আলিপুরদুয়ার, 24 জুন: কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার এক মজার দেশের কল্পনা করেছিলেন ৷ যেখানকার সব নিয়মই এক্কেবারে উলটো ৷ কবি লিখেছিলেন, "এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো/রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো/আকাশ সেথা সবুজ বরণ, গাছের পাতা নীল/ডাঙায় চরে রুই-কাতলা, জলের মাঝে চিল ৷" অনেকটা এরকমই বিচিত্র এক জায়গার গল্প শোনাব আজ ৷
না, প্রকৃতি সেখানে এই কবিতার মতো 'উলটো বুঝলি রাম' নয় ৷ বরং এখানকার মানুষদের স্বভাবের সঙ্গে আশ্চর্য অমিল আজকের দিনের আম জনতার ৷ চোর-ডাকাত-কেপমারদের দৌরাত্ম্যে যেখানে দেশজুড়ে নাজেহাল পুলিশ, সেখানে এই গ্রামের মানুষ জানেনই না অপরাধ কাকে বলে ৷ এখানে নেই চুরি, ডাকাতি বা রাজনৈতিক সংঘর্ষ ৷ তাই থানায় নেই কোনও ক্রাইম রেকর্ড ৷ ফলে পুলিশের গুডবুকে রয়েছে ভারত-ভুটান সীমান্তে আলিপুরদুয়ারের বক্সা পাহাড়ের লেপচাখা-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ।
শুধু এরাজ্য নয়, দেশজুড়েই চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি এখন নিত্যদিনের ঘটনা ৷ এক মুহূর্ত কারওকে বিশ্বাস করার উপায় নেই ৷ তা করলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে খোয়া যায় নিজেদের মুল্যবান জিনিসপত্র ৷ স্ট্রেস, অভাব-অনটন - নানা কারণে বেড়ে চলেছে চুরি, ডাকাতি, মারামারির ঘটনা ৷ তাই মানুষের মুখে মুখে ঘোরে পুলিশের 100 ডায়ালের নম্বর ৷ তবে লেপচাখা গ্রামের মানুষ থানা বা পুলিশের কোনও নম্বরই জানেন না ৷ অপরাধ বা অপরাধীর থেকে বাঁচার কোনও ভাবনা নেই তাঁদের ৷ নির্মল আনন্দেই জীবন কাটে গ্রামবাসীদের ৷
কালচিনি থেকে মাত্র 32 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম । এই গ্রামের মূল অর্থনৈতিক ভিত পর্যটন ৷ কালচিনি থানা থেকে সান্তালবাড়ি পর্যন্ত সড়ক পথে এসে, এরপর ট্রেকিং করে যেতে হয় ভারত-ভুটান সীমান্তের বক্সা পাহাড়ের লেপচাখাতে । ডুয়ার্সের ভুস্বর্গ বলা হয় লেপচাখাকে । পাহাড়ের কোলে অপূর্ব সুন্দর এই গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ । খাড়া পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় বর্ষাকালে পর্যটক তেমন পাওয়া যায় না ।
পুলিশকে কখনও কোনও অপরাধের ঘটনায় আসতে হয়নি এই লেপচাখায় ৷ শুধু লেপচাখা নয়, বক্সা, তাসিগাও, আদমা, সদর বাজার, ডারাগাও এবং চুনাভাটির মতো পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । অপরাধের ঘটনা না-ঘটলেও আলিপুরদুয়ার জেলা পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে কালচিনি থানার আধিকারিকরা সচেতেনতা বৃদ্ধির জন্য এই এলাকায় যান । আলিপুরদুয়ারের দুর্গম বক্সা পাহাড়ে তিনটি এমন বুথ আছে যেখানে কোনও নেটওয়ার্ক কাজ করে না । আদমা, চুনাভাটি ও বক্সা তিনটি বুথ । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 2800 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বক্সা পাহাড়ের লেপচাখা ।
লেপচাখার প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য পাশাং তেনজি জানান, "এখানে পুলিশের আসার কোনও দরকারই পড়ে না । পুলিশের কোনও যোগাযোগের নম্বরও আমাদের কাছে নেই । দরকার হলে পুলিশের নম্বরে যোগাযোগ করব । এখানে পর্যটক অনেক আসেন ।"
লেপচাখার পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত ইনতেজাম ডুকপা বলেন, "পর্যটক এলে আমাদের রোজগার হয় । এখন বর্ষাকাল আমাদের অফ সিজন । পর্যটক কম । পর্যটক এলে আমাদের ভালো । রোজগার বাড়ে । এখানে চুরি-ডাকাতি কিছুই হয় না । পুলিশ আসার কোনও দরকারই পড়ে না ।"
বক্সার ট্যুর গাইড শিবু ছেত্রী বললেন, "এখানে শান্তির পরিবেশ । এখানে পুলিশের কোনও দরকারই পড়ে না । এখানে চুরি, মারামারি হয় না । পুলিশ এখানে এলে বেড়াতে আসে । কোনওদিন পুলিশকে ফোন করতেই হয়নি । এখানে খারাপ লোক নেই । সবাই সাদাসিধে । লেপচাখার হোম স্টে-তে পর্যটকরা নিশ্চিন্তে থাকেন ।"
আলিপুরদুয়ারের কালিচিনি থানার ওসি গৌরব হাঁজদা জানান, "লেপচাখা এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষরা খুব ভালো । অনেক কষ্ট করে থাকেন তাঁরা । আমাদের কোনও ক্রাইম ইস্যু নিয়ে যেতেই হয় না । সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আমরা গিয়ে থাকি । এখনও পর্যন্ত আমার মনে পড়ছে না ওখানে কোনও চুরি বা ডাকাতির কোনও রিপোর্ট হয়েছে কি না । আমাদের খুব ভালো লাগে যে, সেখানে কোনও ক্রাইম সে ভাবে এখনও আমরা পাইনি । ট্রেকিং করে পাহাড়ের উঁচুতে লেপচাখাতে যেতে হয় । পর্যটনই ওখানকার মানুষের মূল রুটিরুজি । আজকের দিনে একটা থানা এলাকায় ক্রাইম থাকবে না ভাবাই যায় না । তবে লেপচাখা একদমই আলাদা ।"
আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপার ওয়াই রঘুবংশীর কথায়, "কালচিনি থানা এলাকার বক্সা পাহাড়ের লেপচাখা-সহ কয়েকটি গ্রামে পুলিশের যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না । সবাই সেখানে মিলে মিশেই থাকে ।"