চন্দননগর/গুপ্তিপাড়া, 7 জুলাই: এক সময় পুরীর মতোই কাঠের রথের প্রচলন ছিল সর্বত্র । কালের নিয়মে কাঠের রথের বদলে অনেক জায়গাতেই লোহার রথে যাত্রা করেন দেব-দেবীরা ৷ তবে কাঠের রথের ঐতিহ্য এখনও বয়ে চলেছে গুপ্তিপাড়া । চন্দননগরে কাঠের রথ পরিবর্তন করে 1962 সালে লোহার রথের নির্মাণ করা হয় । সেই একই চিত্র দেখা যায় শ্রীরামপুরের মাহেশের রথের ক্ষেত্রেও । প্রতি বছর কাঠের রথ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাহেশে লোহার রথ নির্মাণ করিয়ে দেয় কলকাতার বসু পরিবার ।
এবারের বিশেষ চমক হল প্রথমবার গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন হুগলি লোকসভার তৃণমূল সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি ছাড়াও সেখানে ছিলেন বিধায়ক অসীমা পাত্র, সদর মহকুমা শাসক স্মিতা সান্যাল শুক্লারা ৷ রচনা গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা নিয়ে বলেন, "আগে গুপ্তিপাড়া রথযাত্রার কথা শুনেছি, কিন্তু আজ আসতে পেরে খুব খুশি হয়েছি । সবার মঙ্গল হোক । জয় জগন্নাথ ।"
হুগলির গুপ্তিপাড়া ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা হয় চন্দননগরে ৷ আড়াইশো বছর ধরে চন্দননগরে এই রথযাত্রা হয়ে আসছে । অতীতে নিম কাঠের রথ থাকলেও এখন চন্দননগরের ব্রেথওয়েট কোম্পানির তৈরি রথ টানা হয় ৷ এই রথের প্রতিষ্ঠা করেন লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী যাদবেন্দ্র ঘোষ । 1776 সালে চন্দননগরের জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় । তারপরেই নিমকাঠের রথেই রথযাত্রা হত ৷ কিন্তু প্রাকৃতিক ও অন্য় নানাবিধ কারণে কাঠের রথ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্রেথওয়েট কোম্পানি এই রথ তৈরিতে আগ্রহ দেখায় ।
1962 সালে চারতল বিশিষ্ট 14 চাকা এই রথের নির্মাণ করা হয় ৷ এই রথের ওজন 60 টন ৷ 9টি পিতলের চূড়া রয়েছে ৷ এই লোহার রথের উচ্চতা 40 ফুট ৷ দু'টি কাঠের ঘোড়া ও কাঠের সারথী রয়েছে । রথকে ঘিরে রয়েছে একাধিক দেবদেবীর মূর্তি ৷ আর রথের চারতলার উপরে মহাপ্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার অধিষ্ঠান করেন ৷ এদিন সকালে চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার থেকে তালডাঙা পর্যন্ত রথ টানা হয় ৷ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই সকালে ও বিকালে দু'বার রথের দড়িতে টান পড়ে ৷
চন্দননগর পুরনিগমের মেয়র রাম চক্রবর্তী-সহ অন্যান্য আধিকারিকরা চন্দননগরের রথ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন ৷ সেখানেই মেয়র বলেন, "চন্দননগরের রথ ঐতিহ্যপূর্ণ । সেই কারণেই বহু মানুষের সমাগম হয় এখানে । রথ উপলক্ষ্যে চন্দননগর পুরনিগম এবং পুলিশ প্রশাসনের তরফে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ৷ পুরনিগমের তরফে জলের ব্যবস্থা ও শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে ।"
চন্দননগর রথ কমিটির সম্পাদক অসিত সাহার কথায়, "চন্দননগর লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার আগে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ছিল ৷ এখান থেকেই চাল-সহ বিভিন্ন শস্য রফতানি হত ৷ সেই সময়েই এখানকার চাল ব্যবসায়ী যাদবেন্দ্র ঘোষ স্বপ্নাদেশ পান ৷ এরপরই এই চন্দননগর লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে জগন্নাথ মন্দির ও রথের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ৷ আর সেই থেকেই রথযাত্রা উৎসব পালন হয়ে আসছে এখানে । পরে কাঠের পরিবর্তে লোহার রথ নির্মাণ করে দেওয়া হয় ব্রেথওয়েট কোম্পানির তরফে ৷ তারাই বর্তমানে তত্ত্বাবধান করছে এই রথের ৷"
বাংলার প্রসিদ্ধ রথগুলির মধ্যে অন্যতম হুগলির বলাগড়ের গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা । সারাবছর জগন্নাথদেব এখানে বৃন্দাবন জিউ মন্দিরে থাকেন ৷ তারপর এদিন রথযাত্রায় মাসির বাড়ি যান । 1740 সালে এই রথ উৎসব শুরু করেন মধুসূদানন্দ মতান্তরে পিতাম্বরানন্দ । প্রায় তিনশো বছরের পুরনো গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা ৷ এই রথ শাল, সেগুন ও নিম কাঠের তৈরি ৷ এই রথ চারতলা ৷ উচ্চতা প্রায় 36 ফুট, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ 34 ফুট করে ৷ আগে রথের 12টি চূড়া ছিল ৷ বর্তমানে নয়টি চূড়া রয়েছে ৷
গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে । হুগলি গ্রামীণ পুলিশের বিভিন্ন থানা থেকে ওসিরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন । ডিএসপি, অ্যাডিশনাল এসপি পদমর্যাদার অফিসাররা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন এখানে । ড্রোন ক্যামেরায় চলছে নজরদারি । গুপ্তিপাড়ায় রথের প্রথম টান হয় বেলা বারোটায় । এই রথযাত্রা দেখতে বর্ধমান, নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা থেকে বহু মানুষ আসেন । ভক্তের ভিড়ে গমগম করছে রথের সড়ক । মেলা বসেছে । আর সবার জন্য থাকে ভোগের ব্যবস্থাও রয়েছে । গুপ্তিপাড়া রথযাত্রার একটি নিজস্ব বিশেষত্ব হল ভাণ্ডার লুট । উলটোরথের আগের দিন হয় এই ভাণ্ডার লুট ।