আসানসোল, 11 ফেব্রুয়ারি: বছর কয়েক আগেও কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আবর্জনাময়, নোংরা শহরের তকমা জুটেছিল আসানসোলের । এখন সেই শহরেই আসছে শীতের রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখিরা । শুধু তাই নয়, আসানসোলে এখন এমন পাখি আসছে, যারা কোনওদিন এই শহরে পা বাড়ায়নি ।
সম্প্রতি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় দামোদর নদীর ধারে আসানসোলে ধরা পড়েছে কমন মারগ্যানসার । অতীতে এই পাখি উত্তরবঙ্গের গাজলডোবা কিংবা ভাগলপুরে দেখা গিয়েছিল বলে পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন ৷ কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে কখনও এই পাখি দেখা যায়নি । কিন্তু কী কারনে এই পাখির হঠাৎ আগমন আসানসোলে ? তবে কি দুষিত শহরের তকমা পাওয়া আসানসোলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ? কারণ খোঁজার চেষ্টায় ইটিভি ভারত ।
শীতের পরিযায়ীরা দল বেঁধে আসানসোলে আগেও আসত । মূলত স্বাভাবিক ভাবেই সাইবেরিয়ান যে সমস্ত প্রজাতির পাখিরা শীতে সাঁতরাগাছি ঝিলে আসত, তেমন ভাবেই আসানসোলের রেলশহর চিত্তরঞ্জনের জলাধারে ঝাঁকে ঝাঁকে আসর বসাত পরিযায়ীর দল । কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরে দুটি মিশ্র চিত্র নজরে আসছিল । শুধু চিত্তরঞ্জন নয়, দামোদর নদের ধারে, আসানসোলের গুঞ্জন পার্কেও পাখির আনাগোনা একদিকে যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই সামগ্রিক ভাবে পাখি আসা কমে যেতেও শুরু করে । চিত্তরঞ্জন লেকে অস্বাভাবিক ভাবে পাখি কম আসতে শুরু করে গত কয়েক বছরে ।
পরিবেশবিদরা জানিয়েছিলেন, চোরা শিকারীদের পাখি শিকার, অপরিষ্কার ও কচুরিপানা ভর্তি জলাধারের কারণেই পাখি কম আসছে । কিন্তু ব্যতিক্রম এবছর । সম্প্রতি পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনদফতর ও একটি বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাখি সুমারিতে দেখা গিয়েছে, অতীতের মত পাখি আবারও আসছে আসানসোলের বিভিন্ন স্থানে। আসানসোলের দামোদর নদ, বরাকর নদ, চিত্তরঞ্জন হ্রদ, শতাব্দী পার্ক, গুঞ্জন পার্ক-সহ বিভিন্ন জায়গায় পাখি সুমারি হচ্ছে পয়লা জানুয়ারি থেকে 12 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত । তাতে নর্দান পিনটেল, গাডওয়াল, রুসিডেল ডাক, কমন পোচার্ড, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, লেসার হুইলিং-সহ নানা ধরনের পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলেছে । কিন্তু কমন মারগ্যানসার এই প্রথমবার শুধু পশ্চিম বর্ধমান জেলায় নয়, দক্ষিণবঙ্গেও এই রেকর্ড প্রথম ।
কীভাবে নজরে এল এই পাখি ?
আসানসোলের বিশিষ্ট ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় জানান, "জানুয়ারি মাসে আমরা তিনজন দামোদর নদের ধারে ভূতাবুড়ি মন্দির চত্বর এলাকায় পাখির ছবি তুলছিলাম । তখন মাথার উপর দিয়ে দুটি পাখি উড়ে যাচ্ছিল । আমার বন্ধু শুভম সেই পাখি দুটির ছবি তোলে খুব দ্রুত । জুম করে দেখতে গিয়ে আমরা চমকে যাই, প্রাথমিক ভাবে বুঝে যাই পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু তখনও নিশ্চিত ছিলাম না । এরপর পাখি দুটির ছবি পক্ষী বিশারদ ও বিভিন্ন পাখির গ্রুপে পাঠানো হয় । সব দিক বিচার করে জানা যায়, পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু এই পাখি এই জেলায় কখনও দেখা যায়নি । তবে এখন কেন আসছে । প্রাথমিক ভাবে আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তারা স্থান পরিবর্তন করার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাচ্ছে ।"
![ETV BHARAT](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wbasnsplbirdsstory_11022025161923_1102f_1739270963_770.jpg)
যে চিত্রগ্রাহকের হাতে প্রথম ওই দুটি পাখির ছবি ধরা পড়ে, সেই শুভম বন্দ্যোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে জানান, "ছবি তুলে যখন জুম করে দেখি, এত চমকে গিয়েছিলাম যে, ক্যামেরা হাত থেকে পড়ে যেত । পরে সেদিন আর তাদের দেখতে পাইনি । কিন্তু কয়েকদিন পর পুনরায় দামোদর নদে ছবি তুলতে গিয়ে দেখি কমন মারগ্যানসার নদীতে বসে মাছ খাচ্ছে । তখন আমরা নিশ্চিত হই পাখিগুলি ওই স্থানেই বিচরণ করছে । যা দারুণ বিষয় বলে আমাদের মনে হয়েছে । যে পাখিগুলি আমাদের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে সেগুলি প্রত্যেকটিই মহিলা প্রজাতির ।"
কমন মারগ্যানসার পাখির বৈশিষ্ট্য
পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন, এই পাখিগুলি মূলত উত্তর আমেরিকায় বেশি দেখা যায় । গাছের গর্তে বাসা বাঁধলেও এরা মূলত বড় হ্রদ, নদী, জলাশয় এবং সমুদ্রেও বিচরণ করে । এই পাখিগুলির প্রধান খাবার হল মাছ । পাখিগুলি 23 ইঞ্চি থেকে 28 ইঞ্চি লম্বা হয়, ডানা মেললে এদের পরিধি হয় 30 ইঞ্চির মতো । মূলত হাঁসের মতো দেখতে হলেও সাদা শরীরে গোলাপি আভা দেখা যায় । মাথায় কালো রঙের সঙ্গে সবুজ চকচক করছে । ঠোঁট ও পা হয় লাল থেকে বাদামি লাল । সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, আফ্রিকান ও ইউরেশিয়ান জলে থাকা পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের তালিকায় কমন মারগ্যানসার পাখির নাম নথিভুক্ত আছে ।
![ETV BHARAT](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wbasnsplbirdsstory_11022025161923_1102f_1739270963_566.jpg)
এমন বিরল পাখি আসানসোলে কেন এল তা নিয়ে নানা জল্পনা বেড়েছে । পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনাধিকারিক অনুপম খান জানিয়েছেন, "এমন একটি পাখি রেকর্ড হয়েছে আসানসোলে । হতে পারে পাখিটি অন্যত্র খাবার না পেয়ে এখানে চলে এসেছিল ।"
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এত সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন না পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা । 2022 সালেও আসানসোলের গুঞ্জন পার্কে দেখা গিয়েছিল উড ওয়ার্বলার । বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহক দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় উঠে এসেছিল এই বিরল পাখি । ই-বার্ড পোর্টালও সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল । জানা যায়, এর আগে উড ওয়ার্বলার পাখির দেখা মিলেছিল লাদাখে । সেই পাখি এল আসানসোলে । একই ভাবে কমন মারগ্যানসারও এর আগে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে দেখা যায়নি ।
![ETV BHARAT](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wbasnsplbirdsstory_11022025161923_1102f_1739270963_415.jpg)
পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় আরও জানান, "আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম পাখিগুলি স্থান পরিবর্তন করছে । কিন্তু যখন পরের বার নদীতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই তাদের শিকার করতে দেখলাম, তখন বুঝলাম সেগুলি দামোদরের তীরেই ঘাঁটি গেড়েছে অস্থায়ী ভাবে । পাখিগুলি মাইগ্রেশেনের জন্যই জায়গাটিকে নির্বাচিত করতে পারে ।
প্রশ্ন উঠছে, বারবার এই বিরল পাখিদের আনাগোনায় আসানসোলকে কি তবে পরিযায়ীরা নিরাপদ স্থান ভেবে নিচ্ছে ? কিন্তু দূষণে ভরা শহরে পাখিকূল কীভাবে আসছে । তবে কি জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ?
![ETV BHARAT](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/11-02-2025/wbasnsplbirdsstory_11022025161923_1102f_1739270963_40.jpg)
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আসানসোলের বায়ুর গুণগত মান উন্নত হয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে । কলকাতা, হাওড়া ও দুর্গাপুরকে পিছনে ফেলে আসানসোল উঠে এসেছে উপরের দিকে । তবে কি দূষণ কমে যাওয়াতেই রঙবেরঙের পাখি আসানসোলে ! সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়, শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়রা কিছুটা হলেও এই বিষয়ে সহমত ।
তবে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী ইটিভি ভারতকে ফোনে জানিয়েছেন, "আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে, এবছর যে পাখিগুলিকে দেখা গিয়েছে, তারা ক্রমাগত আসছে কি না । পাশাপাশি এদের যা খাদ্যাভাস সেটাও কতটা সেখানে পাওয়া যায় তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে । একবার একটা পাখি কোনও একটা মরশুমে আসছে, তার মানে সেই জায়গার দূষণ সূচক ভালো হয়ে গেল তা কিন্তু নয় । এটা অবশ্যই একটা দিক, আবার আবহাওয়ার তারতম্যও হচ্ছে । আগে আমরা দেখতাম, পরিযায়ী পাখিগুলো মার্চের শেষে ফিরে যেত । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফেব্রুযারিতেই তারা ফিরে যাচ্ছে । সেখান থেকে দলছুট হয়ে আসা বা তাদের রুটের পরিবর্তন করে কোনও পাখিকে দেখা গেলে একটা বছরের রেকর্ড ধরে এগোনো সম্ভব নয় । পরবর্তী বছর তাদের দেখা যাচ্ছে কি না, বা তারা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না এটা মনিটর করাটা জরুরি ।"