বলাগড়, 17 মে: আজকের হুগলি একসময় ছিল বাংলার বাণিজ্য নগরী সপ্তগ্রাম ৷ তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল নদীকেন্দ্রিক ৷ গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে ব্রিটিশদের তৈরি উপনিবেশগুলিতে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা ৷ ছোট, বড়, মাঝারি, নানা ধরনের নৌকা তৈরি হত হুগলির বলাগড়ে ৷ এখান থেকে নৌকা যেত সেই সময়ের বিহার-সহ ভারতের বহু জায়গায়। সারা বছর এই কাজে ব্য়স্ত থাকতেন হাজার হাজার নৌকা শিল্পী ৷ জেলার এই ছোট্ট জনপদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পাঁচশো বছরের নৌকা শিল্পের ইতিহাস ৷
সেদিন গিয়েছে ৷ নৌকাশিল্পে ভাটা পড়েছে ৷ বদলেছে বলাগড়ের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ৷ তবে এখনও নৌকা তৈরিই জীবিকা এলাকার কয়েকশো মানুষের ৷ টিমটিম করে বলাগড়ে নৌকা তৈরি টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা ৷ আগামী সোমবার ভোট হুগলি কেন্দ্রে ৷ আর এই ভোটে বলাগড় বিধানসভার অন্তর্গত বিভিন্ন বুথে সকাল থেকে ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন এই নৌকাশিল্পীরা ৷ হুগলির ভোট বিন্যাসের খবর রাখা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বলাগড়ের এই নৌকাশিল্পীদের ভোটে যে কোনও প্রার্থীর কাছেই কাঙ্খিত ৷
এই কেন্দ্রের তিন প্রধান প্রার্থীর মধ্যে দু'জন তারকা ৷ একজন দিদি নম্বর ওয়ান খ্যাত তৃণমূলের রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ যিনি প্রচারের শুরু থেকে হুগলির মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন ৷ আরেকজন অভিনেত্রী তথা এই আসনের বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় ৷ যাঁর বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রের একাধিক বিধানসভা থেকে ৷ এমনকী হুগলির আনাচে-কানাচে লকেটের নামে নিখোঁজ পোস্টারও পড়েছিল ৷ তৃতীয় জন সিপিআই(এম)-এর মনোদীপ ঘোষ ৷ জেলার পোড়খাওয়া বামপন্থী নেতা, যাঁকে হুগলিতে সিপিআই(এম)-এর অবিসংবাদিত নেতা রূপচাঁদ পালের উত্তরসূরি বলা হয়ে থাকে ৷
বর্তমান বলাগড়ে নৌ-শিল্পীদের দুরবস্থা
বলাগড় বিধানসভায় হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজির সঙ্গে জড়িয়ে নৌ-শিল্প ৷ এই শিল্পকে আঁকড়ে সংসার চলে বহু মানুষের ৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নৌকার প্রয়োজন অনেকটাই কমেছে ৷ এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকার নৌ-শিল্পের জন্য সমবায়ের ব্যবস্থা করেছে ৷ তাতে আখেরে কোনও উপকার পাচ্ছেন না, অভিযোগ শিল্পীদের ৷ বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর দাবি, রাজ্য সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ৷ কিন্তু নৌ-শিল্পের পরিধি কমেছে ৷ আর বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় পালটা কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বকর্মা যোজনার আশা দিয়ে দায় সেরেছেন ।
সপ্তগ্রামে এই নৌ-শিল্পের বিরাট বাজার ছিল ৷ হুগলি নদী ও তার অসংখ্য শাখা, উপ-নদী দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচলের মাধ্যম ছিল নৌকা ৷ মাছ ধরা কিংবা ব্যবসার জন্য কাঠের নৌকা ব্যবহার করা হত ৷ বলাগড়ে নৌকা তৈরির 36টি কারখানা থেকে এখন কমে 22টিতে ঠেকেছে ৷ পাঁচশো শিল্পী ও শ্রমিক নৌকা তৈরির কাজ করেন ৷ সারাদিন খেটে 400 টাকা মজুরি পান ৷
সাধারণত শাল, সেগুন কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হত ৷ এখন শাল, বাবলা, সোনাঝুরির মতো গাছের শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হয় ৷ কাঠের একের পর এক পাটাতন এক বিশেষ ধরনের পেরেক (জলুই) দিয়ে জুড়ে নৌকা বানানো হয় ৷ 15 ফুট থেকে 33 ফুট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হয় নৌকার ৷ কাঠের মান, নৌকার আকৃতি- এসব কিছুর উপর নির্ভর করে একেকটি নৌকার দাম 20 হাজার থেকে ক্ষেত্র বিশেষে 1 লক্ষ 20 হাজার টাকা পর্যন্ত হয় ৷ কখনও কখনও একটি নৌকা 6 দিনে তৈরি হয়ে যায় ৷ আবার 20 দিন সময়ও লাগতে পারে ৷
বলাগড় বোট ইন্ডাস্ট্রি কো-অপারেটিভ লিমিটেডের চেয়ারম্যান তথা ব্যবসায়ী নিতাই প্রামাণিক বলেন, "2000 সালের বন্যার পর থেকে নৌকা শিল্প আর চলছে না ৷ সরকারি রেজিস্ট্রেশনে এই সংস্থার নাম থাকলেও কোনও আর্থিক সাহায্য আসেনি ৷ মৃতপ্রায় এই শিল্পে পরবর্তী প্রজন্ম অনীহা দেখাচ্ছে ৷ এমনকী, নৌকা তৈরিতে পরিশ্রমের দরুন সেইমতো মজুরিও মিলছে না শ্রমিকদের ৷ বর্ষার সময় যেটুকু ব্যবসা হয় ৷ সারা বছর সেভাবে চলে না ৷ এখানে কুড়ি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত নৌকা বিক্রি হয় ৷ কিন্তু বাজার নেই এই শিল্পের ৷ যদি রাজ্য বা কেন্দ্র আমাদের সমবায়ের মাধ্যমে কারখানা অনুদান ও ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে এই শিল্পের পুনর্জীবন ঘটতে পারে ৷"
নৌকার কারিগর শৈলেন প্রামাণিকের আক্ষেপ, কাজ অনুযায়ী আয় হয় না ৷ বলাগড় থেকে অনেক জায়গায় নৌকা যায় ৷ এখন সেই চাহিদা কমেছে ৷ প্রশাসনের তরফে সরকারি সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হলেও কিছু মেলেনি ৷ নৌকা শিল্পের অবহেলার পিছনে এলাকার বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্য়ায়ের অনীহা থাকার অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী ৷ বিধায়ক বলেন, "এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য রাজ্য সরকারের তরফে যে যে উদ্যোগ নেওয়া যায়, সেটা করা উচিত ৷ এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নৌকার যে অর্ডারগুলি দেওয়া হয়, তার উপর নজরদারি দরকার ৷" হুগলির বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্বকর্মা যোজনা প্রসঙ্গে তৃণমূলের বিধায়ক বলেন, "পাঁচ বছর পর এখন নৌকা শিল্পের কথা মনে পড়েছে ৷ তিনি তো ভোটে জিতেছিলেন এই শিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলেই ৷ শুধু মুখের কথা বলে গেলে হবে না ৷ যোগ্য লোককে দায়িত্ব দিতে হবে ৷"
যদিও এলাকায় সাংসদের অনীহার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজেপি নেতা সুরেশ সাউ ৷ তিনি জানান, জেলাশাসকের অফিসে সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বারবার এই শিল্পের উন্নতিকল্পে নানা কাগজ জমা দিয়েছেন ৷ কিন্তু জেলা প্রশাসন কাজ করেনি ৷ যদি রাজ্য প্রশাসন নৌকা শিল্পকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসত, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা আরও ভালো থাকতে পারতেন ৷ শিল্পটাও বেঁচে যেত ৷ 20 মে হুগলির ভোটে লাইনে দাঁড়ানো নৌ-শিল্পীরা কাকে বেছে নেবেন, সেটা হয়তো জানা যাবে 4 জুনের পর ৷ তবে এই ভোটের ফলাফলের দিকে তাঁরা অনেকেই তাকিয়ে থাকবেন, এটা বলাই বাহুল্য ৷ যদি নতুন সাংসদ নৌ-শিল্পের দিকে আরও একটু নজর দেন ৷
আরও পড়ুন