কলকাতা, 17 জানুয়ারি: সংসদ ভবন শুধুমাত্র মানুষের সুযোগ-সুবিধার নীতি নির্ধারণের জন্য হওয়া উচিত নয় ৷ সেখানে জীবজন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গদের বাঁচাতেও কথা বলতে হবে ৷ আর তার জন্য তাঁকে যদি সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করতে হয়, তা-ও করবেন ৷ কলকাতায় 'সেভ লাদাখ, সেভ ক্লাইমেট' শীর্ষক আলোচনা সভা থেকে সেই বার্তাই দিলেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্দোলনকারী প্রখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা সংস্কারক সোনম ওয়াংচুক ৷
তাঁর আদলে তৈরি হয়েছিল 'থ্রি ইডিয়টস' ফিল্মের ব়্যাঞ্চো চরিত্রটি ৷ কলেজ স্ট্রিটের মহাবোধি সোসাইটিতে 'সেভ লাদাখ, সেভ ক্লাইমেট' শীর্ষক আলোচনা সভায় অংশ নেন বাস্তবের 'ফুংসুখ ওয়াংড়ু' ৷ যেখানে তিনি দক্ষিণ কলকাতার হোটেল থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছন ৷
ওই সভায় সংসদে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষা বিষয় উত্থাপনের সুযোগ পাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, "সংসদে লোকজন বসে যেন শুধুমাত্র মানুষের জন্য নিয়ম বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ না-করেন ৷ সেখানে প্রকৃতিকেও জায়গা দেওয়া হোক ৷ কারণ, এই পৃথিবীটা শুধুমাত্র মানুষের নয় ৷ এখানে জীবজন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গও বসবাস করে ৷ তারা সংসদে যেতে পারবে না ৷ কিন্তু, তাদের হয়ে ওকালতি করতে প্রতিনিধি আসুক ৷ আর সেই দিক থেকে ভারত যদি প্রথম দেশ হয়, যেখানে সংসদে প্রকৃতির জন্যও জায়গা হবে, আর সেখানে যদি আমাকে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমি সেটা করব ৷"
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকার জলবায়ু রক্ষায় বিধানসভায় বিল আনবে বলে জানিয়েছিল ৷ সেই নিয়ে সোনম বলেন, "বাংলায় এটা হচ্ছে খুবই ভালো ৷ আমি বলব শুধুমাত্র বাংলা নয় ৷ গোটা দেশে পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ বিল আনা হোক ৷ আর এর জন্য সাধারণ মানুষকে সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে ৷"
এ প্রসঙ্গে সোনম ওয়াংচুক দাবি করেছেন, জলবায়ু রক্ষার স্বার্থে সরকারের বদল হওয়া উচিত ৷ তিনি বলেন, "আমি দেখেছি পেঁয়াজের দাম বেশি বলে সরকার পড়ে যাচ্ছে ৷ মানুষের কাছে পেঁয়াজ যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তাহলে বিশুদ্ধ বাতাস কেন নয় ! শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস জরুরি নয় ! পান করার জন্য বিশুদ্ধ জল জরুরি নয় ! আমি তো বলব, পরিশ্রুত জল, বিশুদ্ধ বাতাস ও গাছপালার স্বাস্থ্যের ইস্যুতে সরকার পড়া ও গঠন হওয়া উচিত ৷"
এর পাশাপাশি, জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে বাংলার মাটি থেকে গোটা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ুক, সেই বার্তা দিয়েছেন সোনম ওয়াংচুক ৷ তিনি বলেন, "বাংলা ভাষা আমার কবিতার মতো লাগে ৷ বাংলার মাটি যে কোনও সংগ্রাম, লড়াই, আন্দোলনের জন্য উর্বর ৷ বহু বুদ্ধিজীবী এর আগে বহু আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছেন, পথে নেমেছেন ৷ আমি চাই এই বাংলার মাটি থেকেই জলবায়ু রক্ষার জন্য আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক ৷ বুদ্ধিজীবীরা জলবায়ু রক্ষায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করুক ৷"
পরিবেশের এই অস্বাভাবিক বদলের জন্য মানুষকেই দায়ী করেছেন তিনি ৷ হিমালয় রক্ষা করাটা কতটা জরুরি সে নিয়ে তিনি বলেন, "হিমালয় প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছে ৷ সেখানকার হাওয়া, আলো, পরিবেশ, জল সব সেরা জিনিসগুলো বিনামূল্যে পাচ্ছি আমরা ৷ তাই তার দাম বুঝতে পারছি না ৷ বুদ্ধিমান মানুষ আগুন লাগার আগে কুয়ো খোঁড়ে ৷ মানুষের কপালে যখন পরিবেশের লাথি পড়বে, তখন তারা বুঝতে পারবে ৷ তার আগে নয় ৷"
তবে, হিমালয় ও তার পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব বলেও জানিয়েছেন সোনম ওয়াংচুক ৷ এর জন্য মানুষকে লোভ সংযম করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ৷ তা না-হলে, অদূর ভবিষ্যতে গ্লেসিয়ার গলার গতি আরও বাড়বে ৷ তার জেরে ফ্ল্যাশফ্লাডের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা আরও ঘটবে বলে জানান ওয়াংচুক ৷
তিনি বলেন, "গরম অনেক বাড়ছে ৷ লাদাখের গরমও বাড়ছে ৷ সেখানে হোটেল-অফিসে পাখা, এসির কথা ভাবছে ৷ 28 ডিগ্রি পর্যন্ত আমরা তাপমাত্রা সহ্য করতে পারি ৷ কিন্তু, তারপরেও আমরা গরমের জন্য এসি চালাই ৷ আবার বেশি ঠান্ডা লাগলে চাদর গায়ে দিই ৷ সরকার এখানে কী করবে ? সে তো আলাদিনের চিরাগ ৷ এসে বলে 'ক্যায়া হুকুম মেরে আকা ? আমরা যা বলি, তাই পালন করতে লেগে যায় ৷"
মানুষের চাহিদা ও পরিবেশে তাঁর প্রভাব নিয়ে সোনম ওয়াংচুক বলেন, "আমরা কেউ কখনও বলি না, আমাদের ফ্রেশ হাওয়া চাই, নদীর তাজা জল চাই ৷ আমরা বলি না, আলাদিন এবার হাওয়া ফ্রেশ করে দেওয়ার কাজ করো ৷ আমরা যদি শুধু কয়েকজন এভাবে ভাবি, আর বাকিরা যদি এটা না-ভাবে তাহলে খুব বেশিদিন আর ভালো থাকব না ৷ অনেকে বলবে আমি কি উন্নয়ন বিরোধী ? না, আমি বলব উন্নয়ন একটা সীমা পর্যন্ত ঠিক আছে ৷ কিন্তু, সেটা বেশি হলে বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷"