কৃষ্ণনগর, 25 অগস্ট: মৃৎশিল্পের জন্য জগতখ্যাত কৃষ্ণনগর ৷ সেই কৃষ্ণনগরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে মৃৎশিল্প ৷ আর তা যাতে না হয় তাই মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ঘূর্ণি তথা কৃষ্ণনগরের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি জানালেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পী সুবীর পাল ৷
তাঁর কথায়, "মৃৎশিল্পের উন্নয়ন থেকে আজও অনেকটা পিছিয়ে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি ৷ কারণ মৃৎশিল্পের জন্য পরিকাঠামোগত কোনও উন্নয়ন নেই সেখানে । নেই কোনও আর্ট কলেজ, নেই মৃৎশিল্পের সংগ্রহশালা । যার ফলে আগেকার দিনের কিংবদন্তি শিল্পীদের হাতের নিপুণ কাজ আজ হারিয়ে যাচ্ছে । শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েও পারছেন না বর্তমান প্রজন্ম । সংগ্রহশালা থাকলে সেগুলি দেখে বর্তমান সমাজ অনেক উৎসাহিত হতে পারত ।"
মৃৎশিল্পীর দাবি, অন্যান্য জায়গার থেকে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি এখন অনেক পিছিয়ে । কারণ এখানে নেই কোনও পর্যাপ্ত থাকার জায়গা, নেই ভালো খাবারের জায়গা, তার সঙ্গে টাকা তোলার জন্য নেই এটিএম পরিষেবাও । সুতরাং দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা এসে যে ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু পাওয়ার আশা রাখে, তা পূরণ হয় না ৷ নিরাশ হয়ে ফিরে যায় তারা । তাহলে কেন মানুষ আসবে এই ঘূর্ণিতে ?
সুবীর পালের পরামর্শ, যদি মৃৎশিল্পীকে বা মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে হয় প্রথমেই দরকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন । ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মৃৎশিল্পের দিকে এগিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে কৃষ্ণনগরে একটি আর্ট কলেজ এবং মিউজিয়ামের দরকার । তার কারণ আগেকার দিনে বাবা-কাকাদের কাছ থেকে হাতে এবং দেখে শিক্ষা পেয়েছেন সুবীর পালেরা । তবে বর্তমানে কীভাবে নতুন প্রজন্ম মাটির কাজের প্রতি আগ্রহী হবে ? যদি আর্ট কলেজ বা মিউজিয়াম না থাকে । তাই এই দুটি জিনিস বর্তমানে কৃষ্ণনগরে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন তিনি ।
শিল্পী জানান, বর্তমান সরকারের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে একটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল ঠিকই । কিন্তু বর্তমানে সেটি আর মিউজিয়াম হিসাবে গ্রহণ করা হয় না । বহু টাকা ব্যয় করা হয়েছে ওই মিউজিয়ামের জন্য । ভেতরে রাখা হয়েছে দামি আসবাবপত্র । রাজ্য সরকারের দেওয়া 'মৃত্তিকা' নামের মিউজিয়াম আজ কোনও মৃৎশিল্পের নিদর্শন থাকে না । বর্তমানে সেটি কেবল বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাড়িতে ভাড়া দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়, যা একেবারেই একটি শিল্পীর কাছে লজ্জাজনক ব্যাপার ।
সালটা 1992 ৷ ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মার হাতে মৃৎশিল্পের উপর অভাবনীয় কাজের জন্য পুরস্কৃত হন কৃষ্ণনগরের সুবীর পাল । তারপর থেকে মৃৎশিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে একের পর মূর্তি তাঁর হাতে হয়েছে প্রাণবন্ত । সামনেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো । পটুয়া পাড়ার শিল্পদের এখন দম ফেলার সময় নেই । হাতে সময় নেই রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পী সুবীরেরও ।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে তাঁর স্টুডিয়োতেও চলছে মাতৃমূর্তি তৈরির কাজ । শেষ মুহূর্তে যাতে কোনও রকম অসুবিধে না হয় তার জন্য দিন রাত এক করে এই কাজ চলছে । নামমাত্র কয়েকটা মূর্তির বরাত পান প্রতিবছর ৷ নিজের হাতেই সেই মূর্তিগুলিকে রূপদান করেন সুবীর পাল ৷ এবারও তেমনটাই হচ্ছে । তবে কয়েকটির মধ্যেও রয়েছে বিদেশে মূর্তি পাঠানোর বরাত । কিন্তু মৃৎশিল্পকে সমাজের কাছে বেশি করে তুলে ধরতে আজও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর ভরসা রাখেন ওই মৃৎশিল্পী ৷ স্বপ্ন দেখেন নতুন সূর্যোদয়ের ।
কৃষ্ণনগরের সার্বিক সৌন্দর্যায়ন প্রসঙ্গে সুবীর পাল বলেন, "যেহেতু এটি মৃৎশিল্পের স্বর্গ তাই কৃষ্ণনগরের রাজপথের দু'দিকে শিল্পের নিদর্শন রাখা অত্যন্ত জরুরি । আজ স্টেশনে নেমে মানুষকে লেখা পড়ে বুঝতে হয় এটা কৃষ্ণনগর শহর । কিন্তু সেখানেও যদি মৃৎশিল্পের ছোঁয়া থাকে তাহলে মানুষের আরও মৃৎশিল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে ।"
তাঁর বক্তব্য, "বর্তমানে নদিয়ার মায়াপুর ইসকন মন্দিরে জলপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে পর্যটকদের ভিড় জমে । যদি রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়ে কৃষ্ণনগর জলঙ্গি নদীর পাশে থাকা ঘূর্ণিতে জলপথে একটি স্টপেজ তৈরি করে, তাহলে পর্যটকের আনাগোনা বাড়বে । সেখানে শুধু মৃৎশিল্পের অগ্রগতি হবে না,ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে কিছু বেকার মানুষ রুজি রোজগারের পথ খুঁজে পাবে ।" এর পাশাপাশি তিনি জানান, যদি জলঙ্গি নদীর দু'দিকে সুন্দর করে মৃৎশিল্পের কাজ তুলে ধরা যায় তাহলে মানুষ আগ্রহী হবে মৃৎশিল্পের প্রতিও ।