দার্জিলিং, 18 জুন: বৃদ্ধা মা কোমায় ৷ তাঁকে দেখতেই এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে কলকাতায় ফিরছিলেন বিএসএফ কর্মী রাজকুমার বটব্যাল ৷ চেপেছিলেন অভিশপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে ৷ রাতের অন্ধকারে সেই ট্রেন পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে ৷ দুর্ঘটনায় দুমড়ে যাওয়া কামরাতেই ছিলেন রাজকুমার ৷ সেই কোচের যাত্রীরা তখন প্রায় দলা পাকিয়ে একে-অপরের ঘাড়ের উপর ৷ প্রতিকূল পরিবেশে অভ্যস্ত রাজকুমার নিজের আঘাত উপেক্ষা করে তখন একে একে বাঁচাচ্ছেন সহযাত্রীদের ৷ ওই পরিস্থিতিতে তাঁর মাথায় ছিল না নব্বই পেরনো মায়ের অসুস্থতার কথাও ৷ রাজকুমারের কথায়, এটাই তো বিএসএফ-এর স্লোগান, 'ডিউটি আনটু ডেথ'। অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত কর্তব্য পালন । সেই ধর্মেই দীক্ষিত বিএসএফ কর্মীর কাছে ওই মুহূর্তে সহযাত্রীদের উদ্ধার করাটাই ছিল একমাত্র মিশন ৷
সোমবারের কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা ইটিভি ভারতকে জানালেন বিএসএফ ইনস্পেক্টর রাজকুমার বটব্যাল । বিএসএফের কমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং বিভাগে কর্মরত তিনি । বর্তমানে কর্মরত মেঘালয়ের চিপুরে । তিনি সোদপুরের বাসিন্দা । তাঁর নব্বই বছরের মা কোমায় রয়েছেন, তিনি কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি । তাই এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে মাকে দেখতে কলকাতায় যাচ্ছিলেন রাজকুমার বটব্যাল । সে জন্যই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরেন তিনি । কিন্তু কে জানত যে, এমন দুর্বিষহ সময় অপেক্ষা করে আছে ।
নিজবাড়ি এলাকায় যখন মালবাহী ট্রেনটি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে, তখন জেনারেল কামরায় ছিলেন রাজকুমার বটব্যাল । আচমকা বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারিদিক ৷ সঙ্গে ছিল তীব্র ঝাঁকুনি । জেনারেল কামরায় থাকা সাত-আটজন যাত্রী হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েন রাজকুমারের উপর । তিনি বুঝে যান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে তাঁর ট্রেন । মুহূর্তে নিজেকে ধাতস্থ করে নেন । নিজের প্রাণ হাতে করে দুমড়ানো মোচড়ানো কামরা থেকে আগেভাগে বেরিয়ে আসার কথা তাঁর মাথায় আসেনি ৷ মনে পড়েনি তড়িঘড়ি অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার কথা ৷ তখন তাঁর মাথায় কাজ করে একটাই মন্ত্র, যে মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে - 'ডিউটি আনটু ডেথ' ৷
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ওই কামড়াটি যখন ঝুলনের খেলনার মতো অন্য একটি বগির উপর উঠে যায়, তখন সাত-আটজন যাত্রী এসে পড়েছিল রাজকুমারের উপর ৷ সবাইকে একে একে কামরা থেকে বের করে তারপর নিজে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন রাজকুমার বটব্যাল । কিন্তু এসবের মাঝেই খোয়া যায় তাঁর মোবাইল ও মালপত্র । পরে অবশ্য উদ্ধারকারী পুলিশ তাঁর খোয়া যাওয়া সামগ্রী খুঁজে বের করে তাঁকে ফিরিয়ে দেন । আহত রাজকুমারকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে ৷
তাঁর চিকিৎসার পর মঙ্গলবার সকালে ওই বিএসএফ কর্মীকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় । বিপদের মুখে তাঁর কর্তব্যপালন সবার প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে ৷ রাজকুমারকে ধন্যবাদ জানান আরপিএফ কর্মীরা ।
হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়ে রাজকুমার বটব্যাল বলেন, "আমার মা কোমায় রয়েছেন ৷ তাঁকে দেখতেই কলকাতায় যাচ্ছিলাম ৷ কিন্তু এই ঘটনার পর মাথায় তখন আর কিছু আসেনি । হুড়মুড়িয়ে সবাই উপর থেকে নীচে গড়িয়ে পড়ে । ট্রেনের কামরা ড্রেনে পরিণত হয় । একে একে সবাইকে উদ্ধার করি । সবার শেষে নিজে বের হই । আমাদের মোটোই হল ডিউটি আনটু ডেথ । একটু ট্রমা এখনও রয়েছে। সেজন্য ট্রেনে নয়, চারচাকা গাড়ি নিয়ে এসেছেন বাড়ির লোকজন । সেটাইতেই বাড়ি যাব ।"