কলকাতা, 6 ডিসেম্বর: আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি ৷ এদিকে রাজ্য পুলিশের তদন্তে জয়নগরের নাবালিকা ছাত্রী ধর্ষণ-খুনে ঘটনায় মাত্র দু'মাসে দোষী সাব্যস্ত হল মুস্তাকিন সরদার ৷ বৃহস্পতিবার বারুইপুর মহকুমা আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেছে ৷ এই ঘটনায় রাজ্য পুলিশ এবং তদন্তে জড়িত সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
অন্যদিকে রাজ্য পুলিশের তরফে সোশাল মিডিয়ায় 'জাস্টিস ফর জয়নগর' লিখে পোস্ট করা হয়েছে ৷ পুলিশের শীর্ষকর্তা সুপ্রিম সরকার সাংবাদিক বৈঠক করে তদন্ত কীভাবে এগিয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলেন ৷ তাঁর কথায়, "পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই রায় নজিরবিহীন ৷" মাত্র 62 দিনে বিচার এর আগে পশ্চিমবঙ্গে কখনও হয়নি, জোর দিয়ে জানান তিনি ৷
এই রায় ঘোষণার পর সোশাল মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, "4 অক্টোবর জয়নগরে এক নাবালিকাকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছিল ৷ এই ঘৃণ্য ঘটনার মাত্র 62 দিনের মধ্যে আজ দোষীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনিয়েছে বারুইপুরের পকসো আদালত ৷ সদ্য এই ঘটনার দু'মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ৷ এর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা থেকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনানো- রাজ্যের ইতিহাসে এর আগে কখনও হয়নি ৷"
The accused in the case involving the brutal rape and murder of a minor girl in Joynagar on 4.10.24 has been sentenced to death today by the POCSO court at Baruipur just within 62 days of the ghastly incident. Conviction and capital punishment in such a case in just over two…
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) December 6, 2024
এর জন্য় রাজ্য পুলিশের ভূয়সী প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি লেখেন, "এই দুর্দান্ত সাফল্যের জন্য় আমি রাজ্য পুলিশকে অভিনন্দন জানাচ্ছি ৷ এছাড়া যাঁরা বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও ৷" তিনি উল্লেখ করেন, "নারী নির্যাতনের ঘটনায় সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে ৷ বিচারে দেরি বা অস্বীকার নয়, সরকার সুবিচার নিশ্চিত করেছে ৷"
কোন পথে তদন্ত, কী বললেন পুলিশের উচ্চাধিকারিক
এদিন তদন্ত কোন পথে কীভাবে এগিয়েছে এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, তা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন এডিজি সুপ্রতিম সরকার (দক্ষিণবঙ্গ) ৷ তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই ঘটনার তদন্ত ও বিচার নজিরবিহীন ৷ রাজ্যে কোনও ধর্ষণ ও খুনের মামলায় এত দ্রুত বিচার এই প্রথম ৷ একটি বেনজির সাফল্য ৷" এই সাফল্যে তিনি বারুইপুর পুলিশ সুপার পলাশ ঢালি এবং তদন্তকারী দলের সদস্য, স্পেশাল সরকারি কৌঁসুলি বিভাস চট্টোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছা জানান ৷
মুস্তাকিনের বিরুদ্ধে প্রমাণ
- মেয়েটি যেখানে টিউশন পড়তে গিয়েছিল, সেখানে একই শিক্ষিকার কাছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও পড়তে গিয়েছিল ৷ মেয়েটি সেদিন একটু আগে 5টা নাগাদ বেরিয়েছিল ৷ বন্ধুটি পরে বেরিয়েছিল ৷ সে দেখতে পায়, একটি নীল রঙের সাইকেলে করে তার বন্ধু এক যুবকের সঙ্গে যাচ্ছিল ৷ এমন আরও তিনজন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা বিকেল 5টা থেকে 7টার মধ্যে মুস্তাকিন সরকারকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে দেখেছে৷
- এলাকার প্রত্যেকটি সিসি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়েছে ৷ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজের কথা উল্লেখ করেন এডিজি (দক্ষিণ) সুপ্রতিম সরকার ৷ তাতে দেখা যায় যে মুস্তাকিন ওই মেয়েটিকে অনুসরণ করছে, সাইকেলে চড়ছে ৷ সিসি ফুটেজগুলির সত্যতা খতিয়ে দেখা হয়েছে ৷
- মুস্তাকিন সরদারের ফোনের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে গুগল ম্যাপের সাহায্যে মুস্তাকিনের গতিবিধির ডিজিটাল প্লটিং করা হয় ৷ ডিজিটাল প্লটিং থেকেই তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে যেখান থেকে নাবালিকার দেহ উদ্ধার হয়েছে, সেখানে মুস্তাকিনের উপস্থিতি ছিল ৷
- নাবালিকার দেহ উদ্ধারের জায়গায় স্কুল ব্যাগে লেগে থাকা কাদা, চোর কাঁটা এবং ঘটনাস্থলের অন্যত্র পাওয়া চোরকাঁটা, কাদা ফরেনসিকে প্রমাণিত
- মেয়েটির হাতের লেখা
- মুস্তাকিনের নীল রঙের সাইকেলে মেয়েদের মাথার ক্লিপ, চুল পাওয়া গিয়েছে ৷ ওই ক্লিপটি যে নির্যাতিতা নাবালিকার, তা আদালতে শনাক্ত করে তার বাবা ৷ কয়েকগাছা চুল যে মেয়েটিরই তা ডিএনএ এবং জেনেটিক প্রোফাইলে নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৷
- ময়নাতদন্তে মৃতার যৌনাঙ্গ থেকে যে তরল পাওয়া গিয়েছে, তা যে মুস্তাকিনেরই, সেটাও ডিএনএ ও জেনেটিক প্রোফাইলে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৷
- মুস্তাকিন সরদারের গেট প্যাটার্ন বিশ্লেষণ ৷ মুস্তাকিনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ- একটিতে সে সাইকেল নিয়ে হাঁটছে ৷ একটি ফুটেজে সে সাইকেলে চড়ছে এবং আরেকটিতে সে মেয়েটির পিছু নিচ্ছে ৷ বারুইপুর সংশোধনাগারে মুস্তাকিন থাকাকালীন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে মুস্তাকিনের গেট প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করা হয় ৷ ওই নীল সাইকেলে তাকে হাঁটানো হয় ৷ তাকে চড়ানো হয় এবং পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিয়োগ্রাফি করা হয় ৷ সেই ভিডিয়ো এবং সিসি ফুটেজ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয় ৷ তাঁরা রিপোর্ট দেন যে দু'টি গেট প্যাটার্নই এক ৷
সাংবাদিক বৈঠকের শেষে পুলিশের উচ্চাধিকারিক জোর দিয়ে বলেন, "আমরা চাইনি যে নির্যাতিতা ও তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীন থাকুক ৷ আমরা সকলে জানি, মেয়েটি আর ফিরবে না ৷ কিন্তু এই যে 62দিনের মাথায় আমরা মেয়েটিকে ন্যায়বিচার দিতে পারলাম, এটাই আমাদের সান্ত্বনা, এটাই আমাদের প্রাপ্তি ৷"
এদিন প্রতিক্রিয়া দেন কলকাতা পুরনিগমের মেয়র ফিরহাদ হাকিম ও তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ ৷ তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাজিতা আইন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি বিলম্বিত করছে ৷ আরজি কর মামলায় কলকাতা পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল ৷ কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহলে বিষয়টি নিয়ে গেল সিবিআই তদন্তের দাবিতে ?"