আসানসোল, 28 নভেম্বর: কোথাও 'গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা', কোথাওবা আবার 'এমএ পাস ট্রেন হকার' । শিক্ষিত বেকার যুবকদের এই হতাশার গল্প আকছার শোনা যায় । সরকারি চাকরি না পাওয়ার এই 'অন্ধকার' গল্পগুলোর পাশেই এক অন্য অনুপ্রেরণার 'আলোর' গল্প শোনায় শিল্পশহর বার্নপুরের গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন ।
আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী মেধাবী হলেও চাকরির জন্য নামী দামি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি, তাঁরা নিজেদের চেষ্টায় গত 39 বছর ধরে এই পাঠচক্র চালিয়ে আসছেন । জানলে আশ্চর্য হতে হয়, শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায় এবং অগ্রজদের সহযোগিতায় এখনও পর্যন্ত 1200-র বেশি ছাত্রছাত্রী সরকারি চাকরি পেয়েছেন । কোনও কোনও ছাত্রছাত্রীর আবার একাধিক চাকরি পাওয়ার নজির রয়েছে ।
1985 সালে মাত্র সাতজন যুবক মিলে বার্নপুর ইস্কো কারখানার ছোট্ট একচিলতে মেসবাড়িতেই যৌথভাবে পঠনপাঠন শুরু করেন । প্রথম বছরেই আশ্চর্যজনকভাবে পাঁচজন যুবক সরকারি চাকরি পেয়ে যান । এই ঘটনায় সবার নজর ঘুরে যায় । নিজেদের চেষ্টায়, একনিষ্ঠভাবে পড়াশোনা করলে যে ফল পাওয়া যায়, তা বুঝতে পারেন বেকার যুবকরা । ধীরে ধীরে ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে । তৈরি হয় বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন ।
প্রতিবছরই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সাফল্যের হার । আর এই সাফল্য দেখেই ইস্কো কারখানা কর্তৃপক্ষ বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের জন্য ওই মেস বাড়িতেই একটি আবাসন তাদের দিয়ে দেয় । সেখানে আলো এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেয় ইস্কো কারখানা । সেই থেকে আজও সেই মেস বাড়িতেই 39 বছর ধরে চলছে বার্নপুর গ্রাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন । ছাত্ররা নিজেদের চেষ্টায় বই কিনেছেন । লাইব্রেরি তৈরি করেছেন এবং সেখানে একনিষ্ঠভাবে পড়াশোনা করছেন তাঁরা ।
বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সম্পাদক অজয় মুখোপাধ্যায় ৷ তিনি নিজেও ওই পাঠচক্র থেকেই পড়াশোনা করে বর্তমানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে চাকরি করছেন ৷ সেই অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, "এখানে ছাত্ররা নিজেদের চেষ্টাতেই পড়াশোনা করে । প্রচুর বই আছে । তা থেকে তাঁরা পাঠ নেন । এছাড়া যে সমস্ত ছাত্ররা সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছেন, কিংবা অপেক্ষাকৃত সিনিয়র, তাঁরা পড়াশোনোয় সহযোগিতা করেন । সপ্তাহে তিনদিন আকর্ষণীয় ক্যুইজ হয় ।"
তাঁর কথায়, "গত 39 বছরে বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন থেকে বারোশোরও বেশি ছাত্র সরকারি চাকরি পেয়েছে । শুধু তাই নয়, কেউ দুটি, কেউ তিনটি, কেউ পাঁচটি চাকরি পেয়েছে এমনও উদাহরণ আছে ৷ এক ছাত্র বারোটি চাকরি পেয়েছে । খুব ভালো লাগে যখন কোনও ছাত্র একাধিক সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র নিয়ে এসে বলে, দাদা কোন চাকরিটা করব ।"
তবে বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের সাফল্যের পাশাপাশি একটা খেদ রয়ে গিয়েছিল এত বছর । বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনে কখনও পঠন পাঠানোর জন্য মেয়েদের সুযোগ দেওয়া যায়নি । কারণ একটি মাত্র ঘর সেখানে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণ হতে পারত বলে মনে করেছিলেন পরিচালকরা । সেই কারণে শুধুমাত্র ছাত্ররা এখানে পড়াশোনা করতেন । কিন্তু এবার বার্নপুরে মেয়েদের পঠন পাঠনোর জন্য বিনামূল্যে পৃথক ব্যবস্থা হতে চলেছে । যার অনুপ্রেরণা এই বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন ।
বার্নপুরের হীরাপুর আমবাগান উষসী ক্লাবের ভবনে বার্নপুর গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সম্পাদক তথা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও খেলোয়াড় কমলেন্দ্র মিশ্র শুধুমাত্র মেয়েদের পঠন পাঠনোর জন্য বিনামূল্যে একটি পাঠচক্র শুরু করেছেন । তিনি জানিয়েছেন, সেখানে প্রচুর পরিমাণে বই ও চাকরির প্রস্তুতির জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুর ব্যবস্থা থাকবে । থাকবেন মহিলা শিক্ষিকারাও । ছাত্রদের পাশাপাশি এবার ছাত্রীরাও একইভাবে সফলতা পাক, এমনটাই চাইছেন সবাই ।