মালদা, 15 জুন: সন্তোষ আর অমর ৷ দুই ভাই ৷ দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ৷ বিদ্বান ৷ সাতটি ভাষায় পারদর্শী ৷ ঠিক সেই সময় গৌড়ের সিংহাসন বদল হয়েছে ৷ রাজত্ব স্থাপন করছেন হুসেন শাহ ৷ মন্ত্রীসভা গঠনের প্রয়োজন তাঁর ৷ কিন্তু বিদ্বান ও বিচক্ষণ কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না ৷ তখনই তাঁর কানে আসে দক্ষিণি দুই ভাইয়ের কথা ৷ নবাবের ডাক উপেক্ষা করা যায় না ৷ দক্ষিণ থেকে পূর্বে ছুটে আসেন দুই ভাই ৷ সন্তোষকে প্রধানমন্ত্রী, অমরকে অর্থমন্ত্রী করে মন্ত্রীসভায় রেখে দেন হুসেন শাহ ৷ কিন্তু সুলতানি রাজত্বে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ! তাতে হয়তো দিল্লির দরবার নারাজ হত ৷ তাই দুই ভাইয়ের নাম পালটে দেন বাংলার নবাব ৷ সন্তোষ হয়ে যান সাকর মল্লিক, অমর দবির খাস ৷
বলে যাচ্ছিলেন মদন পানিগ্রাহী ৷ রামকেলির মূল মন্দিরের প্রধান পূজারি ৷ তিনি আরও জানালেন, এই দুই ভাইয়ের জন্যই 1515 খ্রীষ্টাব্দের 15 জুন মহাপ্রভু রামকেলি এসেছিলেন ৷ দুই ভাই নবাব হুসেন শাহের মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই প্রভুকে একাধিকবার চিঠি লিখেছিলেন ৷ তাঁরা প্রভুর কৃপা পেতে চান ৷ তাঁরা আর মন্ত্রীত্ব চালাতে চান না ৷ তাঁদের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি শ্রীচৈতন্য ৷ নীলাচল থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে তিনি রামকেলি চলে আসেন ৷ তাঁর সঙ্গে থাকা লক্ষ লক্ষ ভক্তও চিন্তায় পড়ে যান ৷ প্রভু ভুল পথে চলেছেন কি না, তা নিয়ে ধন্ধে পড়ে যান ৷
তাঁর কথায়, শেষ পর্যন্ত রামকেলিতে আসেন মহাপ্রভু ৷ খবর পেয়ে দুই ভাই সেখানে ছুটে আসেন ৷ কিন্তু তাঁরা চিন্তায় পড়ে যান ৷ হুসেন শাহকে মহাপ্রভুর আগমন সংবাদ কীভাবে জানাবেন ! শেষ পর্যন্ত মহাপ্রভুর পরিচয় লুকিয়ে তাঁরা নবাবকে বিষয়টি জানান ৷ নবাবও তাঁর দুই মন্ত্রীর কথা শুনে ঘোষণা করেন, ওই সন্ন্যাসীর ধর্মে কেউ যেন আঘাত না করে ৷ মহাপ্রভু চারদিন এখানে অবস্থান করেন ৷ দুই ভাইকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দেন ৷ দু'জনের নাম হয় রূপ ও সনাতন গোস্বামী ৷ নিজের দুই মন্ত্রীর এমন ধর্মপ্রেম দেখে নবাব হুসেন শাহ রামকেলিকে ঠিক বৃন্দাবনের মতো সাজাতে শুরু করেন ৷ আটটি কুণ্ড তিনি খনন করেন ৷ সেই কারণেই রামকেলি গুপ্ত বৃন্দাবন নামে পরিচিত ৷ সেই সময় থেকে প্রতি বছর এই তিথিতে চারদিনের উৎসব পালিত হয় ৷ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে ৷ যা রামকেলি মেলা নামে পরিচিত ৷ এবার এই মেলার 510 বছর পূর্তি ৷
প্রধান পূজারি জানাচ্ছেন, চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে মহাপ্রভুর রামকেলি আগমন নিয়ে যাবতীয় তথ্য রয়েছে ৷ কিন্তু কী কারণে এই উৎসবে সামিল হন তন্ত্র সাধকরাও ! রামকেলি উৎসব সেরেই তাঁরা চলে যান কামাখ্যা ৷ অম্বুবাচি তিথিতে সেখানেও উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ৷ বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে তন্ত্র সাধনার সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? তার উত্তর দিলেন মেলায় আসা এক সাধু বালকনাথ অঘোরপীর ৷ বলেন, "বছর পাঁচেক ধরে আমি এই মেলায় আসছি ৷ এই মেলার ইতিহাস পুরোটা জানা নেই ৷ রামকেলি হল মোক্ষলাভের জায়গা ৷ এখানে সাধনা করলে মোক্ষলাভ হয় ৷ আর কামাখ্যা হল বিদ্যা সাধনা ৷ সেখানে তন্ত্রবিদ্যার সাধনা হয় ৷ গার্হ্যস্থ ধর্ম মেনেও যে মোক্ষলাভ করা যায়, তার রাস্তা দেখিয়ে গিয়েছেন মহাপ্রভু ৷ এখানে এলে মুক্তি মেলে ৷ মুক্তির পথ অনেক ৷ আমার সবটা জানা নেই ৷"
জেলা প্রশাসনের তরফেও এই উৎসব ঘিরে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ৷ অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) জামিল ফতেমা জেবা বলেন, "রামকেলি মেলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় ৷ পুণ্যার্থীদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ মেলা প্রাঙ্গনে পর্যাপ্ত আলো, পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে ৷ নিরাপত্তার জন্য পুলিশি বন্দোবস্তও করা হয়েছে ৷ মূল মেলা শনিবার থেকে শুরু হবে ৷ চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৷"