কামারহাটি, 18 জুলাই: 'জয়ন্ত' সিং ওরফে 'জায়ান্ট'! বহুচর্চিত এই নামটিই এখন আড়িয়াদহে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু । ক্লাবে মা ও ছেলেকে গণপিটুনির ভিডিয়ো ভাইরাল হতেই উঠে এসেছিল এই নাম ৷ তার পর থেকে সামনে আসছে একের পর এক তথ্য ৷ ঠিক যেন 'ওয়েব সিরিজ'-এর গল্প ৷ এই 'জয়ন্ত'-কে রাতারাতি 'জায়ান্ট' তৈরি করল কারা ? কীসের স্বার্থে তার অপরাধমূলক কার্যকলাপ-কে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল ? কাদের প্রশয়ে সে আড়িয়াদহের 'ত্রাস' হয়ে উ উঠেছিল জয়ন্ত ৷ এ সবই এখন চার্চার বিষয় ৷
স্থানীয় সূত্রে খবর, একসময় রকের 'মস্তান' ছিলেন জয়ন্ত সিং। যাঁর কাজ ছিল শুধু 'দাদাগিরি' করা। সেই সুযোগ কাজ লাগিয়ে এলাকার কিছু অসাধু প্রমোটার তাঁকে ব্যবহার করতেন নিজেদের স্বার্থে। এর জন্য মোটা টাকার কমিশনও পেত সে। সেটা অবশ্য 2009-10 সালের কথা ! বাম আমলে ছোটখাটো অপরাধ দিয়েই চলছিল জয়ন্ত'র দিনযাপন। এরপর রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসতেই ধীরে ধীরে এলাকায় তাঁর প্রভাব বাড়তে শুরু করে বলে অভিযোগ।
প্রথমে ইমারতি ব্যবসা। সেই সূত্র ধরে জয়ন্ত'র প্রমোটিং ব্যবসায় হাত পাকানো। কিছুই বাদ যায়নি। গোড়ার দিকে পারিবারিক দুধের ব্যবসাও দেখভাল করলেও, বেশিদিন মন টেকেনি সেখানে । তাই নতুন দিশার খোঁজে পথ বদলেছেন। বিভিন্ন ক্লাবের মাথা হয়ে ওঠেন জয়ন্ত। যে সব ক্লাব সংগঠনে নিজের বাহিনী তৈরি করেন ‘জায়ান্ট’, তাঁর নিউক্লিয়াস ছিল আড়িয়াদহের তালতলা ক্লাব। যেখানকার নির্মম অত্যাচারের ভিডিয়ো ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে এলাকায়।
2016 সালের ঠিক পরপরই কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের নজরে পড়ে যান জয়ন্ত সিং। অভিযোগ,এরপর থেকেই দু'জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তা যে কতটা গভীরতা তার প্রমাণ মেলে জয়ন্ত'র সঙ্গে মদন ও তাঁর পরিবারের একাধিক ছবি থেকেই। ইতিমধ্যে সেই সমস্ত ছবিও এসেছে জনসমক্ষে। মদনের বল-ভরসাতেই তাঁর ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠা। যদিও জয়ন্ত'র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা আগেই অস্বীকার করেছেন কামারহাটির এই গ্লামারস বিধায়ক। মদন বলেন, "তাঁর সঙ্গে ছবি রয়েছে, মানেই ঘনিষ্ঠতা ছিল তা প্রমাণিত হয় না।" বরং জয়ন্তকে ‘গুন্ডা’ বলে অ্যাখা দিয়েছেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক।
জানা গিয়েছে, চার দশক বিহার আগে কামারহাটিতে চলে আসেন জয়ন্তর বাবা। থাকতে শুরু করেন আড়িয়াদহের মৌসুমী মোড়ে। জয়ন্তর পৈতৃক বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে তাদের খাটাল। মূল ব্যবসা ছিল দুধের। সে ব্যবসা ছেড়ে শুরু করেন ইট, বালি, সিমেন্ট, চুন, সুরকির সিন্ডিকেট। পুকুর বুজিয়ে বহুতল তৈরির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে । জয়ন্তের এক ভাই কলকাতা ফুটবলের নামী খেলোয়াড়। তিনি ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান স্পোর্টিংয়েও খেলেছেন। মদনের দাবি, তিনি ক্রীড়ামন্ত্রী থাকাকালীন জয়ন্তের ভাইয়ের কথায় তালতলা ক্লাবের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবশ্য অভিযোগ, মদন মিত্রের পুত্রবধূ মেঘনা মিত্র কামারহাটির 16 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেখানেও জয়ন্তের অবাধ যাতায়াত ছিল।'
স্থানীয় সূত্রে খবর, কামারহাটির এক কাউন্সিলরকে দমাতেই ‘তৈরি’ করা হয়েছিল জয়ন্তকে। ওই কাউন্সিলর বিধায়ক মদন মিত্রের বিরোধী হিসেবেই পরিচিত এলাকায়। বিরোধীদের দাবি, 'শাসকদল এবং পুলিশের একাংশের আশীর্বাদের হাত রয়েছে জয়ন্তের মাথায়। তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন দাপুটে।' বিজেপির রাজ্য নেতা রাজু বন্দোপাধ্যায় অবশ্য জয়ন্ত'র বাড়বাড়ন্তের জন্য তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন।
কেমন দাপট? শুধুই কি লোককে মারধর ? শুধুই কি দাদাগিরি ? শুধুই কি নির্মাণের কাঁচা টাকা ? জানা গিয়েছে, ব্যারাকপুর থেকে ডানলপ পর্যন্ত বিটি রোডের ধারের সমস্ত পানশালায় ছিল জয়ন্তের নামে ‘রিজার্ভ’ চেয়ার। চলত ফুর্তির ফোয়ারা। তবে টাকাপয়সা চাইলেই শুরু হত বচসা। বেরিয়ে পড়ত নাইন এমএম, একনলা। বিভিন্ন পানশালায় একাধিক গন্ডগোলের ঘটনাতেও জয়ন্তের নাম জড়িয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। জয়ন্ত ও তার গ্যাংয়ের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ আড়িয়াদহবাসী। এদিকে তৃণমূলের একাংশের আশকারাতেই 'জয়ন্ত' যে 'জায়ান্ট' হয়েছেন তা কার্যত মেনে নিয়েছেন দলেরই প্রাক্তন কাউন্সিলর দেবাশিস মহাপাত্র ।