দুর্গাপুর, 3 এপ্রিল: 'খেলা হবে' - গত বিধানসভা ও পঞ্চায়েত ভোটে বাংলার মোড়ে মোড়ে শোনা গিয়েছে শাসকদলের এই গান ৷ তাকে পাল্লা দিতে 'টুম্পা সোনা', 'টুনির মা', 'উরি উরি বাবা'র মতো একই স্বাদের চটুল গানে ভরসা রেখেছে বামেরা ৷ তবে শুধু ভোট নয় ৷ ইতিহাস দেখেছে যে, বছরের পর বছর ধরে বাম আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে গণসঙ্গীত ও গণনাট্য ৷ এক সময় বলা হত, "বক্তৃতা করে মানুষের মধ্যে যতটা না দ্রুত পৌঁছনো সম্ভব, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক তার থেকে অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গে মানুষের কাছে ব্রিটিশ অত্যাচারের কাহিনী পৌঁছে দিয়েছিল ৷" একই কথা প্রযোজ্য গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও ৷ 'ভয় কী লাল রঙে আমাদের প্রিয় রং লাল' বাম আমলে রক্তে আগুন ধরাত ৷ বামেরা আজ ক্ষমতায় নেই ৷ তবে গণসঙ্গীতের ধারা আজও অটুট বাম রক্তে ৷ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তা আরও বেশি করে চাঙ্গা ৷
এই বাংলায় গণসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত পাণ্ডেদের হাত ধরে বামপন্থীরা মানুষের কাছে সর্বহারাদের ও অত্যাচারিতদের নিপীড়নের নিদারুণ কথাকে সংগীতের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন । বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে গণসঙ্গীতের ধারা মিশে আছে কয়েক দশক আগে থেকেই । বামপন্থীদের সভা সমিতির আগে এই গণসঙ্গীত গেয়ে মানুষের কাছে অসহায়, নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের কথা তুলে ধরা হত ।
এ কালেও প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী-সহ আরও বহু সঙ্গীত স্রষ্টাদের নাম উঠে আসে । গণসঙ্গীত ঠিক কী, তা বলতে গিয়ে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, "শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রামের সাঙ্গীতিক ইতিহাসই হল গণসঙ্গীত ।" আবার গণসঙ্গীতের রূপকার হিসেবে পরিচিত হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন, "স্বদেশচেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশল, সেই মোহনাতেই গণসঙ্গীতের জন্ম ।"
এই বিষয়ে প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী তথা সুরকার কল্যাণ সেন বরাটের মত, "আজও প্রচারের ভাষা গণসঙ্গীত । এখনকার মিউজিশিয়ানরা চেষ্টা করছেন তাঁদের মতো করে । সত্যি বলতে কী, আমাদের সময়ের সব ভালো ছিল আর এখন সব খারাপ এটা আমি কখনও বলি না । দিন কাল পালটেছে । সুবিধা, অসুবিধা মিলিয়ে আজও ছেলেমেয়েরা যে ধরনের গানকে আঁকড়ে ধরে আছে, তার জন্য তাঁদের কুর্নিশ জানাতেই হয় । হয়তো তাঁরা মানের দিক থেকে সবসময় ঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারছেন না, তবু চেষ্টায় খামতি নেই ।"
তিনি আরও বলেন, "গণসঙ্গীত তো মানুষের গান । মানুষের যতদিন অভাব অনটন থাকবে, প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকবে, ততদিন এই গান বিশ্বব্যাপী শেষ হবে না । তবে, এটাও ঠিক, একটা ভোটের প্রচারের জন্য একটা কী দুটো গান তৈরি হলে আর তারপরে সেই গানটা আর শোনাই যায় না । এরকম গানও তৈরি হয় । এগুলো মানুষ মনে রাখে না । তবে যে গানগুলি শাশ্বত তা আজও বেঁচে আছে এবং এখনও তৈরি হচ্ছে । তাই বলতে দ্বিধা নেই, সব শেষ হয়ে যায়নি। প্রাণ আজও আছে । আর প্রাণ থাকার জন্য যা যা থাকার দরকার তা সব আছে ।..."
সমকালীন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের কথায়, "গণসঙ্গীত হয়ে ওঠার জন্য একটা গণ অভ্যুত্থান দরকার । প্রতিবাদ, আনন্দ সবেরই প্রকাশ ঘটে গণসঙ্গীতের মাধ্যমে । 'আমার প্রতিবাদের ভাষা' গানটি কিন্তু সবসময়েই প্রাসঙ্গিক । একইভাবে রবীন্দ্রনাথের 'একলা চলো রে'ও তাই ৷"
শোষণহীন, নিপীড়নহীন, অত্যাচারমুক্ত সমাজ গঠনের কথা, বামপন্থীদের বার্তা গানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে তুলে ধরার কাজ এই গণসঙ্গীত শিল্পীরা আজও নিপুণভাবে পালন করে চলেছেন শ্রমিকনগরী দুর্গাপুরেও । এ রাজ্যে শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকার সময় একসময়ের লালদুর্গ অবিভক্ত বর্ধমান জেলার শস্যগোলা গ্রামীণ বর্ধমান বা ইস্পাতনগরী দুর্গাপুর কিমবা খনি অঞ্চল রাণিগঞ্জ, আসানসোলে বহু গণসঙ্গীতের গোষ্ঠী বামফ্রন্টের সভা সমাবেশের আগে গণসঙ্গীতের দ্বারা মানুষের কাছে প্রতিবাদের কথা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন । কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকগুলি গণসঙ্গীতের গোষ্ঠীর মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায় বামেদের 34 বছরের রাজ্যপাট বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে । তবে শিল্পশহর দুর্গাপুরে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি গণসঙ্গীতের দল ।
দুর্গাপুরের গণসঙ্গীতের ধারাকে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখেছে 'লহরী' ৷ দুর্গাপুর লহরীর অন্যতম প্রাণপুরুষ সীমান্ত তরফদার জানালেন, "পুরাতন গণসংগীতের সেই ধারাকে বজায় রেখে, অতীতকে অস্বীকার না-করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত পাণ্ডেদের দেখানো পথেই আমরা আজও হাঁটছি । শিকড়কে না-ছিঁড়ে গান বাঁধছি । কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে সব চলে যাওয়ার প্রতিবাদ, বেকারের পেটে ভাত দেওয়ার দাবি, শ্রমিকের হাতে কাজ দেওয়ার দাবি গণতান্ত্রিক বামপন্থী সংগঠনগুলির এমনই নানা আবেদন আমরা তুলে ধরছি গানে গানে ।"
দুর্গাপুরে আজও রীতিমতো গণসঙ্গীতের রেওয়াজ হয় । এ রাজ্যে ক্ষমতায় নাইবা থাকল বামেরা । তবুও গণসঙ্গীত শিল্পীদের মনের আনন্দে ভাঁটা পড়েনি । আজও তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে গণসঙ্গীত শিল্পীরা সমবেতভাবে গেয়ে ওঠেন, "কীসের শোক করিস রে ভাই/আবার তোরা মানুষ হ।"
শুধু এই বাংলায় নয়, প্রতিবেশী রাজ্য অসমেও গণসঙ্গীতের ধারা অব্যাহত ছিল বহুকাল । ত্রিপুরাতেও গণসঙ্গীতের নিয়মিত আয়োজন ছিল বামপন্থীদের সভা সমাবেশের আগে । পাশ্চাত্য দেশের অনুকরণে বহু গণসঙ্গীতের সৃষ্টি । আজও তাই কান পাতলে শোনা যায় ভূপেন হাজারিকার কন্ঠে গাওয়া, "বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন ?"
আরও পড়ুন: