কলকাতা, 16 জুলাই: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে লাগাম পরানোর নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট ৷ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে 14 অগস্ট পর্যন্ত তিনি কোনও রকম মানহানিকর বা অমর্যাদাকর বা অপমানজনক মন্তব্য করতে পারবেন না ৷ মঙ্গলবার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের দায়ের করা মানহানির মামলায় এই নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি কৃষ্ণা রাও ৷
শুধু মুখ্যমন্ত্রী-ই নন, একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের দুই বিধায়ক এবং তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষকেও ৷ আগামী 14 অগস্ট এই মামলার পরবর্তী শুনানি ৷ এই সময়ের মধ্যে সব পক্ষকেই হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত ৷ সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে রাজ্যপালের দায়ের করা মানহানির মামলায় দীর্ঘ শুনানির পর রায়দান স্থগিত রেখেছিল কলকাতা হাইকোর্ট ৷
গতকাল মামলার শুনানিতে রাজ্যপালের আইনজীবী ধীরজ ত্রিবেদী বলেন, "রাজ্যের দুই বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনের পর শাসক দলের দুই প্রার্থী জয়লাভ করেন । পরে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে তাঁরা জানান, স্পিকারের কাছে গিয়ে শপথ নিতে চান ৷ রাজভবনে যেতে কোথাও তাঁরা ভয় পাচ্ছেন । অন্য কোনও কিছুর উল্লেখ করা হয়নি চিঠিতে । পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লখ করেন, 'শুনছি মেয়েরা রাজভবন যেতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ সেখানে যা হচ্ছে...' যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে । একইসঙ্গে বলা হয়, দুই নির্বাচিত প্রার্থীকে কেন রাজভবনে যেতে হবে ? তিনি তো স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারকে দায়িত্ব দিতে পারেন, বিধানসভাতেই শপথ গ্রহণ করতে পারেন তাঁরা । তৃণমূলের কুণাল ঘোষও একাধিকবার রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন, যেগুলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ।"
এদিন শুনানিতে বিচারপতি জানতে চান, "আপনারা চাইছেন কী ? এই জন্যই সংবাদমাধ্যমকে মামলায় যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল ।" বিচারপতির এই কথা শুনে ধীরজ ত্রিবেদী বলেন, "অবিলম্বে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য করা বন্ধ করা হোক । আদালত সেই মর্মে নির্দেশ দিক ।" যদিও মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আইনজীবী সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন এজি) দাবি করেন, "কোনও মানহানিকর কিছু ঘটেনি । ফলে স্থগিতাদেশের প্রশ্নই ওঠে না ।"
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী সঞ্জয় বসু একটি বিবৃতিতে জানান, যে মন্তব্যগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে এই মামলা দায়ের হয়েছিল, আদালত তাতে এমন কিছু খুঁজে পায়নি যা অপমানজক বা ভুল ৷ অনেক মহিলা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছিলেন ৷ তিনি শুধুমাত্র সেই মহিলাদের বক্তব্যগুলিই উল্লেখ করেছেন ৷ ভারতের সংবিধানের 19 নম্বর ধারা অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর বাক-স্বাধীনতার অধিকার আছে ৷ তিনি রাজ্যের মহিলাদের নিরাপত্তার প্রতি দায়বদ্ধ ৷ যাই হোক না কেন, তিনি যে কোনও লিঙ্গের মানুষের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ৷
আইনজীবী আরও লেখেন, একজন জনপ্রতিনিধি এবং একজন মহিলা হিসেবে তিনি তাঁর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন না ৷ মহিলাদের দুঃখ, কষ্টে তিনিও মর্মাহত হবেন, এটাই স্বাভাবিক ৷ সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি কোনও ভাবে অসম্মাজনক বলে প্রতিপন্ন করা যায়নি ৷ আমরা বিশ্বাস করি, মন্তব্য নিয়ন্ত্রণের বিষয় নিয়ে নির্দেশটি একেবারে ভিত্তিহীন ৷ মুখ্যমন্ত্রী অন্যায় বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন ৷ লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন ৷ তাঁর এই বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ৷
গত 29 জুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মানহানির মামলা করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ৷ মে মাসের শুরুতে মূলত, উত্তর 24 পরগনার বরানগর ও মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা উপনির্বাচনে নির্বাচিত দুই তৃণমূল বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রেয়াত হোসেনের শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে এই মামলার সূত্রপাত । গত 12 ও 13 জুন থেকে গতকাল, শুক্রবার পর্যন্ত দুই বিধায়কের শপথ গ্রহণ নিয়ে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ-সহ একাধিক নেতা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়েই মানহানির মামলা করা হয়েছে । মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আরও দুই আইনজীবী ছিলেন প্রাক্তন দুই এজি জয়ন্ত মিত্র ও সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ৷
2 মে রাজভবনের এক অস্থায়ী মহিলা কর্মচারীর শ্লীলতাহানি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে ৷ সেই ঘটনায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় ৷ এর জেরে দুই নবনির্বাচিত বিধায়কের শপথ নেওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় ৷ দুই নবনির্বাচিত তৃণমূল বিধায়ক বরানগরের সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভগবানগোলার রেয়াত খান বিধানসভায় শপথ নেবেন বলে অনড় থাকেন ৷ এই দাবিতে তাঁরা বিধানসভায় ধরনাও দেন ৷ এদিকে তাঁরা কেন রাজভবনে যাচ্ছেন না, সেই প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "রাজভবনে যে কীর্তি-কেলেঙ্কারি চলছে, তাতে মেয়েরা রাজভবনে যেতে ভয় পাচ্ছে ৷ আমাকে কমপ্লেন করেছে ।’’ এরপর রাজ্যপাল আদালতের দ্বারস্থ হন ৷