বক্রেশ্বর, 8 অগস্ট: শুধুমাত্র সরকারি গাফিলতিতে আমাদের দেশে হিলিয়াম উত্তোলন হয় না ৷ হিলিয়ামে আমদানির জন্য আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভারতকে ৷ অথচ এই রাজ্যের বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণে বিপুল পরিমাণ হিলিয়ামের ভাণ্ডার রয়েছে ৷ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় হিলিয়াম উত্তোলনের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পায় । পরে তা বন্ধও হয়ে যায় ৷
পরবর্তীতে বিজ্ঞানী হীরক চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে 2016 সাল পর্যন্ত বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম উত্তোলিত হয়েছে । বর্তমানে সে সবই বন্ধ, নেই সরকারি বরাদ্দ, জঙ্গল ও শ্যাওলাতে ঢেকেছে সমস্ত যন্ত্রাংশ । অথচ, এই বক্রেশ্বর থেকেই বছরে 250 কোটি টাকার হিলিয়ামের ব্যবসা সম্ভব । স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়গুলি নিয়ে আক্ষেপ বিজ্ঞানী হীরকবাবুর ৷ দুর্গাপুর এনআইটির অধ্যাপক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী হীরক চৌধুরী । তিনি ব্রিকসে ভারতীয় সদস্য । হিলিয়াম নিয়ে আজও নিরলস গবেষণা করে চলেছেন তিনি । ইটিভি ভারতকে তিনি জানান তাঁর গবেষণার কথা ও আক্ষেপ ।
উল্লেখ্য, ভারতে প্রায় 340টি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে । তার মধ্যে 50 শতাংশ উষ্ণ প্রস্রবণে হিলিয়াম মজুত আছে ৷ ভারতের রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, অসম, অরুণাচল প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও মধ্যপ্রদেশের উষ্ণ প্রস্রবণে প্রচুর পরিমাণ হিলিয়ামের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে । এছাড়া, অন্ধপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার উষ্ণ প্রস্রবণে হিলিয়াম থাকলেও পরিমাণ ও গুণগত মান কম ৷
এই রাজ্যের বীরভূমের বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণে বিপুল পরিমাণ হিলিয়ামের ভাণ্ডার আছে ৷ বিজ্ঞানী হীরকবাবুর আক্ষেপ, এত হিলিয়াম থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সরকারি উদাসীনতার জন্য ভারতবর্ষে হিলিয়াম উত্তোলিত হয় না । হিলিয়ামের জন্য ভারতকে 100 শতাংশ ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভর করতে হয় ৷ প্রতিবছর ভারতে কমপক্ষে 15 থেকে 20 হাজার কোটি টাকার হিলিয়ামের ব্যবসা হয় ৷
হিলিয়াম গ্যাস কী ?
হিলিয়াম হল একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন নিষ্ক্রিয় গ্যাস ৷ পৃথিবীতে সবচেয়ে হালকা গ্যাস হল হাইড্রোজেন গ্যাস । তারপরেই দ্বিতীয় হালকা গ্যাস হল হিলিয়াম ৷ এই হিলিয়াম দাহ্য গ্যাস নয় ৷ 1868 সালে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের জনসন ভারতে সূর্যরশ্মি থেকে হিলিয়াম গ্যাস আবিষ্কার করেন ৷ পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম র্যামজে খনিজ পদার্থ থেকে হিলিয়াম গ্যাস আবিষ্কার করেন ৷
কী কী কাজে লাগে হিলিয়াম গ্যাস ?
মহাকাশ গবেষণায় হিলিয়াম লাগে ৷ যেমন, ইসরো থেকে মহাকাশ যান পাঠাতে হিলিয়াম গ্যাসের প্রয়োজন হয়, রকেট ফুয়েলের জন্য প্রয়োজন হয়, নিউক্লিয়ার পাওয়ার পয়েন্ট, মেডিক্যাল সায়েন্সে এমআরআই মেশিন চালানোর ক্ষেত্রে, সমুদ্রের নীচে ডুবুরিদের শ্বাস চালানো জন্য হিলিয়াম লাগে ৷ যাত্রীবাহী বেলুন ওড়াতে অনেক সময় হিলিয়াম ব্যবহার করা হয় ৷ এছাড়া, বিভিন্ন গবেষণাগারে গবেষণার জন্য হিলিয়াম লাগে ৷
কোথায় কীভাবে পাওয়া যায় হিলিয়াম গ্যাস ?
আমেরিকা, রাশিয়া, পোল্যান্ড, কাতার প্রভৃতি দেশে বিপুল পরিমাণ হিলিয়াম গ্যাস উত্তোলিত হয় ৷ তবে এই দেশগুলিতে হিলিয়াম প্রাকৃতিক গ্যাস বা পেট্রোলিয়াম গ্যাস থেকে পাওয়া যায় ৷ 4 থেকে 7 শতাংশ হিলিয়াম আছে এই দেশগুলিতে ৷ ভারতে প্রাকৃতিক গ্যাস বা পেট্রোলিয়াম গ্যাস থেকে হিলিয়াম উত্তোলন সম্ভব নয় ৷ কারণ, ভারতে এই গ্যাসে মাত্র 0.05 শতাংশ হিলিয়াম আছে ৷ তবে ভারতে উষ্ণ প্রস্রবণগুলিতে বিপুল পরিমাণ হিলিয়ামের ভাণ্ডার আছে । এই প্রস্রবণগুলিতে উপরেই 2 থেকে 3 শতাংশ হিলিয়াম আছে ৷ বোর হোল করে গভীরে গেলে 4 শতাংশ পর্যন্ত হিলিয়াম বক্রেশ্বরেই মিলবে ৷
বীরভূমের বক্রেশ্বর হিলিয়ামের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ?
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে ও তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে বীরভূমের বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম গ্যাস উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ৷ 1960 সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের তত্ত্বাবধানে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় । পরে এই কাজটি হাতে নেয় ডিপার্টমেন্ট অফ এটোমিক এনার্জি ।
যদিও, পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায় ৷ পরে 2005 সাল থেকে বক্রেশ্বরের হিলিয়াম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বিজ্ঞানী হীরক চৌধুরী ৷ তাঁর উদ্যোগে 2012 সাল থেকে শুরু হয় বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম উত্তোলন । চলে 2016 সাল পর্যন্ত । বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণে উপরেই উঠে আসে 2 শতাংশ হিলিয়াম । মাত্র 1 কিলোমিটার বোর হোল করলেই মিলবে 4 শতাংশ হিলিয়াম ।
এই বোর হোল করতে মাত্র 50 লক্ষ টাকা খরচ ৷ আর একটি বোর হোল করলে শুধুমাত্র যে হিলিয়াম গ্যাস উত্তোলিত হবে তা নয় । এর পাশাপাশি জিও থার্মাল পাওয়ার পাওয়া যাবে ৷ অর্থাৎ, মাটির তলার তাপকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ৷ যা ভারতে আগে কখনও হয়নি ৷ এই বক্রেশ্বর থেকে হিলিয়াম গ্যাস উত্তোলন হল, তার বাজার মূল্য কমপক্ষে বছর 250 কোটি টাকা ।
বর্তমানে বক্রেশ্বরে হিলিয়াম উত্তোলন বন্ধ কেন ?
2016 সালের শেষের দিকে বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায় ৷ বিজ্ঞানী হীরক চৌধুরী জানান, বোর হোল করার জন্য আর্থিক বরাদ্দ পেতে ভারত সরকারের খাদান মন্ত্রক, বিজ্ঞান মন্ত্রকে চিঠি দিয়েছেন ৷ কিন্তু মেলেনি মাত্র 50 লক্ষ টাকার বরাদ্দ ৷ এই মুহূর্তে হিলিয়াম উত্তোলনের যন্ত্রাংশ, বড় বড় ট্যাঙ্ক, অফিস ঘর সব কিছুই জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে, শ্যাওলা ধরেছে ৷
উল্লেখ্য, হিলিয়াম উত্তোলনের পর পরিশোধন করতে হয় ৷ হিলিয়ামকে 99.995 শতাংশ পরিশোধন না করলে, তা ব্যবহার করা যায় না ৷ সেই পরিশোধনের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি পরিকাঠামো আছে ৷ এত কিছু সত্ত্বেও ভারতবর্ষকে হিলিয়ামের জন্য আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ৷
ইটিভি ভারতকে বিজ্ঞানী হীরক চৌধুরী বলেন, "ভারতবর্ষের অন্যান্য উষ্ণ প্রস্রবণগুলির পাশাপাশি বীরভূমের বক্রেশ্বরেও বিপুল পরিমাণ হিলিয়াম আছে ৷ বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম ৷ কিন্তু, সরকারের কোনও হেলদোল নেই ৷ একটা বোর হোল করার জন্য বরাদ্দ পর্যন্ত করে না ৷ সরকারি উদাসীনতার জন্য, গাফিলতির জন্য হিলিয়ামের জন্য আমরা আমেরিকার উপর নির্ভরশীল ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘অথচ, দেশীয় প্রযুক্তিতে কত কী করা যায় । হিলিয়াম উত্তোলন-সহ মাটির নীচের তাপ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ৷ এগুলো নিয়ে ভাবার লোক সরকারে নেই ৷ এত বড়মাপের বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না ৷ এটাই আমার আক্ষেপ৷ দেখা যাক, ভবিষ্যতে যদি কোনও বেসরকারি সংস্থাকে ধরে বরাদ্দ করিয়ে এই কাজ ফের শুরু করতে পারি ৷"