শ্রীরামপুর, 6 জুলাই: পুরীর মতো হুগলির মাহেশে ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন ৷ মাহেশে দেব-দেবীদের এই রথ একশো বছরেরও বেশি প্রাচীন ৷ একসময় কাঠে রথে চড়েই তাঁরা যাত্রা করতেন ৷ তবে প্রতিবছর সেই রথ কোনও না কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যেত ৷ তাই মাহেশে জগন্নাথ, বলরাম ও দেবী সুভদ্রার জন্য বিশেষ লোহার রথ তৈরি করে দেন তৎকালীন হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু ৷ রইল সেই রথের ইতিহাস ৷
মাহেশের এই রথ নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত পিয়াল অধিকারী বলেন, "আমাদের পূর্বপুরুষ কমলাকার পিপলাইয়ের আমলে বৈদ্যবাটি নিবাসী এক মোদক পরিবার কাঠের রথ বানিয়ে দিয়েছিল ৷ এরপর আরও চারটি কাঠের রথ তৈরি হয়েছিল ৷ কিন্তু কাঠের রথগুলি আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যেত ৷ আর নয়তো রথ তৈরি হওয়ার সময় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আত্মহত্যা করতেন ৷ এতে স্বর্গ লাভ হবে ভেবে ৷ এই ভাবনা থেকেই তাঁরা এই কাজ করতেন ৷ এদিকে তখনকার দিনে তো রথের কাঠ শোধন করা যেত না ৷ সুতরাং নতুন করে ফের কাঠের রথ তৈরি করতে হত ৷ সেটা ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল ৷"
মাহেশের এই বর্তমান রথটি তৈরি হয়েছিল আজ থেকে 138 বছর আগে ৷ হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু, যাঁর পরিবার এখন শ্যামবাজার বসু পরিবার নামে পরিচিত, তিনি মাহেশের এই রথটি তৈরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, জানালেন সেবাইত পিয়াল ৷
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, "অতীতে মাহেশ থেকে কাঠের রথ যেত বৈদ্যবাটির চাতরাতে ৷ ওড়িশার পুরীর অনুকরণে রথ তৈরি হত ৷ আগে মাহেশে মাসির বাড়িতে হোগলা পাতার ছাউনি করে ছ'দিন ধরে জগন্নাথ মহাপ্রভুর পুজো হত ৷ বর্তমানে যেখানে মাসির বাড়ি রয়েছে, তাকে কুঞ্জবাটি বলা হয় ৷ আজও রথের দিন আমাদের হরি হরি বোল বলার সঙ্গে সঙ্গে রথ টানের প্রস্তুতি শুরু হয় ৷ বসু পরিবারের তরফে আজও রথের উপর দুই দিকে হুইসেল বাজানোর লোক থাকে ৷" মাহেশের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা শুরুর আগে পুলিশের তরফেও রথের দু'দিকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করা হয় ৷ তারপরই হয় রথের টান, জানালেন মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত ৷
জানা যায়, 1885 সালে মার্টিন বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে এই রথ তৈরি করা হয় ৷ তবে কালের নিয়মে রোদ, ঝড়, জলে এই রথও জীর্ণ, ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল ৷ তাই প্রতিবছর রথ মেরামতির জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন ৷ এই অবস্থায় প্রায় 42 বছর ধরে বিশ্বাস পরিবারকে এই রথ মেরামতির দায়িত্ব দিয়ে আসছে শ্যামবাজারের বসু পরিবার ৷
মাহেশের রথের কেয়ারটেকার বিশ্বাস পরিবারের রাজু বিশ্বাস ও তাঁর ভাই ৷ তাঁরা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন ৷ তিন পুরুষ ধরে এখনও রথের লোহার চাকা থেকে কাঠের পাটাতন-সহ গোটা রথের রঙ থেকে নানাবিধ কাজ করেন তাঁরা ৷ রথের একমাস আগে থেকেই চলে এই রথ সারাইয়ের কাজকর্ম ৷ 25 জন কর্মী রথ মেরামতি ও তাকে নতুন করে সাজানোর কাজে লেগে পড়েন ৷ প্রতিবছর মাহেশের রথ সংস্কারের নির্দেশ বিশ্বাস পরিবারকে দেয় শ্যামবাজারের বসু পরিবার ৷
বসুপরিবারের তত্ত্বাবধানে এই পরিবার বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে চলেছেন ৷ 1885 সালে শ্যামবাজারের কৃষ্ণচন্দ্র বসু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তখন এর জন্য খরচ হয়েছিল 20 লক্ষ টাকা ৷ মাহেশের রথের উচ্চতা 50 ফুট ৷ 12টি লোহার চাকা রয়েছে ৷ চারটি তল বিশিষ্ট এই রথে 9টি চূড়া রয়েছে ৷ মূল কাঠামোটি লোহার তৈরি ৷ তার গায়ে কাঠের পাটাতন ও টিন দিয়ে মোড়া ৷
মাহেশের রথের বর্তমান কেয়ারটেকার রাজু বিশ্বাস ৷ প্রতি বছর রথের এক মাস আগে বসু পরিবারের অনুমতি নিয়ে রথের মেরামতির কাজ শুরু করেন । তিনি বলেন, "বসু পরিবার 42 বছর ধরে এই রথ মেরামতির দায়িত্ব আমাদের দিয়ে আসছে ৷ মাহেশের রথের মেরামতির জন্য একমাস ধরে 25 জন শ্রমিক নিয়ে একটানা কাজ চলছে ৷ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে ৷ কেউ লোহার কাঠামো ঠিক করবে, কেউ কাঠের পাটাতন মেরামতি করবে, আবার কেউ রং করবে ৷"
রথের গায়ে শ্রীকৃষ্ণের নানা অবতারের ছবি আঁকা আছে ৷ রথের একদম উপর তলার সিংহাসনে থাকেন মহাপ্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও তাঁদের বোন দেবী সুভদ্রা ৷ তৃতীয় তলে কৃষ্ণ লীলার চিত্র আঁকা ৷ একদম নীচের তলায় শ্রীচৈতন্যের লীলার ছবি রয়েছে ৷ রথের ওজন 125 টন এবং এই রথের কোনও ব্রেক নেই ৷ 50 ফুটের কাঠের বিম দিয়েই ব্রেক করা হয় ৷
এছাড়া এই রথের দিক পরিবর্তন করতে চাকায় দেওয়া হয় ঝামা ইট ৷ হাজার হাজার ভক্ত রথের দড়িতে টান দেন ৷ 100 গজের দু'টি 2 ইঞ্চি মোটা পাটের দড়ি রয়েছে ৷ এছাড়াও আপদকালীন পরিস্থিতিতে আরেকটি দড়ি ব্যবহার করা হয় ৷ আর সেই রথ চালনা করেন শ্রীরামপুরের সুশান্ত বিশ্বাস ৷ 18 জন যুবক নিয়ে এই রথ চালানো হয় ৷ তাঁরাও বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন।
এছাড়া রথের সঙ্গে দু'টি তামার সাদা ও নীল রঙের ঘোড়া রয়েছে ৷ 5 ফুট 4 ইঞ্চির একজন সারথী রয়েছেন ৷ রথের সামনের দিকে আছে দুটি রাজ হংস ৷ এই রথের ভিতরে দিয়ে উপরে ওঠার জন্য লোহার সিঁড়ি আছে ৷ রথের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত ও পার্ষদরা রথে উঠে দড়ি দিয়ে রথে টান দেন ।লক্ষাধিক ভক্ত এই রথের দড়িতে টান দেওয়ার জন্য হাজির হন ৷ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই রথযাত্রা দীর্ঘ দিনধরেই হয়ে আসছে ৷