কলকাতা, 21 জানুয়ারি: কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াচ্ছেন মানুষজন । মিলছে না বইয়ের পাতার ইতিহাস ! দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে দাড়িই ওঠেনি মার্ক্সের । আবার মাথা ভরা চুল লেনিনের । অথচ, গ্রামশির মাথা ন্যাড়া । আবার চে ফোকলা দাঁতে হাসছে । হো চি মিনের থুতনিতে আবার নেই দাড়ি...! তালিকাটা দীর্ঘ ।
মমি থেকে জীবাশ্ম । 'প্রাচীন' পৃথিবীর নানা ইতিহাস সযত্নে লালিত কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে । যা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, পাঁচ হাজার, দশ হাজার বছর আগের পৃথিবীটা কেমন ছিল, কেমন দেখতে ছিল তখনকার জিনিসপত্র । এ সব কিছু পুরাতন হলেও জীর্ণ নয় ৷ ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে কেউ যদি এখন জাদুঘরের টেক্সটাইল গ্যালারিতে প্রবেশ করেন, তাহলেই তাঁর জন্য চমক অপেক্ষা করে আছে ৷
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, জাদুঘরে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিস এল কোথা থেকে ! আসলে সেখানেই দেওয়ালে টাঙানো আছে একাধিক ছবি । ফ্রেমের নীচে সেই ছবিগুলির ব্যক্তিদের নাম লেখা । জ্বলজ্বল করছে স্ট্যালিন, লেনিন, হো চি মিন, কার্ল মার্ক্স, চে গেভারা ও গ্রামশির নাম ।
নামগুলো পড়েই যে মুখগুলো মনের কোণে ভেসে উঠবে, তার সঙ্গে জাদুঘরের টেক্সটাইল বিভাগের দেওয়ালে টাঙানো ছবির কোনও মিল পাবেন না । স্ট্যালিন লেখা ছবির ব্যক্তিটির ব্যাকব্রাশ করা বাদামি চুল নেই, তীক্ষ্ণ চোখ আর গোঁফে ঢাকা শক্ত চোয়ালও নেই । জাদুঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবির স্ট্যালিন মৃদু হাসছে । তাঁর খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি আর মাথায় অল্প চুল ।
অন্যদিকে, চে গেভারা লেখা ছবির মানুষটি হাসছে ফোকলা দাঁতে । হো চি মিনের থুতনিতে আবার দাড়ি নেই । সেখানকার ছবির লেনিনের আবার প্রশস্ত কপাল নয়, বরং মাথা ভরা চুল । জাদুঘরের ছবির গ্রামশির আবার একমাথা চুল নেই, ন্যাড়া মাথা । কার্ল মার্ক্সের আবার দাড়িই ওঠেনি । অথচ, ছবিগুলির পরিচয়ও মিথ্যে নয় । প্রত্যেক ফ্রেমে যে ব্যক্তি আছেন, তাঁরই নাম ছবির নীচে লেখা রয়েছে ৷ তাঁদের অস্তিত্ব বর্তমান ।
ছবিগুলি দেখে প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারছেন না বিষয়টা কী । কেউ কেউ ভাবছেন, কিছু একটা ব্যাপার আছে । কেউ আবার ইতিহাসের বিকৃতি ভেবে প্রথমে রেগে যাচ্ছেন । আবার কেউ দিশেহারা হয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে এনে বলছেন, তৎক্ষণাৎ এই 'ভুল' ঠিক করা দরকার । তবে ভুল হলে ভুল ঠিক করার প্রশ্ন উঠছে ৷ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সবাইকে জানাচ্ছেন, কোনও ছবিতে কোনও ভুল নেই । ফলে ভুল শোধরানোর ব্যাপারও নেই ।
আসলে জাদুঘরের টেক্সটাইল গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনী চলছে ৷ তার কিউরেটর সায়ন্তন মৈত্র বলেন, "কোনও ভুল নেই । যাঁদের ছবি রাখা রয়েছে, ওঁদের নাম ওটাই । কেন ? পৃথিবীতে কি একজনের নামই লেনিন বা স্ট্যালিন ?" এই অকাট্য যুক্তির কাছে কেউ আর টুঁ শব্দটুকু করতে পারছেন না ।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে কিউরেটর সায়ন্তন মৈত্র বলেন, "কেরলের বিখ্যাত শিল্পী বিবেক বিলাসিনির কাজ এটা । কেরলে ওঁর বাবার গ্রামের বিভিন্ন মানুষের ছবি । এঁদের সকলের নাম এগুলোই । উনি এঁদের ছবি তুলেই আনন্দ পান । সারা পৃথিবীতেই উনি ওঁর এই ধরনের মজার কাজের জন্য জনপ্রিয় । আমরা দেখার চেষ্টা করছি, এগুলো দেখে মানুষ কী প্রতিক্রিয়া দেন ?"
মার্ক্স-লেনিন-স্ট্যালিন নিয়ে সর্বক্ষণ চর্চা করা বাম নেতারা এই কাণ্ডকে 'ইন্টারেস্টিং' হিসেবেই দেখছেন । সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "দক্ষিণ ভারতে এরকম চল রয়েছে । আমি নিজে দেখেছি, বাড়ি বাড়ি অনেকের নাম সুভাষ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর । কেরলে তো অনেক মানুষের নাম এরকম রয়েছে । আসলে কিছুই না, অনেকে তাঁর সন্তানদের নাম কোনও শ্রদ্ধেয় মানুষের নামে রাখতে চান । এটা তারই উদাহরণ ।" উল্লেখ্য, এই প্রদর্শনী দেখে বাম নেতারা অনেকেই মনে করছেন, বাম গড় কেরলে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতাদের নামে বাড়ির সন্তানদের নাম রাখার চল রয়েছে ৷
ভারতীয় জাদুঘরে সনাতনী শিল্পকর্মের পাশাপাশি আধুনিকতার মেলবন্ধনে একটি প্রদর্শনী চলছে । এই ছবিগুলি ওই প্রদর্শনীর অঙ্গ বলে জানিয়েছেন ভারতীয় জাদুঘরের ডেপুটি ডিরেক্টর সায়ন ভট্টাচার্য । তিনি বলেন, "এই প্রদর্শনীটি গত 11 জানুয়ারি ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতা বসু ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টসের সহযোগিতায় ভারতীয় সমসাময়িক ও লোকশিল্পের প্রদর্শনী । যার নাম রাখা হয়েছে 'ডায়লগস অ্যাক্রস টাইম'৷ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং সবচেয়ে আইকনিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাদুঘরের গৌরবময় বছরগুলিকে সম্মান ও উদযাপন করার জন্যই এই প্রদর্শনীর আয়োজন ৷ এর উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত ।" প্রদর্শনীটি চলবে আগামী 31 মার্চ পর্যন্ত।