হিঙ্গলগঞ্জ, 23 অক্টোবর: নদীপাড়ে বাস ! সবসময় মনে আতঙ্ক নিয়ে দিনযাপন করতে হয় বাসিন্দাদের । কখন কী হয়, এই ভেবে । তারই মধ্যে বাংলার আকাশে আরও এক দুর্যোগের ঘনঘটা । আর তা শোনার পর থেকে ঘূর্ণিঝড় দানা'র কালো মেঘের আতঙ্ক গ্রাস করেছে সুন্দরবন উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের ।
বিশেষ করে দানা'র ঝাপটার ক্ষতির আশঙ্কায় তটস্থ হয়ে রয়েছেন উত্তর 24 পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, মিনাখাঁ-সহ একাধিক নদীপাড়ের বাসিন্দারা । আতঙ্কে রাতের ঘুম উড়েছে তাঁদের । তাই তো ঘরবাড়ি ছেড়ে নদীর তীরে এসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই ভাবছেন, এ যাত্রায় কী হবে ? নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হলে আবারও ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হবে না তো ? এই প্রশ্নই এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে সুন্দরবনবাসীকে।
ইতিমধ্যে দানা'র প্রভাবে উপকূলবর্তী জেলাতে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত । প্রশাসনও সক্রিয়, যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে । বিশেষত, উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে । তারপরও আশঙ্কা এবং আতঙ্ক নিয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের । আতঙ্কের নেপথ্যে রয়েছে বেহাল নদী বাঁধ ।
হিঙ্গলগঞ্জের রায়মঙ্গল, কালিন্দী, ডাসা, বেতনী-সহ একাধিক নদী বাঁধে ফাটল দেখা গিয়েছে । যার ফলে আশঙ্কা বেড়েছে বাসিন্দাদের । তবে, ঘূর্ণিঝড় দানা আছড়ে পড়ার আগেই সেই সমস্ত নদী বাঁধ মেরামতে তৎপর হয়েছে সেচ দফতর । এমনটাই জানা গিয়েছে প্রশাসন সূত্রে । এর আগে আয়লা, আমফান, বুলবুল, যশ - একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের 'আঘাত' এসেছে সুন্দরবন উপকূলবর্তী এলাকায় । যার সাক্ষী থেকেছেন সেখানকার বাসিন্দারা । আর তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেই ঘূর্ণিঝড় 'দানা' চোখ রাঙাতে শুরু করায় শঙ্কিত সুন্দরবনবাসী । আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা ৷
উপকূলবর্তী সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জের উপরেও এই ঘূর্ণিঝড় যথেষ্ট আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে । তাই এই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার আগেই আতঙ্কিত হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলি, সাহেবখালি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ । এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, "দীর্ঘদিন ধরে নদী বাঁধ সংস্কার হয়নি । তাই একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় এলাকা । হিঙ্গলগঞ্জের রায়মঙ্গল অথবা কালিন্দী । একের পর এক নদী বাঁধের বেহাল দশা । কোথাও নদীবাঁধে ফাটল দেখা গিয়েছে । কোথাও আবার নদী বাঁধের বেশিরভাগ অংশই ধুয়ে চলে গিয়েছে নদীতে । আর এই পরিস্থিতিতে যদি ঘূর্ণিঝড় এই এলাকায় আছড়ে পড়ে তাহলে নদীর জলের চাপে বাঁধ ধরে রাখতে পারবে না । বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হবে বিস্তীর্ণ এলাকা ।"
এ দিকে, নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হলে শুধু ঘরবাড়িরই ক্ষতি হবে না, ক্ষতির মুখে পড়বেন চাষিরাও । সূত্রের খবর, এই সময় আমন ধানের মরশুম । এলাকার চাষিরা সবে আমন ধানের চাষ করেছেন । নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবনের পরিস্থিতি তৈরি হলে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে তাঁদেরও ।
এই বিষয়ে নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা মলয় মণ্ডল বলেন, "আমরা নদীর পাড়ে বসবাস করি । খুব আতঙ্কে রয়েছি । রাতে ঘুম নেই । নদীর ভাঙনে চিন্তায় থাকতে হয় আমাদের । দীর্ঘদিন নদী বাঁধের কোনও সংস্কার হয়নি । সেকারণে যেকোনও সময় নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবনের আশঙ্কা রয়েছে । প্রশাসন নদী বাঁধ মেরামতের দিকে যদি নজর দেয়, তাহলে খুব উপকার হয় । আমরা চাই, এর একটা স্থায়ী সমাধান হোক ।"
একই সুর শোনা গিয়েছে কালিন্দী নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা অনিল কয়ালের গলাতেও । তাঁর কথায়, "আয়লা, আমফান, বুলবুলের মতো ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করেছি । সেসব ভয়াবহ দিনের কথা আজও ভুলিনি । আমরা চাই, পরিবার নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে । কংক্রিটের বাঁধ কিছু জায়গায় হয়েছে ঠিকই । কিন্তু, বেশিরভাগ জায়গায়, বালির বস্তা, মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নড়বড়ে বাঁধ । সেই নড়বড়ে বাঁধ যে কোনও সময় ভেঙে বাড়িঘর প্লাবিত হতে পারে ।"
যদিও হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও দেবদাস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আমরা সবসময় যোগাযোগ রেখে চলেছি । তাঁদের নির্দেশ মতোই যাবতীয় প্রস্তুতি এবং উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । ফ্লাড শেল্টারে শুকনো খাবার, জলের পাউচ যেমন মজুত রাখা হয়েছে, তেমনই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৈরি রয়েছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার টিমও । নদী বাঁধের দিকে আমরা তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি । সেরকম কিছু হলে সেচ দফতর ব্যবস্থা নিচ্ছে ।"
অন্যদিকে, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালির নদী তীরবর্তী এলাকায় মাইকিং করে বাসিন্দাদের সতর্ক করার কাজ শুরু করেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ।