ETV Bharat / state

দূষিত শহরেও বিরল পাখির খোঁজ, দক্ষিণবঙ্গে প্রথম মারগ্যানসার এল আসানসোলে - COMMON MERGANSER IN ASANSOL

দূষিত শহরের তকমা পাওয়া আসানসোলে দেখা মিলল কমন মারগ্যানসারের । এই বিরল পাখির খোঁজ প্রথম মিলল দক্ষিণবঙ্গে ৷

ETV BHARAT
দক্ষিণবঙ্গে প্রথম মারগ্যানসার এল আসানসোলে (নিজস্ব চিত্র)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 11, 2025, 7:52 PM IST

আসানসোল, 11 ফেব্রুয়ারি: বছর কয়েক আগেও কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আবর্জনাময়, নোংরা শহরের তকমা জুটেছিল আসানসোলের । এখন সেই শহরেই আসছে শীতের রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখিরা । শুধু তাই নয়, আসানসোলে এখন এমন পাখি আসছে, যারা কোনওদিন এই শহরে পা বাড়ায়নি ।

সম্প্রতি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় দামোদর নদীর ধারে আসানসোলে ধরা পড়েছে কমন মারগ্যানসার । অতীতে এই পাখি উত্তরবঙ্গের গাজলডোবা কিংবা ভাগলপুরে দেখা গিয়েছিল বলে পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন ৷ কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে কখনও এই পাখি দেখা যায়নি । কিন্তু কী কারনে এই পাখির হঠাৎ আগমন আসানসোলে ? তবে কি দুষিত শহরের তকমা পাওয়া আসানসোলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ? কারণ খোঁজার চেষ্টায় ইটিভি ভারত ।

দূষিত আসানসোলেও বিরল পাখির খোঁজ (নিজস্ব ভিডিয়ো)

শীতের পরিযায়ীরা দল বেঁধে আসানসোলে আগেও আসত । মূলত স্বাভাবিক ভাবেই সাইবেরিয়ান যে সমস্ত প্রজাতির পাখিরা শীতে সাঁতরাগাছি ঝিলে আসত, তেমন ভাবেই আসানসোলের রেলশহর চিত্তরঞ্জনের জলাধারে ঝাঁকে ঝাঁকে আসর বসাত পরিযায়ীর দল । কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরে দুটি মিশ্র চিত্র নজরে আসছিল । শুধু চিত্তরঞ্জন নয়, দামোদর নদের ধারে, আসানসোলের গুঞ্জন পার্কেও পাখির আনাগোনা একদিকে যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই সামগ্রিক ভাবে পাখি আসা কমে যেতেও শুরু করে । চিত্তরঞ্জন লেকে অস্বাভাবিক ভাবে পাখি কম আসতে শুরু করে গত কয়েক বছরে ।

ETV BHARAT
দূষিত আসানসোলেও বিরল পাখির খোঁজ (নিজস্ব ভিডিয়ো)

পরিবেশবিদরা জানিয়েছিলেন, চোরা শিকারীদের পাখি শিকার, অপরিষ্কার ও কচুরিপানা ভর্তি জলাধারের কারণেই পাখি কম আসছে । কিন্তু ব্যতিক্রম এবছর । সম্প্রতি পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনদফতর ও একটি বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাখি সুমারিতে দেখা গিয়েছে, অতীতের মত পাখি আবারও আসছে আসানসোলের বিভিন্ন স্থানে। আসানসোলের দামোদর নদ, বরাকর নদ, চিত্তরঞ্জন হ্রদ, শতাব্দী পার্ক, গুঞ্জন পার্ক-সহ বিভিন্ন জায়গায় পাখি সুমারি হচ্ছে পয়লা জানুয়ারি থেকে 12 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত । তাতে নর্দান পিনটেল, গাডওয়াল, রুসিডেল ডাক, কমন পোচার্ড, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, লেসার হুইলিং-সহ নানা ধরনের পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলেছে । কিন্তু কমন মারগ্যানসার এই প্রথমবার শুধু পশ্চিম বর্ধমান জেলায় নয়, দক্ষিণবঙ্গেও এই রেকর্ড প্রথম ।

কীভাবে নজরে এল এই পাখি ?

আসানসোলের বিশিষ্ট ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় জানান, "জানুয়ারি মাসে আমরা তিনজন দামোদর নদের ধারে ভূতাবুড়ি মন্দির চত্বর এলাকায় পাখির ছবি তুলছিলাম । তখন মাথার উপর দিয়ে দুটি পাখি উড়ে যাচ্ছিল । আমার বন্ধু শুভম সেই পাখি দুটির ছবি তোলে খুব দ্রুত । জুম করে দেখতে গিয়ে আমরা চমকে যাই, প্রাথমিক ভাবে বুঝে যাই পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু তখনও নিশ্চিত ছিলাম না । এরপর পাখি দুটির ছবি পক্ষী বিশারদ ও বিভিন্ন পাখির গ্রুপে পাঠানো হয় । সব দিক বিচার করে জানা যায়, পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু এই পাখি এই জেলায় কখনও দেখা যায়নি । তবে এখন কেন আসছে । প্রাথমিক ভাবে আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তারা স্থান পরিবর্তন করার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাচ্ছে ।"

ETV BHARAT
কটন পিগমি গুস (নিজস্ব চিত্র)

যে চিত্রগ্রাহকের হাতে প্রথম ওই দুটি পাখির ছবি ধরা পড়ে, সেই শুভম বন্দ্যোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে জানান, "ছবি তুলে যখন জুম করে দেখি, এত চমকে গিয়েছিলাম যে, ক্যামেরা হাত থেকে পড়ে যেত । পরে সেদিন আর তাদের দেখতে পাইনি । কিন্তু কয়েকদিন পর পুনরায় দামোদর নদে ছবি তুলতে গিয়ে দেখি কমন মারগ্যানসার নদীতে বসে মাছ খাচ্ছে । তখন আমরা নিশ্চিত হই পাখিগুলি ওই স্থানেই বিচরণ করছে । যা দারুণ বিষয় বলে আমাদের মনে হয়েছে । যে পাখিগুলি আমাদের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে সেগুলি প্রত্যেকটিই মহিলা প্রজাতির ।"

কমন মারগ্যানসার পাখির বৈশিষ্ট্য

পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন, এই পাখিগুলি মূলত উত্তর আমেরিকায় বেশি দেখা যায় । গাছের গর্তে বাসা বাঁধলেও এরা মূলত বড় হ্রদ, নদী, জলাশয় এবং সমুদ্রেও বিচরণ করে । এই পাখিগুলির প্রধান খাবার হল মাছ । পাখিগুলি 23 ইঞ্চি থেকে 28 ইঞ্চি লম্বা হয়, ডানা মেললে এদের পরিধি হয় 30 ইঞ্চির মতো । মূলত হাঁসের মতো দেখতে হলেও সাদা শরীরে গোলাপি আভা দেখা যায় । মাথায় কালো রঙের সঙ্গে সবুজ চকচক করছে । ঠোঁট ও পা হয় লাল থেকে বাদামি লাল । সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, আফ্রিকান ও ইউরেশিয়ান জলে থাকা পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের তালিকায় কমন মারগ্যানসার পাখির নাম নথিভুক্ত আছে ।

ETV BHARAT
রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড (নিজস্ব চিত্র)

এমন বিরল পাখি আসানসোলে কেন এল তা নিয়ে নানা জল্পনা বেড়েছে । পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনাধিকারিক অনুপম খান জানিয়েছেন, "এমন একটি পাখি রেকর্ড হয়েছে আসানসোলে । হতে পারে পাখিটি অন্যত্র খাবার না পেয়ে এখানে চলে এসেছিল ।"

কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এত সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন না পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা । 2022 সালেও আসানসোলের গুঞ্জন পার্কে দেখা গিয়েছিল উড ওয়ার্বলার । বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহক দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় উঠে এসেছিল এই বিরল পাখি । ই-বার্ড পোর্টালও সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল । জানা যায়, এর আগে উড ওয়ার্বলার পাখির দেখা মিলেছিল লাদাখে । সেই পাখি এল আসানসোলে । একই ভাবে কমন মারগ্যানসারও এর আগে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে দেখা যায়নি ।

ETV BHARAT
টাফটেড ডাক (নিজস্ব চিত্র)

পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় আরও জানান, "আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম পাখিগুলি স্থান পরিবর্তন করছে । কিন্তু যখন পরের বার নদীতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই তাদের শিকার করতে দেখলাম, তখন বুঝলাম সেগুলি দামোদরের তীরেই ঘাঁটি গেড়েছে অস্থায়ী ভাবে । পাখিগুলি মাইগ্রেশেনের জন্যই জায়গাটিকে নির্বাচিত করতে পারে ।

প্রশ্ন উঠছে, বারবার এই বিরল পাখিদের আনাগোনায় আসানসোলকে কি তবে পরিযায়ীরা নিরাপদ স্থান ভেবে নিচ্ছে ? কিন্তু দূষণে ভরা শহরে পাখিকূল কীভাবে আসছে । তবে কি জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ?

ETV BHARAT
ওয়েস্ট হিমালয়ান বুশ ওয়ার্বলার (নিজস্ব চিত্র)

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আসানসোলের বায়ুর গুণগত মান উন্নত হয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে । কলকাতা, হাওড়া ও দুর্গাপুরকে পিছনে ফেলে আসানসোল উঠে এসেছে উপরের দিকে । তবে কি দূষণ কমে যাওয়াতেই রঙবেরঙের পাখি আসানসোলে ! সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়, শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়রা কিছুটা হলেও এই বিষয়ে সহমত ।

তবে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী ইটিভি ভারতকে ফোনে জানিয়েছেন, "আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে, এবছর যে পাখিগুলিকে দেখা গিয়েছে, তারা ক্রমাগত আসছে কি না । পাশাপাশি এদের যা খাদ্যাভাস সেটাও কতটা সেখানে পাওয়া যায় তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে । একবার একটা পাখি কোনও একটা মরশুমে আসছে, তার মানে সেই জায়গার দূষণ সূচক ভালো হয়ে গেল তা কিন্তু নয় । এটা অবশ্যই একটা দিক, আবার আবহাওয়ার তারতম্যও হচ্ছে । আগে আমরা দেখতাম, পরিযায়ী পাখিগুলো মার্চের শেষে ফিরে যেত । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফেব্রুযারিতেই তারা ফিরে যাচ্ছে । সেখান থেকে দলছুট হয়ে আসা বা তাদের রুটের পরিবর্তন করে কোনও পাখিকে দেখা গেলে একটা বছরের রেকর্ড ধরে এগোনো সম্ভব নয় । পরবর্তী বছর তাদের দেখা যাচ্ছে কি না, বা তারা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না এটা মনিটর করাটা জরুরি ।"

আসানসোল, 11 ফেব্রুয়ারি: বছর কয়েক আগেও কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আবর্জনাময়, নোংরা শহরের তকমা জুটেছিল আসানসোলের । এখন সেই শহরেই আসছে শীতের রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখিরা । শুধু তাই নয়, আসানসোলে এখন এমন পাখি আসছে, যারা কোনওদিন এই শহরে পা বাড়ায়নি ।

সম্প্রতি ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় দামোদর নদীর ধারে আসানসোলে ধরা পড়েছে কমন মারগ্যানসার । অতীতে এই পাখি উত্তরবঙ্গের গাজলডোবা কিংবা ভাগলপুরে দেখা গিয়েছিল বলে পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন ৷ কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে কখনও এই পাখি দেখা যায়নি । কিন্তু কী কারনে এই পাখির হঠাৎ আগমন আসানসোলে ? তবে কি দুষিত শহরের তকমা পাওয়া আসানসোলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ? কারণ খোঁজার চেষ্টায় ইটিভি ভারত ।

দূষিত আসানসোলেও বিরল পাখির খোঁজ (নিজস্ব ভিডিয়ো)

শীতের পরিযায়ীরা দল বেঁধে আসানসোলে আগেও আসত । মূলত স্বাভাবিক ভাবেই সাইবেরিয়ান যে সমস্ত প্রজাতির পাখিরা শীতে সাঁতরাগাছি ঝিলে আসত, তেমন ভাবেই আসানসোলের রেলশহর চিত্তরঞ্জনের জলাধারে ঝাঁকে ঝাঁকে আসর বসাত পরিযায়ীর দল । কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরে দুটি মিশ্র চিত্র নজরে আসছিল । শুধু চিত্তরঞ্জন নয়, দামোদর নদের ধারে, আসানসোলের গুঞ্জন পার্কেও পাখির আনাগোনা একদিকে যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই সামগ্রিক ভাবে পাখি আসা কমে যেতেও শুরু করে । চিত্তরঞ্জন লেকে অস্বাভাবিক ভাবে পাখি কম আসতে শুরু করে গত কয়েক বছরে ।

ETV BHARAT
দূষিত আসানসোলেও বিরল পাখির খোঁজ (নিজস্ব ভিডিয়ো)

পরিবেশবিদরা জানিয়েছিলেন, চোরা শিকারীদের পাখি শিকার, অপরিষ্কার ও কচুরিপানা ভর্তি জলাধারের কারণেই পাখি কম আসছে । কিন্তু ব্যতিক্রম এবছর । সম্প্রতি পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনদফতর ও একটি বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাখি সুমারিতে দেখা গিয়েছে, অতীতের মত পাখি আবারও আসছে আসানসোলের বিভিন্ন স্থানে। আসানসোলের দামোদর নদ, বরাকর নদ, চিত্তরঞ্জন হ্রদ, শতাব্দী পার্ক, গুঞ্জন পার্ক-সহ বিভিন্ন জায়গায় পাখি সুমারি হচ্ছে পয়লা জানুয়ারি থেকে 12 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত । তাতে নর্দান পিনটেল, গাডওয়াল, রুসিডেল ডাক, কমন পোচার্ড, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, লেসার হুইলিং-সহ নানা ধরনের পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলেছে । কিন্তু কমন মারগ্যানসার এই প্রথমবার শুধু পশ্চিম বর্ধমান জেলায় নয়, দক্ষিণবঙ্গেও এই রেকর্ড প্রথম ।

কীভাবে নজরে এল এই পাখি ?

আসানসোলের বিশিষ্ট ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় জানান, "জানুয়ারি মাসে আমরা তিনজন দামোদর নদের ধারে ভূতাবুড়ি মন্দির চত্বর এলাকায় পাখির ছবি তুলছিলাম । তখন মাথার উপর দিয়ে দুটি পাখি উড়ে যাচ্ছিল । আমার বন্ধু শুভম সেই পাখি দুটির ছবি তোলে খুব দ্রুত । জুম করে দেখতে গিয়ে আমরা চমকে যাই, প্রাথমিক ভাবে বুঝে যাই পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু তখনও নিশ্চিত ছিলাম না । এরপর পাখি দুটির ছবি পক্ষী বিশারদ ও বিভিন্ন পাখির গ্রুপে পাঠানো হয় । সব দিক বিচার করে জানা যায়, পাখি দুটি কমন মারগ্যানসার । কিন্তু এই পাখি এই জেলায় কখনও দেখা যায়নি । তবে এখন কেন আসছে । প্রাথমিক ভাবে আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তারা স্থান পরিবর্তন করার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাচ্ছে ।"

ETV BHARAT
কটন পিগমি গুস (নিজস্ব চিত্র)

যে চিত্রগ্রাহকের হাতে প্রথম ওই দুটি পাখির ছবি ধরা পড়ে, সেই শুভম বন্দ্যোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে জানান, "ছবি তুলে যখন জুম করে দেখি, এত চমকে গিয়েছিলাম যে, ক্যামেরা হাত থেকে পড়ে যেত । পরে সেদিন আর তাদের দেখতে পাইনি । কিন্তু কয়েকদিন পর পুনরায় দামোদর নদে ছবি তুলতে গিয়ে দেখি কমন মারগ্যানসার নদীতে বসে মাছ খাচ্ছে । তখন আমরা নিশ্চিত হই পাখিগুলি ওই স্থানেই বিচরণ করছে । যা দারুণ বিষয় বলে আমাদের মনে হয়েছে । যে পাখিগুলি আমাদের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে সেগুলি প্রত্যেকটিই মহিলা প্রজাতির ।"

কমন মারগ্যানসার পাখির বৈশিষ্ট্য

পক্ষী বিশারদরা জানাচ্ছেন, এই পাখিগুলি মূলত উত্তর আমেরিকায় বেশি দেখা যায় । গাছের গর্তে বাসা বাঁধলেও এরা মূলত বড় হ্রদ, নদী, জলাশয় এবং সমুদ্রেও বিচরণ করে । এই পাখিগুলির প্রধান খাবার হল মাছ । পাখিগুলি 23 ইঞ্চি থেকে 28 ইঞ্চি লম্বা হয়, ডানা মেললে এদের পরিধি হয় 30 ইঞ্চির মতো । মূলত হাঁসের মতো দেখতে হলেও সাদা শরীরে গোলাপি আভা দেখা যায় । মাথায় কালো রঙের সঙ্গে সবুজ চকচক করছে । ঠোঁট ও পা হয় লাল থেকে বাদামি লাল । সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, আফ্রিকান ও ইউরেশিয়ান জলে থাকা পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের তালিকায় কমন মারগ্যানসার পাখির নাম নথিভুক্ত আছে ।

ETV BHARAT
রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড (নিজস্ব চিত্র)

এমন বিরল পাখি আসানসোলে কেন এল তা নিয়ে নানা জল্পনা বেড়েছে । পশ্চিম বর্ধমান জেলার বনাধিকারিক অনুপম খান জানিয়েছেন, "এমন একটি পাখি রেকর্ড হয়েছে আসানসোলে । হতে পারে পাখিটি অন্যত্র খাবার না পেয়ে এখানে চলে এসেছিল ।"

কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এত সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন না পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা । 2022 সালেও আসানসোলের গুঞ্জন পার্কে দেখা গিয়েছিল উড ওয়ার্বলার । বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহক দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় উঠে এসেছিল এই বিরল পাখি । ই-বার্ড পোর্টালও সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল । জানা যায়, এর আগে উড ওয়ার্বলার পাখির দেখা মিলেছিল লাদাখে । সেই পাখি এল আসানসোলে । একই ভাবে কমন মারগ্যানসারও এর আগে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে দেখা যায়নি ।

ETV BHARAT
টাফটেড ডাক (নিজস্ব চিত্র)

পক্ষী বিশারদ ও ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায় আরও জানান, "আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম পাখিগুলি স্থান পরিবর্তন করছে । কিন্তু যখন পরের বার নদীতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই তাদের শিকার করতে দেখলাম, তখন বুঝলাম সেগুলি দামোদরের তীরেই ঘাঁটি গেড়েছে অস্থায়ী ভাবে । পাখিগুলি মাইগ্রেশেনের জন্যই জায়গাটিকে নির্বাচিত করতে পারে ।

প্রশ্ন উঠছে, বারবার এই বিরল পাখিদের আনাগোনায় আসানসোলকে কি তবে পরিযায়ীরা নিরাপদ স্থান ভেবে নিচ্ছে ? কিন্তু দূষণে ভরা শহরে পাখিকূল কীভাবে আসছে । তবে কি জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে ?

ETV BHARAT
ওয়েস্ট হিমালয়ান বুশ ওয়ার্বলার (নিজস্ব চিত্র)

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় আসানসোলের বায়ুর গুণগত মান উন্নত হয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে । কলকাতা, হাওড়া ও দুর্গাপুরকে পিছনে ফেলে আসানসোল উঠে এসেছে উপরের দিকে । তবে কি দূষণ কমে যাওয়াতেই রঙবেরঙের পাখি আসানসোলে ! সপ্তর্ষি মুখোপাধ্যায়, শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়রা কিছুটা হলেও এই বিষয়ে সহমত ।

তবে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী ইটিভি ভারতকে ফোনে জানিয়েছেন, "আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে, এবছর যে পাখিগুলিকে দেখা গিয়েছে, তারা ক্রমাগত আসছে কি না । পাশাপাশি এদের যা খাদ্যাভাস সেটাও কতটা সেখানে পাওয়া যায় তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে । একবার একটা পাখি কোনও একটা মরশুমে আসছে, তার মানে সেই জায়গার দূষণ সূচক ভালো হয়ে গেল তা কিন্তু নয় । এটা অবশ্যই একটা দিক, আবার আবহাওয়ার তারতম্যও হচ্ছে । আগে আমরা দেখতাম, পরিযায়ী পাখিগুলো মার্চের শেষে ফিরে যেত । কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফেব্রুযারিতেই তারা ফিরে যাচ্ছে । সেখান থেকে দলছুট হয়ে আসা বা তাদের রুটের পরিবর্তন করে কোনও পাখিকে দেখা গেলে একটা বছরের রেকর্ড ধরে এগোনো সম্ভব নয় । পরবর্তী বছর তাদের দেখা যাচ্ছে কি না, বা তারা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না এটা মনিটর করাটা জরুরি ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.