ETV Bharat / state

শহরে 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডার' হকার-নাপিত ! অভিনব উদ্যোগে বাঁচবে প্রাণ, জানা যাবে ইতিহাস - RIVER AMBASSADOR

শহরে রিভার অ্যাম্বাস্যাডার হবেন নদী ঘাটগুলিতে নিত্যদিন কাজ করা হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদাররা ৷ অভিনব এই উদ্যোগে বাঁচবে প্রাণ ৷

ETV BHARAT
শহরে 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডার' তৈরির উদ্যোগ (নিজস্ব চিত্র)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 21, 2025, 7:42 PM IST

কলকাতা, 21 ফেব্রুয়ারি: নদী ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডর ৷ সোজা বাংলায় বললে নদীর ঘাটগুলির দূত ৷ আর দূত তাঁরাই হবেন, এই ঘাটগুলিই যাঁদের বাড়িঘর, রুটিরুজি ৷ অর্থাৎ হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদাররা ৷ শুনতে অবাক লাগলেও এমনই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থার তরফে । এই উদ্যোগ সফল হলে বাঁচবে বহু প্রাণ, উন্মোচিত হবে নদী ঘাটের ইতিহাস ৷

সকাল থেকে রাত, এঁদের কেউ নদীর ঘাটে চা, ঝালমুড়ি ফেরি করেন ৷ কেউ আবার ক্ষৌরকর্ম করেন ৷ কেউ করেন সাফাইয়ের কাজ ৷ বছরের পর বছর নদীর ঘাটগুলিই যেন তাঁদের ঘর-সংসার ৷ সারাদিনে সেখানকার নানা ঘটনার সাক্ষী থাকেন তাঁরা । দীর্ঘদিন ধরে এই ঘাটগুলিতে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ঘাটের পরিবর্তনকেও তাঁরা নিত্যদিন চাক্ষুস করছেন । এসব কারণেই আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডার করা হয়েছে সেখানে কর্মরত হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদারদের ।

ETV BHARAT
চা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের প্রশিক্ষণ (নিজস্ব চিত্র)

তাঁদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে । তাঁদের মুখ থেকে গল্প শুনে, তাঁদেরই বলা হচ্ছে ঘাটের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস । বলা হচ্ছে, ঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে । পাশাপাশি সাঁতার জানা হকারদের ডুবন্ত মানুষের জীবনরক্ষার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে । মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁপাতলা ঘাটে চা-ঘটি গরম বিক্রেতা, নাপিত মিলিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন 16 জন । এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'। সকলকে সচিত্র পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছে । তাঁদের কাজের সময়ের মধ্যেই ক্লাস করানো হচ্ছে । প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়টুকুর জন্য তাঁরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন, সেই কারণে তাঁদের 100 টাকা করে দেওয়া হচ্ছে । এই উদ্যোগে খুশি 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডার'রাও ৷

পাঁচ ধাপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে মঙ্গলবার তৃতীয় দফার এক ঘণ্টার এই কর্মশালা আয়োজিত হয় । তাতে, চা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মধ্যে কিরণ সাহা, অভিমন্যু মণ্ডল, শঙ্কর মজুমদার, গোকুল মণ্ডল, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ দাস, বালেশ্বর যাদব, নিরঞ্জন কুমার, রাম কুমার ঠাকুর, যোগেন্দ্রকুমার, দীনেশ মাহাতো, মণীশ মল্লিক-সহ মোট 16 জন অংশগ্রহণ করেন ।

হুগলি নদীর তীর বরাবর প্রায় 42টি ঘাট রয়েছে । তারমধ্যে চাঁপাতলা ঘাটে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচি শুরু হলেও উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রাথমিক পরিকল্পনা বা কাজ সম্পূর্ণ হলে আগামী দিনে আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হবে ।

কোন কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ?

উদ্যোক্তারা জানান, বার্ষিক রিভার ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে চাঁপাতলা ঘাটের সংস্কার করা হবে । এই ঘাটকে দত্তক নিয়ে নানা বিষয়ে প্রচার চালানো হবে । কারণ এখানে শুধু শহর কলকাতার মানুষই নয়, দেশ-বিদেশের বহু মানুষেরা ঘুরতে আসেন । ঘাট পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে ঘাটের ইতিহাস তুলে ধরাটাও গুরুত্বপূর্ণ । তাই নানা রকম পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে । ইতিমধ্যেই চা বিক্রেতাদের নোংরা ফেলার জন্য বালতি দেওয়া হয়েছে । আর যা শেখানো হচ্ছে 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'দের সেগুলি হল,

ETV BHARAT
নদী ঘাটের দূত তৈরিতে কর্মশালা (নিজস্ব চিত্র)

1) 100 জন হকার তথা চা-মুড়ি বিক্রেতাকে ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে ঘাট পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দেওয়া হবে । তাঁরা চা-খাবার বিক্রি করার পাশাপাশি ঘাটের বিভিন্ন জায়গায় ছোট বালতি বা ছোট ডাস্টবিন রাখবেন । সেখানেই ক্রেতাদের কাছে অনুরোধ করবেন, চায়ের কাপ কিংবা খাবারের প্যাকেট বা ঠোঙাগুলো ফেলার জন্য ৷

2) ঘাটের গৌরবময় ইতিহাস তাঁদের জানানো হবে । একইভাবে যাঁরা দীর্ঘদিন এই ঘাটে ব্যবসা করছেন তাঁদের থেকেও অভিজ্ঞতার কথাও শোনা হবে । গৌরবময় ইতিহাস এবং এই সমস্ত হকারদের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে যে তথ্য উঠে আসবে, তা সুন্দর করে পরিবেশন করা হবে । যাতে ঘাটে আগত দর্শনার্থীদের কাছে তাঁরা তা তুলে ধরতে পারেন ।

3) ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । কারণ বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, নদীতে জোয়ারের সময় ঘাটে আগত অনেকেই সাঁতার না-জানার কারণে ভেসে যান । অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । এই সমস্ত মানুষদের এই ভুল পদক্ষেপ বা বিপদ সবার আগে দেখেন এই ঘাটে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা । তাই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, কীভাবে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানো যায় । যে সমস্ত হকাররা সাঁতার জানেন না, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।

উদ্যোগী সংস্থার কর্ণধারের স্বপ্ন

উদ্যোগী সংস্থার কর্ণধার লাইলি থম্পসন বলেন, "চাঁপাতলা ঘাট থেকে এই পাইলট প্রজেক্ট শুরু হল । আগামী তিন বছরের মধ্যে হকারের সংখ্যা 100 করার পরিকল্পনা রয়েছে । আমাদের মনে হয়েছে, এই মুক্ত জায়গাগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই দরকার । সেটা এই এলাকায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ছাড়া সম্ভব নয় । তাই তাঁদেরকে এই কাজে সংযুক্ত করা দরকার । আমাদের স্বপ্ন, এই ঘাটগুলি ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাক ৷ এজন্য পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ৷"

ETV BHARAT
শহরে রিভার অ্যাম্বাস্যাডার হকার-নাপিত ! (নিজস্ব চিত্র)

ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে প্রশিক্ষণ

'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর' তৈরির এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সি এক্সপ্লোরার ইনস্টিটিউট । ওই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক নীলেন্দ্র সরকার বলেন, "এই ঘাটে ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে সকলের আগে এঁরাই দেখতে পান । তাই যাঁরা সাঁতার জানেন, আমরা তাঁদের প্রশিক্ষণ দেব । তথ্য বলছে, গত বছর হুগলি নদীতে জলে ডুবে মারা গিয়েছেন 174 জন । সেই সংখ্যা যদি সামান্য হলেও কমানো যায়, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ।"

ইতিহাস ও মিউজিয়াম

এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লিভিং ওয়াটার মিউজিয়ামের কলকাতা চ্যাপ্টার । ওই প্রতিষ্ঠানের তরফে সুকৃত সেন বলেন, "এই হকাররা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছেন । সেটাও একটা ইতিহাস । সেই ইতিহাসের সঙ্গে ঘাটের পুরনো ইতিহাস আমরা বলার চেষ্টা করছি । আগামী দিনে আহিরিটোলা ঘাট, রথঘাট, হুড়ো মল্লিক ঘাট, চাঁপাতলা ঘাট, কুমোরটুলি ঘাট নিয়ে ইন্টার-অ্যাকটিভ মিউজিয়াম ও বড় আকারে রিভার ফেস্টিভ্যাল করার পরিকল্পনা রয়েছে ।"

খুশি রিভার অ্যাম্বাস্যাডররা

সামগ্রিক এই উদ্যোগে খুশি হবু রিভার অ্যাম্বাস্যাডররা ৷ 30 বছর হয়ে গেল চা বিক্রি করছেন প্রদীপ দাস । সেকালে 30 পয়সায় চা বিক্রি করতেন । এখন 10-20 টাকায় বিকোয় এক কাপ চা । প্রদীপরা চা বিক্রি করেন শহরের ঘাটগুলিতে । চোখের সামনে দেখেছেন, ঘাটের চরিত্র কীভাবে বদলে যায় । অন্ধকারে অপরাধমূলক কাজ যেমন হয়, তেমনই এই ঘাটের পারই সাক্ষী থেকেছে প্রেমের ভাঙা-গড়া খেলার । এসবই তাঁরা চাক্ষুস করেছেন ৷

ETV BHARAT
এই উদ্যোগে বাঁচবে প্রাণ (নিজস্ব চিত্র)

প্রায় সাত বছর এই ঘাটেই ঘটি গরম বিক্রি করছেন উত্তর 24 পরগনার মছলন্দপুরের বাসিন্দা মণীশ মল্লিক । তিনি বলেন, "আমরা তো চাই এলাকাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোক । তাই এই উদ্যোগ খুবই ভালো । আমি সাঁতার জানি । ফলত, ওই প্রশিক্ষণও নেব ।"

স্থানীয়রাও বেশ খুশি

স্থানীয় বাসিন্দা ও খাবারের দোকানদার সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন, "এখানকার কিছু লোকজনের স্বভাব আছে, যেখানে সেখানে চায়ের কাপ বা খাবারের প্লেট ফেলে দেওয়া । প্রতিমা নিরঞ্জন করতে আসা লোকজন ফুল-মালা, বেলপাতা যেখানে সেখানে ফেলে দেয় । আমরা কেউ কিছু বলতে গেলে তারা প্রশ্ন করে তুমি কে ? এগুলো অবশ্যই বন্ধ করা প্রয়োজন । ফলে এই উদ্যোগ ভালো । ভালো কাজ ভালো হবেই ।"

কলেজ পড়ুয়া সুদীপ্ত রায় বলেন, "এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ । যাঁরা হকার আছেন, তাঁদের আমরা চিনি না । এখানে দেখলাম, তাঁদের পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছে । আমরা যাঁরা ঘুরতে আসি বা আড্ডা দিতে আসি, এই পরিচয় পত্র দেখে হকারদের চিনতে পারব ৷ তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় গড়ে উঠবে । ঘাট পরিষ্কার থাকবে । মিউজিয়াম হলে ঘাটের ইতিহাসগুলো জানতে পারব ।"

রাজ্যের অন্যান্য খবর জানতে পড়ুন

কলকাতা, 21 ফেব্রুয়ারি: নদী ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডর ৷ সোজা বাংলায় বললে নদীর ঘাটগুলির দূত ৷ আর দূত তাঁরাই হবেন, এই ঘাটগুলিই যাঁদের বাড়িঘর, রুটিরুজি ৷ অর্থাৎ হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদাররা ৷ শুনতে অবাক লাগলেও এমনই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থার তরফে । এই উদ্যোগ সফল হলে বাঁচবে বহু প্রাণ, উন্মোচিত হবে নদী ঘাটের ইতিহাস ৷

সকাল থেকে রাত, এঁদের কেউ নদীর ঘাটে চা, ঝালমুড়ি ফেরি করেন ৷ কেউ আবার ক্ষৌরকর্ম করেন ৷ কেউ করেন সাফাইয়ের কাজ ৷ বছরের পর বছর নদীর ঘাটগুলিই যেন তাঁদের ঘর-সংসার ৷ সারাদিনে সেখানকার নানা ঘটনার সাক্ষী থাকেন তাঁরা । দীর্ঘদিন ধরে এই ঘাটগুলিতে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ঘাটের পরিবর্তনকেও তাঁরা নিত্যদিন চাক্ষুস করছেন । এসব কারণেই আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডার করা হয়েছে সেখানে কর্মরত হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদারদের ।

ETV BHARAT
চা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের প্রশিক্ষণ (নিজস্ব চিত্র)

তাঁদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে । তাঁদের মুখ থেকে গল্প শুনে, তাঁদেরই বলা হচ্ছে ঘাটের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস । বলা হচ্ছে, ঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে । পাশাপাশি সাঁতার জানা হকারদের ডুবন্ত মানুষের জীবনরক্ষার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে । মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁপাতলা ঘাটে চা-ঘটি গরম বিক্রেতা, নাপিত মিলিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন 16 জন । এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'। সকলকে সচিত্র পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছে । তাঁদের কাজের সময়ের মধ্যেই ক্লাস করানো হচ্ছে । প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়টুকুর জন্য তাঁরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন, সেই কারণে তাঁদের 100 টাকা করে দেওয়া হচ্ছে । এই উদ্যোগে খুশি 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডার'রাও ৷

পাঁচ ধাপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে মঙ্গলবার তৃতীয় দফার এক ঘণ্টার এই কর্মশালা আয়োজিত হয় । তাতে, চা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মধ্যে কিরণ সাহা, অভিমন্যু মণ্ডল, শঙ্কর মজুমদার, গোকুল মণ্ডল, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ দাস, বালেশ্বর যাদব, নিরঞ্জন কুমার, রাম কুমার ঠাকুর, যোগেন্দ্রকুমার, দীনেশ মাহাতো, মণীশ মল্লিক-সহ মোট 16 জন অংশগ্রহণ করেন ।

হুগলি নদীর তীর বরাবর প্রায় 42টি ঘাট রয়েছে । তারমধ্যে চাঁপাতলা ঘাটে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচি শুরু হলেও উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রাথমিক পরিকল্পনা বা কাজ সম্পূর্ণ হলে আগামী দিনে আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হবে ।

কোন কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ?

উদ্যোক্তারা জানান, বার্ষিক রিভার ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে চাঁপাতলা ঘাটের সংস্কার করা হবে । এই ঘাটকে দত্তক নিয়ে নানা বিষয়ে প্রচার চালানো হবে । কারণ এখানে শুধু শহর কলকাতার মানুষই নয়, দেশ-বিদেশের বহু মানুষেরা ঘুরতে আসেন । ঘাট পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে ঘাটের ইতিহাস তুলে ধরাটাও গুরুত্বপূর্ণ । তাই নানা রকম পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে । ইতিমধ্যেই চা বিক্রেতাদের নোংরা ফেলার জন্য বালতি দেওয়া হয়েছে । আর যা শেখানো হচ্ছে 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'দের সেগুলি হল,

ETV BHARAT
নদী ঘাটের দূত তৈরিতে কর্মশালা (নিজস্ব চিত্র)

1) 100 জন হকার তথা চা-মুড়ি বিক্রেতাকে ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে ঘাট পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দেওয়া হবে । তাঁরা চা-খাবার বিক্রি করার পাশাপাশি ঘাটের বিভিন্ন জায়গায় ছোট বালতি বা ছোট ডাস্টবিন রাখবেন । সেখানেই ক্রেতাদের কাছে অনুরোধ করবেন, চায়ের কাপ কিংবা খাবারের প্যাকেট বা ঠোঙাগুলো ফেলার জন্য ৷

2) ঘাটের গৌরবময় ইতিহাস তাঁদের জানানো হবে । একইভাবে যাঁরা দীর্ঘদিন এই ঘাটে ব্যবসা করছেন তাঁদের থেকেও অভিজ্ঞতার কথাও শোনা হবে । গৌরবময় ইতিহাস এবং এই সমস্ত হকারদের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে যে তথ্য উঠে আসবে, তা সুন্দর করে পরিবেশন করা হবে । যাতে ঘাটে আগত দর্শনার্থীদের কাছে তাঁরা তা তুলে ধরতে পারেন ।

3) ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । কারণ বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, নদীতে জোয়ারের সময় ঘাটে আগত অনেকেই সাঁতার না-জানার কারণে ভেসে যান । অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । এই সমস্ত মানুষদের এই ভুল পদক্ষেপ বা বিপদ সবার আগে দেখেন এই ঘাটে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা । তাই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, কীভাবে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানো যায় । যে সমস্ত হকাররা সাঁতার জানেন না, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।

উদ্যোগী সংস্থার কর্ণধারের স্বপ্ন

উদ্যোগী সংস্থার কর্ণধার লাইলি থম্পসন বলেন, "চাঁপাতলা ঘাট থেকে এই পাইলট প্রজেক্ট শুরু হল । আগামী তিন বছরের মধ্যে হকারের সংখ্যা 100 করার পরিকল্পনা রয়েছে । আমাদের মনে হয়েছে, এই মুক্ত জায়গাগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই দরকার । সেটা এই এলাকায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ছাড়া সম্ভব নয় । তাই তাঁদেরকে এই কাজে সংযুক্ত করা দরকার । আমাদের স্বপ্ন, এই ঘাটগুলি ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাক ৷ এজন্য পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ৷"

ETV BHARAT
শহরে রিভার অ্যাম্বাস্যাডার হকার-নাপিত ! (নিজস্ব চিত্র)

ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে প্রশিক্ষণ

'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর' তৈরির এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সি এক্সপ্লোরার ইনস্টিটিউট । ওই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক নীলেন্দ্র সরকার বলেন, "এই ঘাটে ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে সকলের আগে এঁরাই দেখতে পান । তাই যাঁরা সাঁতার জানেন, আমরা তাঁদের প্রশিক্ষণ দেব । তথ্য বলছে, গত বছর হুগলি নদীতে জলে ডুবে মারা গিয়েছেন 174 জন । সেই সংখ্যা যদি সামান্য হলেও কমানো যায়, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ।"

ইতিহাস ও মিউজিয়াম

এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লিভিং ওয়াটার মিউজিয়ামের কলকাতা চ্যাপ্টার । ওই প্রতিষ্ঠানের তরফে সুকৃত সেন বলেন, "এই হকাররা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছেন । সেটাও একটা ইতিহাস । সেই ইতিহাসের সঙ্গে ঘাটের পুরনো ইতিহাস আমরা বলার চেষ্টা করছি । আগামী দিনে আহিরিটোলা ঘাট, রথঘাট, হুড়ো মল্লিক ঘাট, চাঁপাতলা ঘাট, কুমোরটুলি ঘাট নিয়ে ইন্টার-অ্যাকটিভ মিউজিয়াম ও বড় আকারে রিভার ফেস্টিভ্যাল করার পরিকল্পনা রয়েছে ।"

খুশি রিভার অ্যাম্বাস্যাডররা

সামগ্রিক এই উদ্যোগে খুশি হবু রিভার অ্যাম্বাস্যাডররা ৷ 30 বছর হয়ে গেল চা বিক্রি করছেন প্রদীপ দাস । সেকালে 30 পয়সায় চা বিক্রি করতেন । এখন 10-20 টাকায় বিকোয় এক কাপ চা । প্রদীপরা চা বিক্রি করেন শহরের ঘাটগুলিতে । চোখের সামনে দেখেছেন, ঘাটের চরিত্র কীভাবে বদলে যায় । অন্ধকারে অপরাধমূলক কাজ যেমন হয়, তেমনই এই ঘাটের পারই সাক্ষী থেকেছে প্রেমের ভাঙা-গড়া খেলার । এসবই তাঁরা চাক্ষুস করেছেন ৷

ETV BHARAT
এই উদ্যোগে বাঁচবে প্রাণ (নিজস্ব চিত্র)

প্রায় সাত বছর এই ঘাটেই ঘটি গরম বিক্রি করছেন উত্তর 24 পরগনার মছলন্দপুরের বাসিন্দা মণীশ মল্লিক । তিনি বলেন, "আমরা তো চাই এলাকাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোক । তাই এই উদ্যোগ খুবই ভালো । আমি সাঁতার জানি । ফলত, ওই প্রশিক্ষণও নেব ।"

স্থানীয়রাও বেশ খুশি

স্থানীয় বাসিন্দা ও খাবারের দোকানদার সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন, "এখানকার কিছু লোকজনের স্বভাব আছে, যেখানে সেখানে চায়ের কাপ বা খাবারের প্লেট ফেলে দেওয়া । প্রতিমা নিরঞ্জন করতে আসা লোকজন ফুল-মালা, বেলপাতা যেখানে সেখানে ফেলে দেয় । আমরা কেউ কিছু বলতে গেলে তারা প্রশ্ন করে তুমি কে ? এগুলো অবশ্যই বন্ধ করা প্রয়োজন । ফলে এই উদ্যোগ ভালো । ভালো কাজ ভালো হবেই ।"

কলেজ পড়ুয়া সুদীপ্ত রায় বলেন, "এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ । যাঁরা হকার আছেন, তাঁদের আমরা চিনি না । এখানে দেখলাম, তাঁদের পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছে । আমরা যাঁরা ঘুরতে আসি বা আড্ডা দিতে আসি, এই পরিচয় পত্র দেখে হকারদের চিনতে পারব ৷ তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় গড়ে উঠবে । ঘাট পরিষ্কার থাকবে । মিউজিয়াম হলে ঘাটের ইতিহাসগুলো জানতে পারব ।"

রাজ্যের অন্যান্য খবর জানতে পড়ুন

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.