শ্রীরামপুর, 23 জানুয়ারি: একটি চায়ের দোকান ৷ সেখানে একজন ব্যক্তি চা-বানাচ্ছেন ৷ সাধারণের দৃষ্টিতে তিনি দোকানের মালিক বা কর্মচারী বলে মনে হবে ৷ কিন্তু, আদতে তা নয় ৷ যিনি চা-বানাচ্ছেন, তিনি নিজেই একজন গ্রাহক ৷ এমনই এক চায়ের দোকানের হদিশ মিলল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের কালীবাবুর শ্মাশানঘাটের সামনে ৷
কিন্তু, একজন গ্রাহক কেন চা-বানাচ্ছেন ৷ সেই কারণ খুঁজতে ইটিভি ভারত পৌঁছেছিল সেই চায়ের দোকানে ৷ জানা গেল, এই দোকানের কোনও মালিক নেই ৷ তাই স্থানীয় বাসিন্দারা এসে পালা করে চায়ের দোকান চালান ৷ স্থানীয় খদ্দেররা নিজে হাতেই চা ঢেলে নেন ৷ এমনকি শ্মশানে আসা লোকজনকে চা পরিবেশনও করেন স্থানীয়রা ৷ এই দোকানে এখনও মাত্র পাঁচ টাকায় পাওয়া যায় দু’কাপ চা ৷
যে যখন দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাই সকালে-বিকেলে দোকান খোলেন ও বন্ধ করেন ৷ বেচাকেনা শেষে সারাদিনের চা-বিস্কুট বিক্রির টাকা ক্যাশবাক্সে রেখে যান ৷ সেই টাকা চায়ের দোকান চালাতেই খরচ করা হয় ৷ সেখানে লাভ-লোকসান বা ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন নেই ৷ দিনের পর দিন স্থানীয়রা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ৷ শ্মশান লাগোয়া এই চায়ের দোকান থেকে প্রাপ্তি, পাড়ার গুটি কয়েক মানুষের সকাল-সন্ধের আড্ডা ও গল্প ৷
তবে, এই দোকানে শুরু থেকে চা বিক্রি হত না ৷ এমনকি এই দোকান মালিকবিহীনও ছিল না ৷ স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, 250 বছরের পুরনো এই দোকানটি ৷ শ্রীরামপুরে চাতরা বাজারে অবস্থিত এই চায়ের দোকানে আগে ঘট, কলসি বিক্রি হত ৷ সময়ের সঙ্গে সেই দোকান উঠে যায় ৷ পরিবারের কেউ আর সেই দোকান চালায়নি ৷ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর, স্থানীয় এক ব্যক্তি নরেশ সোম চায়ের দোকান খোলেন সেখানে ৷
প্রথম দিকে ঘুগনি, আলুর দম, চা বিক্রি হলেও বর্তমানে শুধু চা ও বিস্কুট বিক্রি হয় ৷ নরেশ সোমের মৃত্যুর পর স্থানীয়রাই দোকান চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন ৷ প্রায় একশো বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে মালিকবিহীন দোকান ৷ অবসর জীবনে কাটানো বয়স্ক মানুষজন এই দোকানে আড্ডা দেওয়া, চা-খাওয়ার সঙ্গে দোকানদারিও করেন ৷
তেমনই একজন আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছেন এই চায়ের দোকান ৷ আগে বেসরকারি সংস্থার চাকরি করতেন ৷ অবসরের পর এই দোকান সামলান ৷ তিনি বলেন, "সকাল ন'টা থেকে আমি দোকানে থাকি ৷ দুপুরে বন্ধ করে দিলেও আবার বিকেল তিনটে থেকে দোকান খুলি ৷ সপ্তাহে সবদিন না-হলেও, বেশিরভাগ সময়টা এখানেই কাটাতে চলে আসি ৷ আমার সময় শেষ হলে অন্যজন এসে দায়িত্ব নেয় ৷ এখানে সকলেই পেনশন হোল্ডার ৷"
তিনি বলেন, "60 থেকে 70 বছরের সবাই এখানকার চা খেয়ে আড্ডা দেন ৷ কালীবাবুর শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এই দোকানেরই খদ্দের ৷ এছাড়াও আশেপাশের স্থানীয় লোক দোকানের চা খেতে আসেন ৷ সারাদিনে প্রায় তিনশো কাপ চা বিক্রি হয় ৷ এখানে কাজের লোক কেউ নেই ৷ নির্দিষ্ট সময়ে এসে প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্ব সামলে যান ৷"
এভাবেই দোকান সামলান বিশ্বনাথ দে ৷ তিনি বলেন, "10-12 জন মিলে আমরা দোকান চালাই ৷ এই দোকানে কাস্টমার ফেরত যায় না ৷ যে যখন সময় পায়, সে এসেই দোকান সামলে যায় ৷ ভোর চারটে থেকে দোকান খোলে, চলে রাত দশটা পর্যন্ত ৷ তারমধ্যে শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এলে, এগারোটা-বারোটা হয়ে যায় ৷ আমাদের কারও বিরক্তভাব নেই ৷ তাহলে অনেকদিন আগেই এই দোকান বন্ধ হয়ে যেত ৷ এখানে মালিক বলে কেউ নেই ৷ একজন শুধু দায়িত্বে থাকেন ৷ সকলের বিশ্বাসের উপরেই এই দোকান চলে ৷ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই চায়ের দোকান সামলানোর জন্য এসে গেছে ৷ এখানে চা-করার জিনিসপত্র পরিষ্কার করা থেকে, দুধ-চিনি আনা সবকিছুই করতে হয় সকলকে ৷"
চা-দোকানের আরেক সদস্য অশোক চক্রবর্তী বলেন, "চায়ের দোকানের কিছুটা দায়িত্ব আমি নিয়েছি ৷ আর যে যখন থাকে, সেই দায়িত্ব নিয়ে দোকান চালায় ৷ দোকানে বিক্রির টাকা ক্যাশ বাক্সে থাকে ৷ সেখান থেকেই খরচ করা হয় ৷ আমি চাকরি করি বলে সবসময় থাকতে পারি না ৷ সকালে আটটা পর্যন্ত থাকি ৷ আবার সন্ধে বেলায় এসে দোকানের কেনাকাটা করি ৷"
আট বছর ধরে এই দোকানের চা খাচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী ৷ তিনি বলেন, "বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক থাকে ৷ কিন্তু, চায়ের কোয়ালিটি একই রয়ে যায় ৷ 5 টাকার চা তিন-চারজন মিলে খাওয়া যায় ৷ এই দোকানে এলে খদ্দেররাই নিজেদের ইচ্ছামতো চা নিয়ে, টাকা দিয়ে চলে যায় ৷"