মালদা, 23 মার্চ: 2009 সালে সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর মালদা লোকসভা কেন্দ্র ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ মালদা লোকসভা কেন্দ্র গঠিত হয়েছে ৷ ডিলিমিটেশনের পর দক্ষিণ মালদা কেন্দ্রে প্রতিবারই জয় পেয়ে এসেছে কংগ্রেস ৷ ঊনিশের ভোটেও এখানে জেতেন কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু মিঞা)৷ বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি গুরুতর অসুস্থ ৷ একাধিকবার হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে ৷ এখনও কলকাতায় রয়েছেন ৷ এ বার এই কেন্দ্রে তাঁর ছেলে তথা সুজাপুরের প্রাক্তন বিধায়ক ইশা খান চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস ৷ বাবার অসুস্থতার জন্য তাঁর সংসদীয় এলাকার যাবতীয় কাজ করে চলেছেন ইশা ৷ শেষ পাঁচ বছর দক্ষিণ মালদার সাংসদ হিসাবে সাংসদ ডালু মিঞা কতটা সফল, তারই অনুসন্ধান চালিয়েছে ইটিভি ভারত ৷
প্রশাসনিক সূত্রে খবর, পাঁচ বছরে সাংসদ কোটার সাড়ে 17 কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই খরচ করতে পেরেছেন দক্ষিণ মালদার সাংসদ ৷ শেষ পর্যায়ে আসা টাকা খরচ করতে ইতিমধ্যে প্রকল্পও জমা করেছেন তিনি ৷ কিন্তু ডালুবাবুর সংসদীয় এলাকার ভোটাররা কিন্তু তাঁর কাজকর্মে খুশি নন ৷ ইটিভি ভারতের ক্যামেরায় সে কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন তাঁরা ৷
দক্ষিণ মালদা লোকসভা কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা নদী ভাঙন ৷ এর সঙ্গে রয়েছে বিড়ি ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, রেশম চাষ সংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদি ৷ কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের লালুটোলা গ্রামের গঙ্গা ভাঙন বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ বলছেন, “একুশের ভয়াবহ ভাঙনে বাড়ি-ঘর গঙ্গায় চলে গিয়েছে ৷ পাকা বাড়ি হারিয়ে এখন বাঁধের ধারে রাস্তায় থাকতে হচ্ছে ৷ তখন জমি-জায়গা, আমবাগান সবই ছিল ৷ সব গঙ্গায় চলে গিয়েছে ৷ এখন বিড়ি বেঁধে পেট চালাই ৷ দীর্ঘদিন ধরে পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি ৷ দুই সরকার একে অন্যের কাঁধে দায় চাপাচ্ছে ৷ রাজনৈতিক দাদারা বলছে, সরকার দিলে ওরা আমাদের জমি দেবেন ৷ নইলে ওরা কিছু করতে পারবেন না ৷ গত পাঁচ বছর ডালু মিঞা আমাদের সাংসদ ছিলেন ৷ তিনি আমাদের কথা সংসদে তুলেছেন কি না জানি না, তবে তিনি আমাদের সঙ্গে কখনও দেখা করতে আসেননি ৷ তিনি মুখ দেখিয়েই ভোট নেন ৷ কোনও কাজ করেন না ৷”
আরেক ভাঙন উদ্বাস্তু আনজুরা বিবি জানান, “কিছুই নেই আমার৷ পাকা বাড়ি গঙ্গা গিলে নিয়েছে৷ এখন খড়ের বাড়িতে মাথা গুঁজতে হয়েছে ৷ আমার স্বামী একসময় রংমিস্ত্রি ছিল ৷ সব হারিয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে 10 বছর ধরে ঘরে শুয়ে আছে ৷ আমি নিজেও অসুস্থ ৷ এখন আমি ভিখারি ৷ কেউ কিছু করেনি ৷ সাংসদও কিছু করেননি ৷ ভোট চাইতে তিনি আবার আসবেন ৷ আমার ঘর, জমির দরকার ৷ ওঁকে বলব ৷”
এ বার আসা যাক রেশম চাষের ক্ষেত্রে ৷ চাষি ও ডিলারদের সবচেয়ে বড় সমস্যা রেশমের দামের ওঠানামা ৷ কালিয়াচকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় রেশম হাট বসে ৷ সেখানেই উৎপাদিত কোকুন নিয়ে এসেছিলেন নাজিমুল শেখ ৷ তিনি বলেন, “20 বছর ধরে এই চাষ করছি ৷ কিন্তু বাজারের কোনও স্থিরতা নেই ৷ এখন বাজার খুব খারাপ ৷ এখন প্রতি মণ কোকুন 14 হাজার 500 টাকায় বিকোচ্ছে ৷ এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে ৷ এভাবে চললে রেশম চাষ থাকবে না ৷ সাংসদ আমাদের সমস্যা সমাধান করবেন বলেছিলেন ৷ কিন্তু কিছুই করেননি ৷ রেশম এই জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল হলেও তিনি আমাদের সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরেননি ৷ এই রাজনীতি মোটেই ভালো নয় ৷ শুধু ধোঁকা ৷”
কোকুন থেকে রেশম সুতো প্রস্তুতকারক মহম্মদ ইশা শেখ জানাচ্ছেন, “রেশম সুতোর দাম ভীষণ নেমে গিয়েছে ৷ আগের তুলনায় অনেক কমেছে ৷ মার্কেটের দর আমাদের হাতে নেই ৷ ধান বা পাটে সরকারিভাবে দর বেঁধে দেওয়া হলেও রেশমে তা নেই ৷ রেশমের দর বেঁধে দেওয়া হলে আমাদের সঙ্গে চাষিরাও উপকৃত হবেন ৷ কিন্তু সাংসদ-বিধায়কদের এ নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই ৷ সাংসদ আমাদের সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরেছেন কি না জানি না ৷”
এবার শোনা যাক বিড়ি শ্রমিকদের কথা ৷ ইংরেজবাজারের কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা, বিড়ি শ্রমিক ববি বেওয়া জানালেন, “বিশ বছর ধরে বিড়ি বাঁধছি ৷ আমার স্বামী নেই ৷ ভাইয়ের কাছে থাকি ৷ পেট চালাতে বিড়ি বাঁধতে হয় ৷ এই কাজে শরীরে অনেক সমস্যা দেখা দেয় ৷ ফুসফুস ঠিক রাখতে রাতে গরম জলের সঙ্গে গুড় খেতে হয় ৷ ভালোমন্দ খেতে হয় ৷ শুনেছি, প্রতি হাজার বিড়িতে সরকারি মজুরি 298 টাকা ৷ কিন্তু আমরা পাই মাত্র 155-160 টাকা ৷ এর সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে আমাদের 15 টাকা হপ্তা দিতে হয় ৷ এই কাজ করে পেটটাও ঠিকমতো চলে না ৷ আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম ৷ কিন্তু বিড়ি মালিকদের প্রতিনিধিরা নানা কথা বলে এড়িয়ে যান ৷ আমাদের সাংসদ এই সমস্যা মেটাতে কোনও উদ্যোগ নেননি ৷ আবার ভোট আসছে ৷ হয়তো তাঁকে দেখা যাবে ৷ আমরা তাঁকে আমাদের সমস্যার কথা বলতে মুখিয়ে রয়েছি ৷”
যদিও ডালুপুত্র ইশা খান চৌধুরীর দাবি, “আমি যতদূর জানি, সম্প্রতি তাঁর শেষ পর্যায়ে কোটার প্রায় সাত কোটি টাকা এসেছে ৷ এই টাকার কাজের জন্য তিনি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন ৷ সেটা অনুমোদনও হয়ে গিয়েছে ৷ নিজের কোটার সম্পূর্ণ টাকা তিনি খরচ করে ফেলেছেন ৷ সাংসদ কোটার টাকা তিনি শেষ করে ফেলেছেন ৷ এই টাকায় মূলত রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, ছোট ব্রিজ, সোলার লাইট ইত্যাদি কাজ হয় ৷ তিনি 2006 সাল থেকে সাংসদ ৷ অনেক কাজ করেছেন ৷ গঙ্গা ভাঙন সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রায় 300 কোটি টাকা নিয়ে এসেছেন ৷ কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর গত পাঁচ বছর ধরে অসহযোগিতার শিকার হয়েছেন তিনি ৷ ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাজ করার সীমানা বাড়িয়েছেন ৷ গঙ্গা ভাঙনের কাজ কে করবে তা নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে শুধু বচসাই চলছে ৷ কেন্দ্র শ্রমিকদের সুবিধে কমিয়ে দিচ্ছে ৷ শ্রমিকদের জন্য তৈরি হওয়া হাসপাতালে 10 জনের বেশি রোগীর জায়গা নেই ৷”
সাংসদের কাজ নিয়ে জেলা তৃণমূলের সহসভাপতি দুলাল সরকারের প্রতিক্রিয়া, “বরকত সাহেব এই জেলার জন্য যা করেছেন, তাকে সম্মান না জানিয়ে উপায় নেই ৷ সেকারণে তাঁর উত্তরসুরীরা পুতুলের মতো প্রার্থী হলেও মানুষ তাঁদের ভোট দিত ৷ তবে এখন আর সেই দিন নেই ৷ গত বিধানসভা নির্বাচনে সুজাপুর কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী রেকর্ড ভোটে হেরেছেন ৷ আবু হাসেম খান চৌধুরী একসময় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন ৷ তিনি মালদার জন্য কী করেছেন ! কংগ্রেস আমলেও তাঁর কাজ দাগ কাটেনি ৷ তিনি গঙ্গা ভাঙন, বিড়ি শিল্প নিয়ে কোনও বড় আন্দোলন গড়ে তোলেননি ৷ বরং আমরাই সেই আন্দোলন করেছিলাম ৷ আর এখন তো কাজ করছে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই ৷ মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে ৷ জেলার সমস্যা নিয়ে তিনি সংসদে কোনও কথা তুলে ধরেছেন কি না তাও জানা নেই ৷ তিনি সংসদে ঠিকমতো গিয়েছেন কি না সেটাও জানি না ৷ সাংসদ হিসাবে তিনি এক থেকে দুই নম্বর পেতে পারেন ৷”
আরও পড়ুন: