কলকাতা, 22 জানুয়ারি: আরজি কর কাণ্ডের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিআই(এম) চেয়েছিল নিজেদের পালে হাওয়া টানতে, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উলটো । শহরাঞ্চলের বিক্ষোভে পতাকা ছাড়া দলের নেতৃত্ব মিছিল-জমায়েত সংগঠিত করলেও, আরজি কর নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্দোলন যে বস্তুত গ্রামবাংলায় বা মফঃস্বলে তাদের কোনও বাড়তি অক্সিজেন যোগায়নি, তা গতবছর নভেম্বরের উপনির্বাচনেই স্পষ্ট । ছ'টি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সিপিআই(এম) ।
বারবার কেন এমন নির্বাচনী ভরাডুবি হচ্ছে, সেই কারণ খুঁজতে গিয়ে নেতৃত্ব দেখছেন, শহুরে মানুষ আন্দোলনে সামিল বামেদের পাশে থাকলেও, গ্রামীণ বাংলায় তার কোনও প্রভাব পড়ছে না । জনবিচ্ছিন্নতার পুরনো রোগ আজও সারেনি । এই অবস্থার পরিবর্তনে নব্য প্রজন্মের 'টুম্পা সোনা' বা 'জামাল কুদু'র মতো প্যারোডি কিমবা সমতা এআই বানিয়েও ভোটারদের মনে জায়গা ফিরে পেতে ব্যর্থ হয়েছে সিপিআই(এম)৷

এবার আরও এক নয়া প্রচেষ্টায় প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের দল ৷ আধুনিক যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, তারা ডিজিটাল মাধ্যমের হাত আরও শক্ত করে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বঙ্গে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া লাল দুর্গ পুনরুদ্ধারে দল এবার থেকে রাজ্যের বড় শহরের বিক্ষোভ-আন্দোলনের পাশাপাশি গ্রাম বাংলা, আধা-শহর ও মফঃস্বলের দলীয় নেতৃত্বের কাজও তুলে ধরবে দলের ডিজিটাল মাধ্যমে ।
সূত্রের দাবি, বাংলায় বামপন্থার পুনর্জাগরণ করতে হবে বলে প্রচার করা হচ্ছে । তবে এই বক্তব্য সবটাই পোশাকি । আসল লক্ষ্য, 2026-এর বিধানসভা ভোটে 'শূন্যের কলঙ্ক' থেকে মুক্তি । যে কারণে সিপিআইএম ডিজিটালকে ঢেলে সাজানোর কাজ চালাচ্ছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা । মূলত, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে বুথ লেভেল থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত ডিজিটাল টিম গঠন করা হয়েছে । দলের একটি পৃথক অ্যাপও তৈরি হওয়ার পথে বলে খবর ৷
সূত্রের দাবি, জেলা এবং রাজ্যস্তর মিলিয়ে 550 জনেরও বেশি 'সৈনিক'কে হাতে ধরে শেখানো হয়েছে কীভাবে কাজ করতে হবে । কত দ্রুত ভিডিয়ো এডিট করা যায়, সামাজিক মাধ্যমে কীভাবে বিভিন্ন পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া যায়, অরগ্যানিক ভিউ বাড়াতে কীভাবে হ্যাশট্যাগ বা প্রয়োজনীয় টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ।
সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির এক নেতা এবিষয়ে বলেন, "চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল 2019 সাল থেকেই । ধাপে ধাপে এগোন হচ্ছে । ইতিমধ্যে, সীতারাম ইয়েচুরি ক্যাডার ডেভলপমেন্ট স্কিমের আওতায় কন্টেন্ট রাইটার, গ্রাফিক ডিজাইনার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ নেওয়া হয়েছে, যাঁরা এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করবেন । কিন্তু, কোনওভাবেই সরাসরি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট বা সিস্টেমের রাশ তাঁদের হাতে থাকবে না । তাঁদের থেকে শুধু পরামর্শ নেওয়া হবে । তাঁরা যা বলবে তেমনটা হবে, তা কিন্তু নয় ।"
দক্ষিণ কলকাতার এক সিপিআই(এম) নেতা বলেন, "সিপিআই(এম) ডিজিটাল টিমে রাজ্যস্তরে 50 জন ক্যাডার রয়েছেন । এছাড়াও, কালিম্পং বাদে কম-বেশি প্রত্যেকটি জেলা, সংসদীয় এলাকায় কমপক্ষে 10 জন বা তার বেশি ডিজিটাল সৈনিক নিযুক্ত করা হয়েছে, যাঁরা পার্টির সদস্য, যাঁরা আবার বিভিন্ন এরিয়া কমিটি বা বুথ লেভেল থেকে ইনপুট নেবেন । নিজেরাই ইস্যু ভিত্তিক পোস্টার, ভিডিয়ো, রিলস তৈরি করবেন, আবার সামাজিক মাধ্যমে পোস্টও করবেন । তিনি প্রয়োজনে পরামর্শ নিতে পারেন রাজ্য নেতৃত্বের থেকে ।
এই ভাবেই কি আগামী দিনে কেন্দ্রীয় ভাবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে কাজ হবে । সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "বিভিন্ন ইস্যুতে সিপিআই(এম) কী করছে ? কিচ্ছু করছে না বলে অভিযোগ ওঠে । এবার আর সেই সুযোগ থাকবে না । বড় ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জেলা বা বুথ লেভেলেও আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি, তার লাইভ সম্প্রচার হবে । জেলার ঘটনায় কলকাতা বা রাজ্যের নেতার প্রতিক্রিয়া নেওয়ার আগেই সেই নির্দিষ্ট ঘটনায় জেলা সম্পাদক বা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তরা কী করছেন, তা সরাসরি তুলে ধরা হবে । এজন্য, ছাত্র, যুব, মহিলা সমস্ত সংগঠন নিজ নিজ কাজ করবে । আমরা রাজ্যস্তরে তৈরি । কয়েকটি জেলার কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ায় শুরু করা যাচ্ছে না ।"
বিষয়টি আরও খোলসা করে বুঝিয়ে দেব সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির আর এক নেতা । তিনি বলেন, "ধরুন, আরজি কর নিয়ে কলকাতাতে বড় আন্দোলন চলছে । সিপিআই(এম) সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে । তার যেমন প্রতি মুহূর্তের আপডেট পাওয়া যাবে; তেমনই নির্দিষ্ট জেলার নির্দিষ্ট কোনও ঘটনায় সেখানকার কমরেডরা কী করছেন, কীভাবে আন্দোলন চলছে, তার ছবি ও ভিডিয়োও তুলে ধরা হবে । ব্যবসায়িক সংবাদ মাধ্যমের বিকল্প সিপিএম ডিজিটাল গড়ে তুলছে।"
কিনতু গোটা প্রক্রিয়া চালাতে গেলে বিপুল অর্থ ও লোকবলের প্রয়োজন । সূত্রের দাবি, এই প্রক্রিয়া সফল করতে প্রয়োজনীয় লজিস্টিকসের ব্যবস্থা করা হয়েছে । হচ্ছেও । সূত্রের দাবি, ভিডিয়ো এডিটিং, পোস্টার মেকিং-সহ ডিজিটাল কাজের জন্য ইতিমধ্যে 16টিরও বেশি কম্পিউটার/মেশিন কেনা হয়েছে । কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরও কয়েকটি দামি ও ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটার ঢুকবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআই(এম) ডিজিটাল রুমে ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রবীণ নেতা কিংবা তরুণ হোলটাইমারদের টেক স্যাভি করতে নামীদামি গ্যাজেটও দিতে পারে দল । সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির এক নেতার কথায়, "অনেকে 40 বছর রাজনীতি করার পর বুঝতে পারছেন, এখন পরিস্থিতি বদলেছে । কয়েকদিন বাদে যদি পলিটব্যুরো নেতাদের হাতে আইফোন, আইপ্যাড দেখতে পান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই । দল সেভাবেই এগোতে চাইছে ।"
কিনতু, এতকিছুর পর 2026 শূন্যের কলঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, সিপিআই(এম) শূন্য হলেও তৃণমূল-বিজেপি তাদের অস্বীকার করতে পারে না । তাই, সবকিছুই নির্বাচন কেন্দ্রিক নয় । ডিজিটাল টিমকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । একদিনে তা হবে না । তবে একদিন হবেই । তাই, তাড়াহুড়োর ব্যাপার নেই ।"