিলেন, তালিকায় এমন বিধায়কের মধ্যে প্রাক্তন মন্ত্রীদের নামও রয়েছে ।
যেমন এমন বিধায়কদের মধ্যে রয়েছেন সাবিত্রী মিত্র, আবদুল করিম চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন মোল্লা, তপন দাশগুপ্তের মতো নাম । বিধায়ক হিসেবে রয়েছেন চিরঞ্জিত, কাঞ্চন মল্লিক, রুকবান-উর রহমান, আশিস মার্জিত, শম্পা ধারা প্রমুখ । তালিকাটা বেশ দীর্ঘ । শুধু যে শাসকদলের বিধায়কই এমন রয়েছেন তা নয় । রয়েছেন বিরোধী দলের বিধায়কও । বিজেপি বিধায়কদের তরফ থেকে যাঁদের বিধানসভায় একদিনও বলতে দেখা যায়নি, তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে মুকুল রায়ের নাম (দলবদলু হলেও বিধানসভার খাতায় এখনও তিনি বিজেপি বিধায়ক)। যদিও তিনি অসুস্থ, বিধানসভায় গত এক বছরে একদিনও আসেননি তিনি । তবে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অর্জুন সিংয়ের ছেলে পবন সিং, নিরজ তামাং জিম্বা, বরেন চন্দ্র বর্মন, গোপাল সাহা প্রমুখ ।
এই নিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, "ইতিমধ্যেই আমাদের নজরে এসেছে বিধানসভার অধিবেশনে কয়েকজন বিধায়কের পারফরম্যান্স খুব ভালো । আবার বেশ কিছুজন রয়েছেন, যাঁদের অধিবেশন কক্ষে বলতেই দেখা যায় না । যাঁরা নীরব থাকেন তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলছি । আগামী বছর বিধানসভার অধিবেশন হলে তাঁদের যাতে সক্রিয় করা যায়, তারই চেষ্টা হচ্ছে । আমি বলব, দলের নির্দেশে নয়, নিজেদের বিধানসভা ক্ষেত্রের মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে আপনারা বলুন ।"
তবে বিধানসভায় পারফরম্যান্সে শাসক বিরোধী মিলে সক্রিয় ভূমিকায় যে বিধায়কদের দেখা গিয়েছে, তার মধ্যে অবশ্যই থাকবেন সমীর জানা, মহম্মদ আলি, নওশাদ সিদ্দিকী, অপূর্ব সরকার, অম্বিকা রায়, বিশ্বনাথ কারক, সুকান্ত পাল, মোশারফ হোসেন, অগ্নিমিত্রা পালরা । শাসক এবং বিরোধী সব পক্ষই এঁদের সক্রিয়তার প্রশংসা করছেন । খুব স্বাভাবিকভাবেই এ বছরে যাঁরা নিষ্ক্রিয় রইলেন, তাঁদের খাতা খোলার সুযোগ আর নেই । কিন্তু আগামী বছর তাঁদের পারফরম্যান্সের কিছু পরিবর্তন হবে কি ! সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাজেট অধিবেশন হতে পারে । সেই সময় তাঁদের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাবে কি না সেটাই দেখার ৷