মালদা, 29 এপ্রিল: বিহার-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা উত্তর মালদা লোকসভা কেন্দ্র ৷ সড়ক পথে প্রতিবেশী দুই রাজ্যের বাসিন্দাদের নিয়মিত যাতায়াত এই কেন্দ্রে ৷ রয়েছে গঙ্গা-ফুলহরের আন্তঃরাজ্য সীমান্তও ৷ গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে নজর ছিল সবার ৷ কারণ, কোতওয়ালির খান চৌধুরী পরিবারের দুই সদস্য সেই ভোটে মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ৷ হারতে হয়েছিল দু’জনকেই ৷ হাসতে হাসতে জিতে গিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী ৷ পারিবারিক সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মালদা জেলায় প্রথমবার এই কেন্দ্রে ফুটেছিল পদ্মফুল ৷ এবারের ভোটে এই কেন্দ্রে প্রার্থীপদের দাবিদার ছিলেন তৃণমূলের একাধিক নেতা-নেত্রী ৷ সেই তালিকায় ছিলেন দলের জেলা সভাপতি আবদুর রহিম বকসি, চেয়ারম্যান সমর মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম নুরও ৷
মৌসমের অনুগামীদের বক্তব্য ছিল, আলিপুরদুয়ারে প্রকাশ চিক বড়াইক প্রার্থী হতে পারলে মৌসম নয় কেন ? তবে এবার এই কেন্দ্রে জেলার কাউকে ভরসা করেননি মমতা-অভিষেক ৷ প্রার্থী করেছেন স্বেচ্ছাবসর নেওয়া আইপিএস প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৷ তাঁর বিপক্ষে বিজেপির ঘোড়া বিদায়ি সাংসদ খগেন মুর্মু ৷ কংগ্রেস প্রার্থী করেছে এলাকার ভূমিপুত্র, দু’বারের বিধায়ক মোস্তাক আলমকে ৷
দ্বিতীয় দফার ভোটের পর রাজনৈতিক মহল বলছে, দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই কেন্দ্রে মূল লড়াই থেকে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী ৷ এই কেন্দ্রে সমস্যা বহু ৷ বিহার-ঝাড়খণ্ড লাগোয়া হওয়ায় রয়েছে ভিনরাজ্যের দুষ্কৃতীদের সমস্যা ৷ সম্প্রতি চাঁচল ও হরিশ্চন্দ্রপুরে একাধিক সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৷ রয়েছে নদী ভাঙন ও পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা ৷ চাঁচল পৌরসভা গঠনে মানুষের দাবি এখনও পূরণ হয়নি ৷ মাখানা প্রক্রিয়াকরণ কিংবা ব্যবসার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি ৷ রতুয়ার সামসীতে রেল গেটের যানজট আজও মানুষের কাছে আতঙ্কের ৷ হবিবপুর, গাজোল, মালদা বিধানসভা কেন্দ্রের রুক্ষ বরিন্দভূমিতে আজও সেচ ব্যবস্থা চালু হয়নি ৷ বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি এখনও একফসলি হয়েই থেকে গিয়েছে ৷ এসব সমস্যা ও দাবি নিয়েই আগামী 7 মে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এই কেন্দ্রের 18 লক্ষ 60 হাজার 45 জন ভোটার ৷
উত্তর মালদা লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে হরিশ্চন্দ্রপুর, চাঁচল, মালতিপুর, রতুয়া, গাজোল, হবিবপুর ও মালদা বিধানসভা কেন্দ্র ৷ ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল মূল তিন দলের মধ্যে৷ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বিজেপির খগেন মুর্মু, তৃণমূলের মৌসম নুর ও কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী৷ খগেন মুর্মু পেয়েছিলেন 37.61 শতাংশ ভোট। মৌসম পান 31.39 শতাংশ ভোট। 22.53 শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন ইশা ৷ 84 হাজার 288 ভোটে জেতেন খগেন ৷
2009 সালের সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে মালদা জেলায় একটিমাত্র লোকসভা কেন্দ্র ছিল ৷ হরিশ্চন্দ্রপুর ও তৎকালীন খরবা বিধানসভা কেন্দ্র ছিল রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে ৷ গাজোল বিধানসভা বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৷ মালদা লোকসভা কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেসের রাজত্ব ৷ এগারোর ঘাসফুলের সুনামিতেও অক্ষত ছিল এই জেলার কংগ্রেস দুর্গ ৷ তবে এই জেলার রাজনীতিতে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে এক বৈপরীত্য চিরদিনই নজর কাড়ে ৷ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসিরাজ চললেও বিধানসভা নির্বাচনে বাম দলগুলি সামনের দিকে এগিয়ে আসত ৷ 2016 পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল ৷
2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে হরিশ্চন্দ্রপুর কেন্দ্রে ফরওয়ার্ড ব্লকের তজমুল হোসেন কংগ্রেসের মোস্তাক আলমকে পরাজিত করেন ৷ চাঁচলে কংগ্রেস প্রার্থী আসিফ মেহবুব হারিয়ে দেন সিপিআইএমের আঞ্জুমান আরা বেগমকে ৷ মালতিপুরে জয় পান আরএসপির আবদুর রহিম বকসি ৷ হেরে যান কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী আলবেরুণি জুলকারনাইন ৷ রতুয়ায় সিপিএমের শৈলেন সরকারকে হারিয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন কংগ্রেসের সমর মুখোপাধ্যায় ৷ গাজোল কেন্দ্রে কংগ্রেসের সুশীলচন্দ্র রায়ের কাছে হেরে যান সিপিএমের গোবিন্দ মণ্ডল ৷ হবিবপুর কেন্দ্রে জয় পান সিপিএমের খগেন মুর্মু। পরাজিত হন তৃণমূলের মোহন টুডু ৷ মালদা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী ভূপেন্দ্রনাথ হালদদারের কাছে পরাজিত হন সিপিআইএমের রাহুলরঞ্জন দাস ৷
2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনেও এই জেলায় খাতা খুলতে পারেনি তৃণমূল ৷ তৃণমূলকে ঠেকাতে সেবার এই জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বামেরা ৷ হরিশ্চন্দ্রপুরে কংগ্রেসের মোস্তাক আলমের কাছে পরাজিত হন তৃণমূলের তজমুল হোসেন ৷ চাঁচল কেন্দ্রে কংগ্রেসের আসিফ মেহবুব হারিয়ে দেন বিজেপির দীপঙ্কর রামকে ৷ মালতিপুর কেন্দ্রে কংগ্রেসের আলবেরুণি জুলকারনাইনের কাছে পরাজিত হন আরএসপির আবদুর রহিম বকসি ৷ রতুয়ায় ফের বিজয়ী হন কংগ্রেসের সমর মুখোপাধ্যায়, পরাজিত হন তৃণমূলের শেহনাজ কাদেরি ৷ গাজোলে তৃণমূলের সুশীলচন্দ্র রায়কে পরাজিত করেন সিপিআইএমের দীপালি বিশ্বাস ৷ হবিবপুর কেন্দ্রে ফের জয় পান সিপিআইএমের খগেন মুর্মু ৷ হারিয়ে দেন তৃণমূলের অমল কিস্কুকে ৷ মালদা কেন্দ্রে তৃণমূলের দুলাল সরকারকে পরাজিত করেন কংগ্রেসের ভূপেন্দ্রনাথ হালদার ৷
2019 সালের লোকসভা ভোটে উত্তর মালদা কেন্দ্রে প্রথমবার গৈরিক ঝান্ডা ওঠে ৷ তার প্রভাব পড়ে একুশের বিধানসভা নির্বাচনেও৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই জেলা থেকে হারিয়ে যায় বাম-কংগ্রেস ৷ আটটি কেন্দ্রে ঘাসফুলের প্রার্থীরা জয় পান ৷ বাকি চারটি যায় বিজেপির দখলে ৷ হরিশ্চন্দ্রপুরে বিজেপির মহম্মদ মতিউর রহমানকে হারিয়ে দেন তৃণমূলের তজমুল হোসেন ৷ চাঁচলে বিজেপির দীপঙ্কর রামকে পরাজিত করেন তৃণমূলের নীহাররঞ্জন ঘোষ ৷ মালতিপুরে জয়ী হন তৃণমূলের আবদুর রহিম বকসি। পরাজিত হন বিজেপির মৌসুমি দাস ৷ রতুয়া কেন্দ্রে তৃণমূলের সমর মুখোপাধ্যায় বিজেপির অভিষেক সিঙ্ঘানিয়াকে পরাজিত করেন ৷ গাজোলে জয়ী হন বিজেপির চিন্ময় দেব বর্মন ৷ হারিয়ে দেন তৃণমূলের বাসন্তী বর্মনকে ৷ হবিবপুর কেন্দ্রে বিজেপির জুয়েল মুর্মু তৃণমূলের প্রদীপ বাস্কেকে পরাজিত করেন৷ মালদা কেন্দ্রেও জয় পায় বিজেপি ৷ পদ্মপ্রার্থী গোপালচন্দ্র সাহা পরাজিত করেন তৃণমূলের উজ্জ্বলকুমার চৌধুরীকে৷
এবার কী হবে? তৃণমূলের জেলা সহসভাপতি দুলাল সরকার বলছেন, আমাদের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মালদা জেলায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ৷ তিনি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংগঠনিক দক্ষতায় একুশের বিধানসভা এবং গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মালদায় তৃণমূলের দারুণ ফল হয়েছে ৷ কংগ্রেস এখন তলানিতে ৷ গোটা রাজ্যে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই ৷ মোস্তাক সাহেব ভালো লোক হলেও হরিশ্চন্দ্রপুরের বাইরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নেই ৷ বিজেপি প্রার্থী গতবার মৌসম আর ঈশার লড়াইয়ের সুবিধে পেয়েছিলেন ৷ এবার সেটা হবে না ৷ তাছাড়া গত পাঁচ বছরে মালদা শহরে তাঁর বাড়ি ছাড়া বিজেপি সাংসদ কোনও সমস্যার সমাধান করেননি ৷ তাই এবার উত্তর মালদায় তিনি জিতবেন না ৷ রামের হাওয়া এখানে খাটবে না৷ যারা মানুষের উপকার করে, মানুষ এবার তাকেই ভোট দেবে৷ তাই তৃণমূল প্রার্থীই এখানে জিতছেন ৷”
কংগ্রেসের কার্যকরী জেলা সভাপতি কালীসাধন রায় বলছেন, “শুধু হরিশ্চন্দ্রপুর নয়, মোস্তাক আলম রাজনীতিবিদ হিসাবে গোটা মালদা জেলাতেই সুপরিচিত ৷ তিনি সামসী কলেজের জিএস ছিলেন ৷ ছাত্র পরিষদের জেলার নেতা ছিলেন ৷ পরবর্তীতে বরকতদার মন্ত্রশিষ্য হয়েছিলেন ৷ তিনি পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ৷ জেলা কংগ্রেসের সভাপতিও হয়েছিলেন৷ ফলে এই জেলার 15টি ব্লক, 146টি গ্রাম পঞ্চায়েত, দুটি পৌরসভার বুথ পর্যন্ত তাঁর চেনা৷ তাঁর বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন একজন দলত্যাগী ৷ এদের মানুষ বিশ্বাস করে না৷ সাংসদ হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ৷ অন্যদিকে তৃণমূলের প্রার্থী বহিরাগত ৷ তাঁর সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো ৷ মোস্তাক সাহেবকে কেউ বেগ দিতে পারবে বলে মনে করি না ৷ আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানের দখল নিয়ে যারা লড়াই করে, তাদের নিয়ে আমরা ভাবিও না ৷”
বিজেপির দক্ষিণ মালদা সাংগঠনিক জেলার সভাপতি উজ্জ্বল দত্তের বক্তব্য, “গত পাঁচ বছর আমাদের সাংসদ উত্তর মালদায় যে কাজ করেছেন, আগে কোনও সাংসদ তা করতে পারেননি ৷ তিনি নিজের কাজের খতিয়ান লিখিত আকারে প্রকাশ করেছেন ৷ এর আগে কোনও সাংসদ তা করেননি ৷ একদিকে মিষ্ট ব্যবহার, অন্যদিকে 24 ঘণ্টা কাছে পাওয়া- এই দুইয়ে তিনি সবার থেকে এগিয়ে ৷ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কোনও নেতাকে ধরতে হয় না ৷ সবার ফোন ধরেন সাংসদ ৷ প্রত্যেকের সমস্যায় এলাকায় ছুটে যান ৷ এসবই তাঁর প্লাস পয়েন্ট ৷ গঙ্গা-ফুলহরের ভাঙন বিধ্বস্ত মানুষকে নিয়ে একমাত্র তিনিই দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জেলাশাসকের দফতরের সামনে ধরনা দিয়েছেন ৷ প্রশাসনকে রিলিফ দিতে বাধ্য করিয়েছেন ৷ নদী ভাঙন প্রতিরোধের কাজ রাজ্য ও কেন্দ্রকে একসঙ্গে করতে হবে ৷ কিন্তু রাজ্য সরকার কোনও প্রস্তাব বা এনওসি দেয়নি ৷ এরপর রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিন সরকার হলে সেই কাজ দ্রুততার সঙ্গে হবে ৷ উত্তর মালদার মানুষ এবারও বিজেপিকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছেন ৷”
আরও পড়ুন
তৃণমূলের ভোট কেটে বিজেপিকে জেতাতেই মুর্শিদাবাদে প্রার্থী সেলিম, অভিযোগ মমতার