ডায়মন্ড হারবার, 22 সেপ্টেম্বর: কালের নিয়মে উঠে গিয়েছে জমিদারির পাট । কিন্তু রয়ে গিয়েছে জমিদার আমলের বৈঠকখানা, ঘর ও দালান থেকে শুরু করে লোহার সিন্দুক । এহেন মণ্ডলদের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন থেকে ৷ ওইদিন গঙ্গা মাটি দিয়ে দেবীর কাঠামোর পুজো হয় ৷ মহালয়ার দিন হয় প্রতিমার চক্ষুদান ৷ পুরোহিত থেকে শুরু করে মৃৎশিল্পী ও ঢাকিরা বংশপরম্পরায় এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ৷
তৎকালীন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ ৷ অবিভক্ত বাংলার নবাব থাকাকালীন লবণ ও তাঁতের ব্যবসার রমরমা ছিল ৷ ডায়মন্ড হারবার শহরের নাম ছিল হাজিপুর । বারদ্রোণ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন অযোধ্যা রাম মণ্ডল ৷ তিনি ওই লবণ ও তাঁতের ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হন ৷ ব্যবসার টাকায় বারদ্রোণ, মন্দিরবাজার, ঘটকপুর, হটুগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি, মথুরাপুর, নামখানা-সহ একাধিক এলাকায় জমিদারি শুরু করেন ৷ সেই অযোধ্যা রামের বংশধর ছিলেন জমিদার গোলকচন্দ্র মণ্ডল ৷ 1866 সালে তিনি তৎকালীন হাজিপুরের বারদ্রোণ গ্রামে দুর্গাপুজো শুরু করেন ৷ এ বছর সেই পুজো 159 বছরে পড়ল ৷
আগের মতো জাঁকজমক না হলেও, নিয়ম মেনে দেবীর আরাধনা করেন মণ্ডল বাড়ির সদস্যরা ৷ বিশুদ্ধ নন্দীকেশ্বর রীতি মেনে পুজো হয় এখানে ৷ আগে অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় গুলি ছোড়া এবং নবমীতে পাঁঠাবলির রীতি ছিল ৷ তবে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির সঙ্গে সেই সব রীতিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ বারদ্রোণের জমিদার বাড়িতে সুবিশাল দালান বাড়ি তৈরি করেছিলেন গোলকবাবু ৷ অতীতে সেখানে পুজোর 4 দিন গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য কবি গানের আসর বসত ৷ মহাসপ্তমীতে এলাকায় ব্রাহ্মণ ভোজন ও মহানবমীতে কুমারী পুজোর চল ছিল ৷ তবে কুমারী পুজো হলেও, বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্রাহ্মণ ভোজনের রীতি ৷ আর প্রতিদিনই গ্রামবাসীদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হত জমিদার বাড়িতে ৷ জমিদার বাড়ির সামনে সুবিশাল সিংহদুয়ার রয়েছে ৷ যেখানে দিনরাত পাহারায় থাকতেন দু'জন দারোয়ান ৷
জানা যায়, সেই সময় বন্দুকের গুলির আওয়াজে শুরু হত সন্ধিপুজো ৷ বর্তমানে সেই প্রথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ ঘরের পুরু দেওয়ালে ছিল রকমারি সব কারুকাজ । সমগ্র বাড়িতে ছিল 33টি কক্ষ । দারোয়ান, জমিদারের পালকি বাহকদের জন্যও আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ছিল । কাছারিবাড়ির মূল প্রবেশপথের উঁচু তোরণের উপরে দু'পাশে মুখোমুখি দুটি সিংহমূর্তি রয়েছে । আর ফটকের ঠিক উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশ । সদর দরজার পূর্বদিকে লম্বা বারান্দা । জমিদারের কাছারিবাড়িতে ঢোকার মূল ফটকের দু'দিকে থাকত গাদা বন্দুকধারী দুই দারোয়ান । জমিদার বাড়িতে টাকাপয়সা ও সোনাদানা রাখার জন্য ছিল বড় বড় চারটি লোহার সিন্দুক । ওই সিন্দুকের পাশে রাখা থাকত কাতান । ডাকাতির সময় যাতে ওই কাতান সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারা যায় । সে এক রূপকথার গল্প । প্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও আজও জমিদার বাড়ির সেসব চিহ্নের কিছু কিছু অবশিষ্ট রয়েছে । পরিবারের সদস্যদের অনেকেই এখন কর্মসূত্রে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন ।
পুজোর সময় দালানবাড়িতে নিয়ম করে আসতেন সকলেই । প্রতিবছর পুজো উপলক্ষে মণ্ডল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি করে পত্রিকা প্রকাশিত হয় । যেখানে নির্ঘণ্ট ছাড়াও পুজোর ইতিহাস লেখা থাকে । বিকাশ মণ্ডল জানান, আগে সন্ধিপুজোর সময় তিনি বাড়িতে গান ফায়ার দেখেছেন । দেখেছেন পাঁঠাবলিও । কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে । পরিবারের মহিলা সদস্য চিত্রা মণ্ডলের কথায়, "অতীতের সেই জৌলুস ফিকে হলেও এখনও প্রাচীন রীতিনীতি মেনে মণ্ডল বাড়ির পুজোর চলে আসছে । পুজোর চারটে দিন পরিবারের মহিলাদের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে । নৈমিত্তিক থেকে শুরু করে বিজয় দশমী পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন তাঁরা ।
পরিবারের আরেক সদস্য নচিকেতা মণ্ডল জানান, জমিদারি প্রথা উঠে যেতেই পঞ্চাশের দশক থেকে বন্ধ হয়ে যায় পাঁঠাবলি ৷ এখন শুধু নিয়মরক্ষার পুজো হয় ৷ এই পুজোর বিশেষত্ব হচ্ছে, বিশুদ্ধ নন্দীকেশ্বর মতে এই পুজো করা হয় ৷ সপ্তমীর দিন যে হোম-অগ্নি জ্বলে, তা নেভানো হয় দশমীর দিন ৷ অতীতের সেই হারানোর জৌলুস ফিরে পেতে চেষ্টা চালাচ্ছে মণ্ডল বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা ।
এই বিষয়ে অভীক মণ্ডল বলেন, "অতীতে যে প্রথা চলত তা এখন আর নেই ৷ কিন্তু সেই হারানো গৌরব আমরা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি । কালের নিয়মে অতীতের অনেক কিছুই আমরা হারিয়েছি কিন্তু অতীতের সেই প্রাচীন রীতিনীতি আমরা এখনও ভুলিনি, আমরা আমাদের প্রবীণ প্রজন্মের কাছ থেকে অতীতের সমস্ত প্রাচীন রীতিনীতি শিখছি এবং জানছি । আমরা এখন থেকে এই পুজোর নানারকম কাজে হাত লাগাই । বিদেশে যে সকল আমাদের আত্মীয়-স্বজন আছে তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানাই ৷ তাঁরাও আসেন । সব মিলিয়ে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে পুজোর পাঁচটা দিন কীভাবে যে কেটে যায় আমরা বুঝতে পারি না ।"