আসানসোল ও বর্ধমান, 14 ডিসেম্বর: ইউপিএসসির আইএসএস পরীক্ষায় বাংলার জয়জয়কার ৷ তালিকার শীর্ষে বাংলার দুই কৃতী ছাত্র ৷ প্রথম হয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের সিঞ্চনস্নিগ্ধ অধিকারী ৷ তাঁর মোট প্রাপ্ত নম্বর 738 ৷ দ্বিতীয় পূর্ব বর্ধমানের বিল্টু মাজি ৷ তাঁর প্রাপ্ত নম্বর 680 ৷
বৃহস্পতিবার ইউপিএসসি-র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভিস (আইএসএস) পরীক্ষার ফলপ্রকাশ হয়েছে ৷ তাতে প্রথম হয়েছেন বছর সাতাশের সিঞ্চনস্নিগ্ধ । আসানসোলের ইসমাইলের বাসিন্দা তিনি । আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনের কৃতী ছাত্র ছিলেন সিঞ্চন । একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে সিঞ্চনের এই সাফল্য ।
তাঁর সাফল্যে খুশি পরিবার, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ ও সমগ্র আসানসোল শহর । অদম্য অধ্যাবসায় থেকেই এই সাফল্য এসেছে বলে জানিয়েছেন সিঞ্চন ।
ইটিভি ভারতের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিলেন এই কৃতী ছাত্র ৷ তিনি বলেন, "যখন রেজাল্ট বেরিয়েছে, তখন দাবা খেলায় ডি গুকেশের বিশ্বজয়ের খবর নিয়ে মেতে ছিলাম ৷ বন্ধুদের কাছ থেকে ফোনে ইউপিএসসি-র আইএসএস পরীক্ষায় নিজের ফলের কথা জানতে পারি ৷ তখন দুটো আনন্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ৷"
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আসানসোল শহরের ইসমাইলে মাদার টেরেজা সরণিতে খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা সিঞ্চনের । তাঁর বাবা প্রদীপ অধিকারী আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেলথের কর্মী । বহুবছর মাইন্স বোর্ড অফ হেলথের অবস্থাও ভালো নয় । সেই কারণে খুব সচ্ছল পরিবারে বড় হননি সিঞ্চন । মা সুজাতা অধিকারী গৃহবধূ । ছোট থেকে আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনেই পড়াশুনো করেছেন সিঞ্চন স্নিগ্ধ অধিকারী । পরবর্তীকালে কলকাতার আইএসআই থেকে স্ট্যাটিস্টিক্সের উপর মাস্টার্স করেন তিনি ।
মেডিক্যালে 168 র্যাংক করেছিলেন সিঞ্চন । ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও র্যাংক করেছিলেন সপ্তম । কিন্তু সিঞ্চনের ইচ্ছে ছিল স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে পড়ার । তাই প্রথমে বি স্ট্যাট ও পরে এম স্ট্যাট করেছেন এই কৃতী ছাত্র । ইচ্ছে ছিল আইএএস হওয়া । প্রথম ইউপিএসসি-তে সফলতা আসেনি । আর তার পরেই পাখির চোখ করে কঠিন অধ্যাবসায় শুরু করেন সিঞ্চনস্নিগ্ধ অধিকারী । এবার তাক লাগানো রেজাল্ট তাঁর । গোটা দেশকে চমকে দিয়ে প্রথম হয়েছেন আসানসোলের সিঞ্চনস্নিগ্ধ অধিকারী ।
বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি ৷ সেই নিয়ে আগামী প্রজন্মকে সিঞ্চনস্নিগ্ধর বার্তা, "সত্যেন বসু মশাই বলে গিয়েছেন, যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয় না, তারা হয়তো বাংলা বোঝেন না, নয়তো বিজ্ঞান বোঝেন না ৷ সেই কথাটাই সবসময় সত্যি ৷ তবে দুর্ভাগ্যবশত দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে এখন বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার মান আগের তুলনায় কমে গিয়েছে ৷ যদি তাকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা যায়, অবশ্যই বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারা আবার ভালো ফল করবে ৷"
তবে নিজের সাফল্যের পুরো কৃতিত্বটাই সিঞ্চন দিতে চান বাবা-মাকে । বাবা প্রদীপ অধিকারীর কথায়, "ইউপিএসসি-তে পাশ করা সিঞ্চনের স্বপ্ন ছিল । কিন্তু এভাবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করবে, তা ভাবিনি । খুব ভালো লাগছে । শুধু পরীক্ষায় প্রথম নয়, প্রশাসক হিসাবেও যেন এক নম্বর হয়, এটাই চাইব ।" মা সুজাতা অধিকারী বলেন, "ছেলের সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত । খুব ভালো লাগছে ওঁর পরিশ্রম সার্থক হল ।"
অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন সিঞ্চন। হ্যারি পটারের বই পড়তে ভালোবাসেন । এছাড়া সিনেমা দেখতেও ভালোবাসেন সিঞ্চন । তবে মাত্র 4 বছর আগে ফেসবুকে এলেও সোশাল মিডিয়ায় অতটা উৎসাহী নয় বলেই জানিয়েছেন সিঞ্চন । ইউপিএসসিতে প্রথম হয়ে সিঞ্চনস্নিগ্ধ অধিকারীর স্বপ্ন এখন দেশের এক নম্বর প্রশাসক হওয়া ।
আইএসএস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারীও বাংলার
ইউপিএসসি-র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন পূর্ব বর্ধমানের বিল্টু মাজি । তাঁর প্রাপ্ত নম্বর 680 ৷ তাঁর বাড়ি আউশগ্রাম -2 ব্লকের রামনগর পঞ্চায়েতের পান্ডুক গ্রামে । বিল্টুর মতে, কোনও বিষয়ে সাফল্য না এলে হাল ছাড়া যাবে না । তাহলেই মিলবে সাফল্য ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিল্টু মাজি গ্রামের দীননাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন । পরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পরে স্ট্যাটিস্টিক্সে অনার্স পাশ করেন । এরপর ইন্ডিয়া পোস্টে চাকরি পান । বীরভূম জেলার রূপপুর গ্রামীণ পোস্ট অফিসে পোস্ট মাস্টার হিসেবে যোগ দেন ।
বিল্টু মাজির বাবা জয়দেব মাজি । তাঁদের বিঘা দুয়েক জমি আছে । সেই জমিতে চাষ আবাদ করেই সংসার চলে । মা সুমিত্রা কাঁথাস্টিচের কাজ করেন । সংসারে অভাব থাকায় ইউপিএসসি-র জন্য বিল্টু মাজিকে কোনও কোচিং দিতে পারেনি তাঁর পরিবার । তবে মনের জেদকে সম্বল করে শুরু হয় বিল্টুর লড়াই ।
তিনবারে সাফল্য ইউপিএসসিতে
প্রথম বছর ইউপিএসসিতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ইন্টারভিউতে কাট অফ থেকে 16 নম্বর কম থাকায় সফল হতে পারেননি । দ্বিতীয়বার ফের পরীক্ষায় বসেন তিনি । কিন্তু দু'নম্বরের জন্য লিখিত পরীক্ষায় সফল হননি বিল্টু । পরপর দু’বার সাফল্য না আসায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি । কিন্তু তাঁর মা ছেলের মনোবল ফেরাতে তাঁকে উৎসাহ দিতে থাকেন । তৃতীয়বার পরীক্ষা দিতেই আসে সাফল্য । দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন বিল্টু মাজি । তাঁর বাবা জয়দেব মাজি বলেন, "ইউপিএসসি পরীক্ষা সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই । ছেলে পরীক্ষায় পাশ করার পরে বুঝতে পেরেছি ও একটা চাকরি পাবে ।"
দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পরে বিল্টু মাজি বলেন, "ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভিস (আইএসএস) পরীক্ষায় অল ইন্ডিয়ায় দ্বিতীয় হয়েছি । এটা আমার দীর্ঘ চার বছরের যাত্রাপথ । আমার বাবা একজন খেতমজুর । আমাদের খুব বেশি জমি নেই । এটাই আমাদের একমাত্র আয়ের সম্বল ছিল । প্রথমবার যখন আইএসএস পরীক্ষা দিই সেই বছর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ইন্টারভিউতে পাশ করতে পারিনি । ইন্টারভিউতে জেনারেল ক্যাটাগরিতে কাট অফ থেকে 16 নম্বর কম আসে । দ্বিতীয়বারে লিখিত পরীক্ষায় দু'নম্বরের জন্য উত্তীর্ণ হতে পারিনি ।
তাঁর কথায়, "পরপর দুবার পাশ করতে না পারায় প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম । তাই আর পড়ায় মন বসছিল না । কিন্তু আমার মা মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করে । আমি তখন অন্যান্য চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করি । কিন্তু মাথায় ইউপিএসসি ঢুকে থাকায় নতুন করে মায়ের উৎসাহে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি । তাই ফের তৃতীয়বার পরীক্ষায় বসি । দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি । তবে আমি গ্র্যাজুয়েশন করার পরে ইন্ডিয়ার পোস্টে চাকরি পাই । একটা গ্রামীণ পোস্ট অফিসে পোস্ট মাস্টার হিসেবে যোগ দিই । তবে ভবিষ্যতে মাস্টার্স করে নেট ও গেট-এ উত্তীর্ণ হতে চাই ।"