সোদপুর, 20 জানুয়ারি: আরজি কর মামলায় দোষী সাব্যস্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিয়ালদা আদালত ৷ তবে তাঁরা ক্ষতিপূরণ নয়, বিচার চান - স্পষ্ট জানিয়ে দিলের নির্যাতিতার বাবা-মা ৷ এদিনের আদেশে সন্তুষ্ট নন নির্যাতিতা ছাত্রীর প্রতিবেশীরাও । আদালতের রায়ে তাঁরা হতাশ ।
এদিন সাজা ঘোষণার সময় বিচারক অনির্বাণ দাস বলেন, "দোষীর যাবজ্জীবন (আমৃত্যু) কারাদণ্ড ছাড়াও তাকে 50 হাজার টাকা জরিমানাও করা হল । সবমিলিয়ে 17 লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রকে । জরিমানার 50 হাজার টাকা না-দিলে পাঁচ মাস অতিরিক্ত কারাবাসের নির্দেশ ।" এছাড়াও বিচারক বলেন, "রাষ্ট্রের দায়িত্ব, নির্যাতিতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার । এই মৃত্যুতে টাকা দিয়ে কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না । কিন্তু আইন বিধি মেনে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় ৷" তবে সাজা ঘোষণার পরই অসন্তোষের সুরে নির্যাতিতার বাবা-মা জানিয়ে দেন যে, তাঁরা ক্ষতিপূরণ চান না ৷ চান বিচার ৷
আরজি করে নিহত চিকিৎসক ছাত্রীর পড়শিরাও এই সাজায় অখুশি ৷ তাঁরা মনে করছেন, সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল । তা হলেই একমাত্র ন্যায় বিচার পেত নির্যাতিতার পরিবার । তাঁরা সঞ্জয়ের এই সাজার পিছনে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের গাফিলতিকেই দায়ী করেছেন । ন্যায় বিচারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনে নামার তোড়জোড় শুরু করছেন নিহত চিকিৎসক ছাত্রীর প্রতিবেশীরা ।
গত 9 আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয় । অভিযোগ ওঠে তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করার ।সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় । ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে নাগরিক সমাজ । নিহত চিকিৎসক ছাত্রীর বাড়ি যেখানে, সেই সোদপুরেও শুরু হয় প্রতিবাদ, আন্দোলন । এখান থেকেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের সর্বত্র । সুবিচারের দাবিতে চলে রাত দখল, পথে নেমে হয় একের পর এক প্রতিবাদী আন্দোলন, যা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে ।
প্রতিবাদী নাগরিক সমাজ ও জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে বারবার ছুটে গিয়েছেন নির্যাতিতা ছাত্রীর বাবা-মাও । শুধু তাই নয়, মেয়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এবং দোষীদের শাস্তি চেয়ে গত বছরের দুর্গাপুজোয় বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে ধরনা-অবস্থানেও বসতে দেখা গিয়েছিল আরজি করে নিহত চিকিৎসক ছাত্রীর বাবা-মাকে ।
সেই যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তা আজও বজায় রেখেছে নির্যাতিতা ছাত্রীর পরিবার । বারবার তারা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, যতদিন না মেয়ের মৃত্যুর সুবিচার মিলবে, ততদিন তাঁরা এই লড়াই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন । কিন্তু,তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, এত আন্দোলন, প্রতিবাদের পরেও আদেও কী সঞ্জয় রায়ের শাস্তি ঘোষণায় সুবিচার পেলেন নির্যাতিতা ছাত্রীর পরিবার ও প্রতিবাদীরা ? একবাক্যে সকলে উত্তর দিচ্ছেন 'না' ! এই সাজা প্রতিবাদী কাউকেই খুশি করতে পারেনি বলে তাঁরা নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছেন ।
এদিকে, আদালতের এদিনের রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই নির্যাতিতার এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ছড়িয়েছে । তাঁরা মনে করছেন, আরজি করে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় একা জড়িত নন । নেপথ্যে আরও মাথা রয়েছে । সঞ্জয়কেও সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁরা ৷
এই বিষয়ে এলাকারই এক বাসিন্দা বলেন, "আরজি করের মতো সরকারি একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মধ্যে একজন জুনিয়র চিকিৎসক ধর্ষিতা ও খুন হয়ে গেলেন । অথচ অভিযুক্তের চরম সাজা হল না । আমরা ফাঁসি চেয়েছিলাম । কিন্তু, আদালত দোষীকে শুধু আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে । তাহলে সিবিআই কী তদন্ত করল ? আমরা ন্যায় বিচারের দাবিতে প্রথম থেকেই পথে ছিলাম । প্রয়োজন হলে আবারও পথে নামব ।"
নির্যাতিতার আরেক প্রতিবেশী বলেন, "আদালতের এই রায়ে মোটেই আমরা খুশি নই । নির্যাতিতা পরিবারের মতো আমরাও চেয়েছিলাম, সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি হোক । কিন্তু তা না হওয়ায় আমরা হতাশ । একা সঞ্জয়ের পক্ষে এতবড় অপরাধ করা সম্ভব নয় । এর পিছনে আরও কেউ যুক্ত রয়েছে ।"
একই সুর শোনা গিয়েছে নির্যাতিতা ছাত্রীর আরেক প্রতিবেশীর গলাতেও । তাঁর কথায়, "সিবিআই তদন্তে আমরা মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারছি না । যেদিন প্রত্যেক দোষীকে ধরে সাজা দেওয়া যাবে সেদিনই আমরা খুশি হতে পারব । এই ঘটনা একা সঞ্জয় রায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল । আমরা তো বরাবর চেয়ে এসেছি, এর আড়ালে যারা রয়েছে, তাদেরকেও সামনে আনা হোক । কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই দেখতে পেলাম না । ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি, প্রয়োজনে আবার আন্দোলন শুরু করব ৷"