আরামবাগ, 10 জুন: রাস্তার ধারে যৎসামান্য জিনিস সহযোগে চা বিক্রি করে সংসার চালান মহম্মদ শরিফ ওরফে সাহেব। তাঁর স্বপ্ন বড় গায়ক হওয়ার। যদিও সেই স্বপ্ন মিলিয়ে গিয়েছে চোখের তারাতেই। তবু গান গাওয়া ছাড়েননি সাহেব ৷ চা বিক্রির মাঝেই সুর তোলেন তিনি ৷ ক্রেতারা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাহেবের সেই গান উপভোগ করেন ৷
গোঘাট থানার অন্তর্গত বেঙ্গাই বাসস্ট্যান্ডের কাছে রয়েছে সাহেবের ছোট্ট ব্যবসা। মাথার উপরে রয়েছে একটি বড় ছাতা ৷ সামনে একটি কাঠের টেবিল ৷ তার উপর চা বানানোর কিছু সরঞ্জাম ৷ ব্যস, এতেই চলে সাহেবের রুজি-রুটি। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁর চা তো পছন্দই করেনই, তবে তিনি এলাকায় পরিচিত গানের মাধ্যমেই । অধিকাংশ পথ চলতি মানুষ ও নিত্যযাত্রীরা তাঁর কাছে চা খেতে আসেন সঙ্গে বিনামূল্য গান শুনবে বলে। স্থানীয়দের কথায়, সাহেবের হাতের চা যেমন সুন্দর তেমন সুন্দর ওর গলার গান। ওর গলার গান চায়ের স্বাদ দ্বিগুণ করে দেয়।
সাহেব জানান, তাঁর গান-বাজনার সঙ্গে পরিচিতি অনেক ছোটো থেকেই। আগে পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত রেওয়াজও করতেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে মধ্যমগ্রামে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশ এন্ড ফিশারিজ কোর্সে ভরতি হন তিনি । তারপরই হঠাৎ তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন । মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পড়াশুনা ছাড়তে হয় সাহেবকে । পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ার এক বছরের মাথায় মৃত্যু হয় সাহেবের মায়ের। সেই সময়ই সাহেবের জীবন অন্য একটি মোড় নেয় ।
2019 সাল থেকে গান-বাজনা ছেড়ে সাহেব রাস্তায় নামেন চা বিক্রেতা হিসাবে। এখন গান শুনিয়ে চা বিক্রি করেই অসংখ্য মানুষের মন জয় করে চলেছেন তিনি। এই মুহূর্তে বউ, ছোট্ট মেয়ে ও বাবাকে নিয়ে পিডব্লিউডির জায়গায় ছোটো বাড়ি বানিয়ে থাকেন চা বিক্রেতা গায়ক। সাহেব বলেন, "চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল ৷ তবে শুধুমাত্র পেটের তাগিদে মুছে গিয়েছে সব । কপাল ভালো থাকলে কোনওদিন 300 আবার কোনোদিন 150 টাকা রোজগার হয়ে যায়।"
সাহেবের বাবা এম ডি আমরুল হক ওরফে সাধন মাস্টার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে টিউশন করে যৎসামান্য রোজগার করেন তিনি । সাধন মাস্টার বলছেন, "হয়তো ছেলেকে সাহায্য করার মতো আমার আর্থিক ক্ষমতা নেই, তবে ওর ছোটো ছোট আবদার পূরণ করার চেষ্টা করি আমি । সাহেব নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে ৷ মানুষের আশীর্বাদ-ভালোবাসা অর্জন করছে ৷ এই দেখেই আমি খুশি ।" সাহেবের স্ত্রী নাসপা বেগমের কথায়, "আমাদের হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায়। তবে স্বামীর প্রচেষ্টা দেখে আমি সর্বদাই তাঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করি ও পাশে থাকার চেষ্টা করি ।"
পরিবারের তরফে জানা গিয়েছে, সাহেব সারাদিন চা বিক্রি করে রাত্রে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে নিজের হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ করেন । এইভাবেই নিজের সাধটাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সাহেব । তাঁর গানের ভবিষ্যত নিয়ে জানতে চাইলে সাহেব বলেন, "আমি এই মুহূর্তে লক্ষ্যভ্রষ্ট।" তবে সাহাবের দোকানে নিত্য চা খেতে আসা অসিত প্রামাণিক বলছেন, "ওর অনেক প্রতিভা আছে ৷ শুধু টাকার অভাবে তা পূরণ করতে পারছে না। আমরা প্রত্যেকেই চাই সাহেব ওর গান দিয়ে একটা বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হোক। ওর এই প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে ।"
সাহেবকে শিমূল ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন এলাকাবাসীরা । তাঁদের কথায়, আমরা চাই ওর এই ফুলের মতো প্রতিভার ঠাঁই হোক দেবতার চরণে, শিমূল ফুলের মতো রাস্তায় নয় । যদিও এত সমস্যা ও এত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও মুখের হাসি অমলিন আছে সাহেবের ঠোঁটে । খোশমেজাজে কখনও কুমার শানু, কখনও আদিবাসী গান, আবার কখনও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাচ্ছেন তাঁর দোকানে চা খেতে আসা মানুষদের। বেঙ্গায়বাসী সাহেবের প্রতিভাকে ভালোবেসে একবাক্যে বলেন, "এক কাপ চায়ে আমরা সাহেবের গান চাই ।"