বারুইপুর, 25 নভেম্বর: নেই বাঘ, হাতি, জলহস্তি কিংবা পাখির খেলা । তা সত্ত্বেও বারুইপুর রাস মাঠে দর্শকরা ভিড় জমাচ্ছেন মণিপুরের শিল্পীদের ব্যালান্স ও জাগলিংয়ের খেলা দেখতে । একদিকে হিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর ৷ আর সেই রাজ্যে আত্মীয়-স্বজনকে ছেড়েই বাংলায় এসে খেলা দেখাচ্ছেন মণিপুরের শিল্পীরা । শুধুমাত্র জীবিকার টানেই তাঁরা পড়ে রয়েছেন বারুইপুরে ।
শত কষ্ট, দুঃখ, বেদনা, ভয় ও আতঙ্ক থাকলেও হাসিমুখে সার্কাসে আসা দর্শকদের মনোরঞ্জন করে চলেছেন মণিপুরের শিল্পীরা । এইসব শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন রবীন সিং, মোহন দাসরা ৷ মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে 20 কিলোমিটার দূরে থৌবালে বাড়ি তাঁদের । সেখানেই রয়েছেন আত্মীয়-স্বজনেরা ৷ আর রবীনরা রয়েছেন বারুইপুরে সার্কাসের তাঁবুতে । সার্কাসের ফাঁকেই উদ্বিগ্ন রবীনরা বারে বারে মোবাইলে দেখছেন দেশের কী পরিস্থিতি । খোঁজ নিচ্ছেন পরিবারের । রবীন সিং বলেন, "এখনও পর্যন্ত থৌবালে কিছু হয়নি । স্বাভাবিক আছে এলাকা । কিন্তু কতদিন তা থাকবে জানি না ।"
রবীন সিং-সহ 12 জন মণিপুরের যুবক-যুবতী তাঁদের নানা আকর্ষণীয় খেলা দেখাতে এসেছেন বারুইপুরের রাস মাঠের সার্কাসে । প্রতিদিন তিনটি করে শোয়ে চলে তাঁদের খেলা । এই রোলেক্স সার্কাসের মূল আকর্ষণ এই মণিপুরীরা । রবীন সিং বলেন, "সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছি বটে । কিন্তু মন পড়ে আছে আমাদের বাড়িতে । বাড়িতে বাবা-মা আছেন । তাঁদের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত নিয়মিত কথা বলতে পারছি । কিন্তু পরবর্তীকালে জানি না পারব কি না । খুব চিন্তার মধ্যেই সার্কাসের খেলা দেখাতে হচ্ছে ।"
রবীন সিংয়ের সহধর্মিণী পুস্পারানিও এসেছেন তাঁর সঙ্গে । খেলা দেখানো শেষ হতেই তাঁবুতে ছুটছেন পরিবারের খোঁজখবর নিতে । তিনি বলেন, "এইরকম মণিপুরের পরিস্থিতি হবে আদেও ভাবিনি । ইম্ফলেও অনেক আত্মীয় পরিজন আছেন । তাঁদের কোনও খবর নিতে পারছি না । ইন্টারনেট পরিষেবাও নেই ওখানে । সার্কাসে দর্শকদের মনোরঞ্জন করছি বটে তবে মন পড়ে আছে মণিপুরে । খেলা দেখানোর সঙ্গে মোবাইলে রাজ্যের পরিস্থিতি জানতে হচ্ছে । তবে ওখানে এখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে । কোনও অশান্তির খবর নেই ।"
পাশাপাশি অসম, হায়দরাবাদ ও অন্যান্য রাজ্যের শিল্পীরাও এসেছেন বারুইপুরের সার্কাসে ৷ তাঁরা সকলে আশঙ্কায় রয়েছেন সার্কাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে । জীবজন্তুর খেলা আগেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে । আগামিদিনে আর দর্শকরা সার্কাসমুখো হবেন কি না, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা । কিন্তু তাঁরা এই পেশা ছেড়ে অন্য কোনও কাজ করতে পারছেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ৷ কারণ তাঁরা অন্য কোনও কাজ জানেন না । তবে নিজেদের আগামী প্রজন্মকে আর এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি নন ভিন রাজ্য থেকে আসা এইসব সার্কাস শিল্পীরা ।
অনিমেষ খাটুয়া নামে এক সার্কাস শিল্পী বলেন, "আধুনিক যুগে সার্কাসের গুরুত্ব কমেছে ৷ তবে আমাদের এই সার্কাসের চাহিদা রয়েছে । আমি দীর্ঘদিন ধরে এই সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত । মানুষ আমার প্রদর্শনী খেলাগুলি মুগ্ধ হয়ে দেখে ৷ এমনকি বাচ্চারাও আমার এই খেলা দেখে আনন্দ পায় । আমরা চাই সার্কাসপ্রেমী মানুষেরা আরও বেশি করে সার্কাসমুখী হোক । আমাদের এই রুজি রুটি এই সার্কাসের উপরই নির্ভর করে । আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন খেলা প্রদর্শন করি ।"
অন্যদিকে, সার্কাসের মালিক মোল্লা সাদেক রহমানের কথায়, পশু পাখি আর জীবজন্তুর খেলা এখন আর সার্কাসে দেখানো হয় না ৷ অন্যান্য জায়গায় সার্কাস করতে গেলে এমন পরিমাণ দর্শক পাওয়া যায় না । আগের থেকে সার্কাসের গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে ৷ কিন্তু কলাকুশলীদের নিয়ে যে নিত্যনতুন খেলা প্রদর্শন করা হয়, সেই খেলা দেখতে মানুষ ভিড় জমায় । বারুইপুর এলাকার মানুষ সার্কাসপ্রেমী । আগে মানুষ ঘোড়ার ও গরুর গাড়ি চড়ে সার্কাস দেখতে আসত এবং দুই থেকে তিন দিন ধরে সার্কাস দেখার জন্য অপেক্ষা করত । ডিজিটাল যুগে এখনও সার্কাসপ্রেমী মানুষ রয়েছে ।