মালদা, 19 অক্টোবর: ভয়াল গঙ্গা ভাঙনে পড়েছে মানিকচকের গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনটি গ্রাম ৷ শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তীব্র ভাঙন চলছে শনিবারও ৷ ত্রাহি রব উঠেছে গোটা এলাকায় ৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে সেচ দফতর ৷
তবে সেই কাজ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে গোটা এলাকায় ৷ দুর্গতদের দাবি, তাঁরা এই কাজ চান না ৷ হয় স্থায়ী ভাঙন রোধের কাজ করা হোক, নয়তো তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক ৷ গ্রামবাসীদের আশঙ্কা, যে তীব্রতায় ভাঙন হচ্ছে, তাতে এবারই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে তিনটি গ্রাম ৷
কয়েকদিন ধরেই গোপালপুরের কামালতিপুরে গঙ্গা ভাঙন শুরু হয়েছে ৷ প্রথমে অল্পবিস্তর ভাঙন হলেও দুর্গাপুজোর পর থেকে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে ৷ কিন্তু গতকাল থেকে যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সবাই ৷ শুধু কামালতিপুর নয়, গতকাল থেকে গঙ্গার ছোবল পড়েছে সহবতটোলা ও ঈশ্বরটোলা গ্রামেও ৷ সবার চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা বহু ফসলি কৃষিজমি ৷
পাথর দিয়ে বাঁধানো পুরোনো বাঁধের কিছু অংশও নদীতে তলিয়ে গিয়েছে ৷ অবস্থা বেগতিক দেখে শুরু হয়ে গিয়েছে বাড়িঘর সরানোর পালা ৷ নিশ্চিন্ত আশ্রয় ভেঙে ঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে কাছাকাছি আমবাগানে ঠাঁই নিয়েছে অনেক মানুষ ৷ ভাঙন তীব্র হওয়ার খবর পেয়ে নদীপাড়ে ভিড় জমাচ্ছে বহু মানুষ ৷
গতকাল ভাঙন দেখতে গিয়ে দুই যুবক ভাঙা পাড়ের সঙ্গে গঙ্গায় পড়ে যান ৷ অবশ্য স্থানীয় মানুষজন তৎপরতার সঙ্গে তাঁদের জল থেকে উদ্ধার করেন ৷ এই পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা রোধে মানিকচক থানার পুলিশের তরফে নদীপাড়ে মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে ৷ কেউ যাতে ভাঙনের সময় নদীর কাছাকাছি না থাকেন, তার জন্য আবেদন জানাচ্ছে পুলিশ ৷
ভাঙনে আশ্রয় সরিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন বানো বিবি ৷ তিনি বলেন, “নদী যে পাড় কাটছে, সরকার কি দেখতে পাচ্ছে না ? বারবার মোবাইলে প্রশাসনকে খবর দেওয়া হচ্ছে ৷ আমাদের কথা কি কারও বিশ্বাস হচ্ছে না ? নিজেদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছি ৷ অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি ৷ সরকারি কোনও জায়গাও পাচ্ছি না যে সেখানে বাচ্চা নিয়ে থাকব ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘খাবার নেই, আলো নেই, মশার কামড়ে টেকা যাচ্ছে না ৷ তার মধ্যেই কোনোরকমে থাকতে হচ্ছে ৷ সরকার কি কিছুই বোঝে না ? আমাদের জন্য একটা কলোনি করে দিলেই সমস্যা মিটে যায় ৷ সরকারের উপর ভরসা করে আছি ৷ কিন্তু সরকার কিছু করে না ৷ আমাদের শুধু একটু থাকার জায়গা করে দিলেই সমস্যা মিটে যায় ৷ আজ নদীর কাটান ভয়াবহ আকার নিয়েছে ৷ কী জানি কী হয় !”
আরেক ভাঙন দুর্গত তানজিনা খাতুন বলেন, “নদী পাড় কাটতে কাটতে ঘরের দুয়ারে ৷ ভয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছি ৷ গ্রামের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে ৷ এটাই সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ মশার কামড়ে ঘুমোনো যায় না ৷ ঘরের সব জিনিসপত্র রাস্তার ধারে রেখেছি ৷ বৃষ্টিতে সব ভিজছে ৷ পেটে খাবার নেই ৷ মাথা গোঁজার ঘরও নেই ৷ আমাদের ঘর করার মতো একটু জায়গা দেওয়া হোক ৷”
রাস্তার ধারে ত্রিপলের নীচে বসে কামালতিপুরের ইসরাউল মোমিন বলে ওঠেন, “আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ ৷ বাড়িঘর ভেঙে অন্যের জায়গায় ফেলে রেখেছি ৷ জমির মালিক আমাদের থাকতে দিতে চাইছেন না ৷ আজ অতিরিক্ত ভাঙন হচ্ছে ৷ সরকার হয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করুক, নয় তো আমাদের একটা করে পাকা বাড়ি বানিয়ে দিক ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখন আমাদের অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে ৷ সরকার সব জায়গায় সাহায্য করছে ৷ আমাদের করছে না কেন ? এক মুঠো করে খাবার দিলেই কি আমাদের দিন চলে যাবে ? জামা-কাপড়, বিছানা সবই নদীতে চলে গিয়েছে ৷ সরকার কি আমাদের দিকে একবার তাকাবে না ?”
জেলা সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শিবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভূতনিতে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের কাজ করা হচ্ছে ৷ ড্রোন উড়িয়ে ভাঙন পরিস্থিতির নজরদারি চলছে ৷ এই মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৷”