কলকাতা, 8 এপ্রিল: তখন বাম আমল ৷ রাজ্যের চারদিক লালে লাল ৷ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর কোনও কোনও সংবাদপত্র লিখত, 'লাল বাংলা আরও লাল ৷' তবে সেই প্রবল বাম ঝড়েও বিরোধীদের প্রাসঙ্গিক থাকার অক্সিজেন দিয়ে এসেছে শহর কলকাতা ৷ শহরের দক্ষিণের তুলনায় উত্তর কলকাতায় বামেদের শক্তি বেশি থাকলেও বিরোধীরাও টক্কর দিয়েছে সমানে সমানে ৷ সে রকমই একটি কেন্দ্র কলকাতা উত্তর ৷ এখানে এবার লড়াইটা জমজমাট। বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীতে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেই উত্তর কলকাতার লড়াই আরও জমিয়ে দিয়েছেন তাপস রায়। এই দু'জন ছাড়াও আছেন কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য ৷ 4 জুন কার মুখে হাসি ফোটাবে এই বনেদি এলাকা তার আভাস দিচ্ছে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিপোর্ট কার্ড।
উত্তর কলকাতায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও নতুন নাম নয়। প্রথমে এই কেন্দ্রর নাম ছিল উত্তর-পূর্ব কলকাতা ৷ পরে 2009 সালে নাম হয় কলকাতা উত্তর ৷ সেই থেকে টানা তিনবার জিতেছেন সুদীপ ৷ আগে আরও দু'বার জিতেছেন ৷ এমন একজন নেতার রিপোর্ট কার্ডের দিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে থাকেন সকলে।
বিগত পাঁচ বছরে সাংসদ হিসেবে কাজ করার জন্য 17 কোটি টাকা পেয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ। আসুন এবার দেখে নিই। সেই টাকা খরচ থেকে শুরু করে সংসদের ভিতরে এবং বাইরে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারফরম্যান্স কেমন? সুদীপ শুধু উত্তর কলকাতার সাংসদ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা ৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই বিগত পাঁচ বছর লোকসভায় তৃণমূলের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন সুদীপই। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল হাজিরা অথবা প্রশ্ন করা এবং বিতর্কে অংশ নেওয়ার দিক থেকে জাতীয় গড়কে ছাপিয়ে যেতে পারেননি তৃণমূল সাংসদ।
সংসদে সাংসদদের হাজিরার গড় ছিল 79 শতাংশ। এখানে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাজিরা ছিল 73 শতাংশ। একইভাবে বিতর্কে অংশগ্রহণের হিসেব দেখলে সাংসদের অংশ গ্রহণের জাতীয় গড় যেখানে 46.7 শতাংশ। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 44টি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় ক্ষেত্রে সাংসদরা যেখানে কমবেশি 210টি করে প্রশ্ন করেছেন সেখানে সুদীপ কোনও প্রশ্ন করেন নি। একইভাবে প্রাইভেট মেম্বার্স বিলের বিতর্কে অংশগ্রহণে জাতীয় ক্ষেত্রে সাংসদদের গড় অংশগ্রহণ ছিল 1.5। সেখানেও খাতা খুলতে পারেননি সুদীপবাবু।
এবার আসা যাক তার উন্নয়ন তহবিল অর্থাৎ এমপি ল্যাডের খরচের হিসেবে। এক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে দু'বছর করোনার কারণে এমপি-ল্যাড বন্ধ থাকায় সাংসদেরা পেয়েছেন 17 কোটি টাকা করে। সুদীপবাবু সেই টাকাই পেয়েছেন। কিন্তু এই সম্পূর্ণ টাকা গত পাঁচ বছরে খরচ করতে পারেননি উত্তর কলকাতার সাংসদ। তবে তথ্য বলছে তাকে দেওয়া টাকার 64 শতাংশই খরচ করেছেন সাংসদ। টাকার হিসেবে খরচ করতে বাকি আছে 2 কোটি 79 লক্ষ টাকা।
আমরা সাংসদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছিলাম যে কোন খাতে কত টাকা তিনি খরচ করেছেন। তবে এ বিষয়ে কোনও তথ্য আমাদের দেননি সাংসদ। বরং আমাদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে লিফলেট এবং শ্বেতপত্রের মাধ্যমে সমস্ত তথ্য জানাবেন বলেছেন তিনি। তবে এলাকায় ঘুরে জানা গিয়েছে, উন্নয়ন তহবিল থেকে বাসস্ট্যান্ডের সংস্কার থেকে শুরু করে হাই মাস আলোর ব্যবস্থা এবং বস্তি উন্নয়ন, পুকুর সংস্কার, রাস্তার উন্নয়ন করেছেন ৷
বাকি থাকা কাজের তালিকাও বেশ দীর্ঘ ৷ পুরনো এলাকা বলে ড্রেন সংস্কারের কাজ হওয়া দরকার ছিল ৷ সেটা হয়নি ৷ আর তার জেরে এলাকায় এখনও জল জমার সমস্যা আছে ৷ সেই সূত্র ধরে মশাবাহিত রোগও ধাবা বসায় উত্তর কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায় ৷ এর পাশাপাশি স্থানীয়দের দাবি, এলাকার কয়েকটি প্রাচীন স্কুলের সংস্কার প্রয়োজন ৷ এবার জিতে এলে তিনি সেই কাজ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন সুদীপ ৷
উত্তর কলকাতায় আনাচে-কানাচে সাংসদ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতি প্রশ্নাতীত। উত্তর কলকাতার সাধারণ মানুষও মনে করছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ থাকাকালীন কিছু কাজ হয়েছে। তাঁকে সময়-অসময়ে নির্বাচনী ক্ষেত্রে দেখা যেত। তবে এলাকায় নিকাশীর উন্নয়ন হয়নি এমনটাও মনে করেন অনেকে। প্রশ্ন হল এই মার্কশিট অথবা জনগণ প্রকাশ্যে সাংসদ সম্পর্কে যা বলছেন, সেটাই কি আসল মূল্যায়ন? নাকি নির্বাচনী যুদ্ধে শেষ মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দেবে বিরোধীরা। তৃণমূল ছেডে় সদ্য বিজেপিতে তাপস রায় বা পাঁচ দশকের কংগ্রেসি প্রদীপ ভট্টাচার্যরা যে দারুণ লড়াই দেবেন তা আলাদা করে বলার দরকার নেই। তিন হেভিয়েটের লড়াইয়ে শেষ হাসি কে হাসন সেটাই এখন দেখার।
আরও পড়ুন: