ETV Bharat / state

নাগরিকত্বের আশায় ফের বুথে বুথে মতুয়ারা ! বনগাঁয় কি ফুল বদল ? - MATUA IMPACT IN BANGAON LOK SABHA - MATUA IMPACT IN BANGAON LOK SABHA

Matua in Bangaon Lok Sabha: বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে বসতি গড়ার নেপথ্যে ছিলেন তাঁর প্রপৌত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ৷ ভোটের পরে ভোট এসেছে ৷ কিন্তু নাগরিকত্বের টোপে মতুয়াদের ঘুঁটি করেছে সব রাজনৈতিক দল ৷ এবার ভোটে নাগরিকত্ব নিয়ে কী ভাবছে মতুয়ারা ? খোঁজ নিল ইটিভি ভারত ৷

Importance of Matua Sect in Bengal Politics
বনগাঁয় এবার মতুয়া ভোট কোন দিকে (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : May 18, 2024, 7:39 PM IST

বনগাঁ লোকসভায় প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মতুয়া ভোট (ইটিভি ভারত)

বনগাঁ, 18 মে: "আমরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চাই", বলছিলেন মতুয়া পরিবারের ছেলে পবিত্র গোঁসাই ৷ দেশভাগ এবং তার পর 1971 সালে বাংলাদেশ থেকে একপ্রকার প্রাণ হাতে করে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন ৷ তার মধ্যে ছিলেন বিশাল সংখ্যায় নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়, যাঁদের অন্যতম মতুয়ারা ৷ তখন কে কোথায় কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাবেন, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন ৷

কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে এলে কাগজ সঙ্গে রাখতে হবে, তা মাথায় ছিল না অনেকেরই ৷ পবিত্র বলেন, "আমরা বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কোনও কাগজ নিয়ে আসতে পারিনি ৷ একাত্তরের গণ্ডগোলে জীবন বাঁচিয়ে আসাটাই বড় দায় ছিল ৷" একই কথা বলছেন আরেক মতুয়া হরিচাঁদ গোঁসাই ৷ তাঁর কথায়, "রাতের অন্ধকারে মা-বোনদের ইজ্জত এবং ধর্মকে রক্ষা করার জন্য সীমান্ত দিয়ে কে কোথায় কীভাবে পালিয়ে এসেছেন, তার কোনও দিশা ছিল না ৷ চাকরি করতে গেলে ছেলেমেয়েদের কাছে একাত্তর সালের আগের দলিল চায় ৷ কিন্তু আমরা তো তার আগে আসিনি !"

উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে একটি সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেন হরিচাঁদ ঠাকুর ৷ সমাজের নিচু-অস্পৃশ্য মতুয়াদের বাঁচার রাস্তা দেখান প্রথম সঙ্ঘাধিপতি ৷ এরপর সেই ধর্মান্দোলন চালিয়ে যান তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ৷ 1947 সালে পূর্ববঙ্গে মতুয়াদের পরিস্থিতি বদলায় ৷ দেশভাগের ফলে খুলনা, যশোর এবং ফরিদপুর পাকিস্তানে চলে যায় ৷ এই অঞ্চলগুলিতে বাস করত নমঃশূদ্র মতুয়ারা ৷ সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসেন ৷

Matua Factor in Bangaon LS Poll 2024
উত্তর 24 পরগনার বনগাঁ লোকসভায় মতুয়া ফ্যাক্টর সব দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ (ইটিভি ভারত)

ভারত সীমান্তের কাছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা এবং মুর্শিদাবাদে বসতি গড়তে থাকেন হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের শিষ্যরা ৷ শুরু হয় নতুন দেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম ৷ সেই সময় বা বলা ভালো দেশভাগের আগে থাকতে তাঁদের বাঁচার পথ দেখিয়েছিলেন আরেক সঙ্ঘাধিপতি, হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রপৌত্র, গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ৷ যিনি পিআর ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত ৷

1947 সালের ডিসেম্বরে উত্তর 24 পরগনার বনগাঁয়, অধুনা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে, এক খণ্ড জমি কেনেন পিআর ঠাকুর ৷ সেখানে চালা বানিয়ে মতুয়াদের জন্য হরিজন কলোনির সূচনা করেন ৷ পরে তাঁর জীবদ্দশাতেই সেখানে তৈরি হয় মতুয়াদের মন্দির, আজকের ঠাকুরনগর ৷ হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের ঘিরে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাকে রাজনৈতিক রূপ দিলেন প্রমথরঞ্জন ৷ ধীরে ধীরে এই ঠাকুরনগর তথা উত্তর 24 পরগনা, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, রাণাঘাটের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকে নিজেদের বাসযোগ্য করে তোলেন মতুয়ারা ৷ তবে যে রাতে ছিন্নমূল মতুয়ারা ভারতে পা রেখেছিলেন সেই রাত থেকেই তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল ৷ সেই কিস্সা আজও চলছে ৷

ভারতে এসে পিআর ঠাকুর কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমে হরিণঘাটা ও পরে হাঁসখালি বিধানসভা থেকে জয়ী হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন ৷ এরপর নাগরিকত্ব ইস্যুতে রাজনীতির নানা রং ঢুকেছে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে ৷ বাংলার ভোটব্যাঙ্কে দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন মতুয়ারা ৷ সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপি- সব দলই নাগরিকত্ব ইস্যুতে ভোট আদায়ে মাঠে নেমেছে ৷

আগামী সোমবার, 20 মে বনগাঁয় আবার একটা ভোট ৷ নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে বনগাঁর বুথে বুথে কণ্ঠি গলায় মতুয়ারা ভোট দেবেন ৷ এখন রাজনীতির বদান্যতায় মতুয়া মহাসঙ্ঘ দ্বিধাবিভক্ত ৷ 2009 সালে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে জন্ম নেওয়া বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হন তৃণমূলের গোবিন্দ চন্দ্র নস্কর ৷ পরের নির্বাচনে 2014 সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন প্রমথরঞ্জন ও বীণাপানি দেবীর বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ৷ 2015 সালের কপিলকৃষ্ণের আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ৷

2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁয় বিজেপির ঝুলিতে ছিল 4 শতাংশেরও কম ভোট ৷ তবে এরপরে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতে ধারাবাহিকভাবে বিজেপি তাদের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ক্রমশ বাড়িয়েছে ৷ 2014 সালে তারা পেয়েছিল 19 শতাংশের সামান্য বেশি ভোট ৷ এরপর 2015 সালের উপ-নির্বাচনে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় 24.17 শতাংশ ৷ আর 2019-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি যে শুধু তাদের ভোটের ঝুলি প্রায় 48.85 শতাংশে ভরিয়েছিল তাই নয়, তারা তৃণমূলকে পরাস্ত করে আসনটি জিতেও নেয় ৷ বনগাঁ কেন্দ্রে গেরুয়া পতাকা ওড়ানো ঠাকুরবাড়ির সন্তান শান্তনু ঠাকুর জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন ৷

2011 সালে রাজ্যে পালাবদল হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ মতুয়ারা যে প্রমথরঞ্জনের স্ত্রী বীণাপানি দেবীকে 'বড়মা' বলে পুজো করতেন, তাঁর হাত ধরে মমতাকে একসময়ে নাগরিকত্বের প্রশ্নে আশ্বাস দিতেও দেখা গিয়েছিল ৷ 2019 সালে বীণাপানি দেবীর মৃত্যু হয় ৷ তিনি বেঁচে থাকতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু'বার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেখেছেন ৷ কিন্তু, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনও সমাধান দেখে যেতে পারেননি ৷

Bangaon LS tough fight between TMC and BJP
বনগাঁ লোকসভায় বিজেপির শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস (ইটিভি ভারত)

গত 11 মার্চ দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ লাগু করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যে প্রচারে এসে সিএএ আইনে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ৷ এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইন প্রণয়নের আগে থাকতে সিএএ-র তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন ৷ তাঁর দাবি, এই আইনে নাগরিকত্বের আবেদন জানালেই আবেদনকারী বিদেশি হয়ে যাবেন ৷ তাছাড়া বাংলায় বসবাসকারী মতুয়াদের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড রয়েছে ৷ তাঁরা রাজ্যের সব সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছেন ৷ তাই তাঁরা সবাই ভারতের নাগরিক ৷ বরং নতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করলে সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হতে পারেন মতুয়ারা, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷

বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে কল্যাণী ও হরিণঘাটা পড়ে নদিয়া জেলায় ৷ বাকি পাঁচটি বিধানসভা বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা এবং স্বরূপনগর উত্তর 24 পরগনা জেলার মধ্যে পড়ে ৷ এর মধ্যে নদিয়ার দু'টি বিধানসভা বিজেপির দখলে ৷ উত্তর 24 পরগনায় একমাত্র স্বরূপনগর ছাড়া বাকি সবক'টিতে একুশের নির্বাচনে গেরুয়া পতাকা উড়েছে ৷

খাতায়-কলমে এই বনগাঁ লোকসভায় মতুয়া কত শতাংশ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে ৷ ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি থেকে দু'রকম তথ্য পাওয়া যায় ৷ মতুয়া মহাসংঘের অন্যতম নেত্রী মমতা বালা ঠাকুরের সমর্থকরা বলেন এখানে 32 শতাংশ মতুয়ার বাস ৷ বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের অনুগামীদের মতে, এই লোকসভা কেন্দ্রে প্রায় 42 শতাংশ মতুয়া ভোটার রয়েছে ৷ যে যাই বলুক, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ আসনে এই মুহূর্তে নির্ধারক শক্তি অবশ্যই মতুয়া সম্প্রদায় ৷

এবার মতুয়া নেত্রী মমতা বালাকে লোকসভায় টিকিট দেয়নি তৃণমূল নেতৃত্ব ৷ পরিবর্তে তাঁকে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠিয়েছে দল ৷ বদলে তৃণমূল ভরসা রেখেছে বিজেপির টিকিটে জেতা এবং দল পরিবর্তন করা বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের উপর ৷ বিশ্বজিতের মতুয়াদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো বনগাঁয় ফের ঘাসফুল ফোটাতে চাইছেন ৷

অন্যদিকে, মতুয়াদের মন জয়ে কোনও কসুর বাকি রাখছে না বিজেপি নেতৃত্ব ৷ প্রধানমন্ত্রী মোদি, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা সকলেই ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে নতমস্তক হয়েছেন ৷ লক্ষ্য একটাই বনগাঁ থেকে শান্তনুর দ্বিতীয় বার জয়, আর সিএএ-কে তুরূপের তাস করে মতুয়াদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আদায় ৷

নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিজেপির আশ্বাস এবং সিএএ কি আবারও তাদের বনগাঁর মসনদে ফিরিয়ে আনবে ? নাকি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলবে না এবং ঘাসফুল আবারও বনগাঁয় ফেরত আসবে, তার উত্তর দেবে 4 জুন ৷

আরও পড়ুন:

  1. নৌ-শিল্পে ভাটা, উদাস বলাগড় আবারও ভোটের লাইনে
  2. নামেই জিআই ট্যাগ, ধুঁকছে বাংলার তাঁত; কী বলছে তাঁত শিল্পীদের জনাদেশ ?
  3. 'আমাদের ভোট আমাদেরই থাক', ঝাড়গ্রামে ভোট সমীকরণে কুড়মিরা, লাভ কার ?

বনগাঁ লোকসভায় প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মতুয়া ভোট (ইটিভি ভারত)

বনগাঁ, 18 মে: "আমরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চাই", বলছিলেন মতুয়া পরিবারের ছেলে পবিত্র গোঁসাই ৷ দেশভাগ এবং তার পর 1971 সালে বাংলাদেশ থেকে একপ্রকার প্রাণ হাতে করে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন ৷ তার মধ্যে ছিলেন বিশাল সংখ্যায় নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়, যাঁদের অন্যতম মতুয়ারা ৷ তখন কে কোথায় কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাবেন, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন ৷

কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে এলে কাগজ সঙ্গে রাখতে হবে, তা মাথায় ছিল না অনেকেরই ৷ পবিত্র বলেন, "আমরা বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কোনও কাগজ নিয়ে আসতে পারিনি ৷ একাত্তরের গণ্ডগোলে জীবন বাঁচিয়ে আসাটাই বড় দায় ছিল ৷" একই কথা বলছেন আরেক মতুয়া হরিচাঁদ গোঁসাই ৷ তাঁর কথায়, "রাতের অন্ধকারে মা-বোনদের ইজ্জত এবং ধর্মকে রক্ষা করার জন্য সীমান্ত দিয়ে কে কোথায় কীভাবে পালিয়ে এসেছেন, তার কোনও দিশা ছিল না ৷ চাকরি করতে গেলে ছেলেমেয়েদের কাছে একাত্তর সালের আগের দলিল চায় ৷ কিন্তু আমরা তো তার আগে আসিনি !"

উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে একটি সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেন হরিচাঁদ ঠাকুর ৷ সমাজের নিচু-অস্পৃশ্য মতুয়াদের বাঁচার রাস্তা দেখান প্রথম সঙ্ঘাধিপতি ৷ এরপর সেই ধর্মান্দোলন চালিয়ে যান তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ৷ 1947 সালে পূর্ববঙ্গে মতুয়াদের পরিস্থিতি বদলায় ৷ দেশভাগের ফলে খুলনা, যশোর এবং ফরিদপুর পাকিস্তানে চলে যায় ৷ এই অঞ্চলগুলিতে বাস করত নমঃশূদ্র মতুয়ারা ৷ সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসেন ৷

Matua Factor in Bangaon LS Poll 2024
উত্তর 24 পরগনার বনগাঁ লোকসভায় মতুয়া ফ্যাক্টর সব দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ (ইটিভি ভারত)

ভারত সীমান্তের কাছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা এবং মুর্শিদাবাদে বসতি গড়তে থাকেন হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের শিষ্যরা ৷ শুরু হয় নতুন দেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম ৷ সেই সময় বা বলা ভালো দেশভাগের আগে থাকতে তাঁদের বাঁচার পথ দেখিয়েছিলেন আরেক সঙ্ঘাধিপতি, হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রপৌত্র, গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ৷ যিনি পিআর ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত ৷

1947 সালের ডিসেম্বরে উত্তর 24 পরগনার বনগাঁয়, অধুনা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে, এক খণ্ড জমি কেনেন পিআর ঠাকুর ৷ সেখানে চালা বানিয়ে মতুয়াদের জন্য হরিজন কলোনির সূচনা করেন ৷ পরে তাঁর জীবদ্দশাতেই সেখানে তৈরি হয় মতুয়াদের মন্দির, আজকের ঠাকুরনগর ৷ হরিচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের ঘিরে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাকে রাজনৈতিক রূপ দিলেন প্রমথরঞ্জন ৷ ধীরে ধীরে এই ঠাকুরনগর তথা উত্তর 24 পরগনা, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, রাণাঘাটের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকে নিজেদের বাসযোগ্য করে তোলেন মতুয়ারা ৷ তবে যে রাতে ছিন্নমূল মতুয়ারা ভারতে পা রেখেছিলেন সেই রাত থেকেই তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল ৷ সেই কিস্সা আজও চলছে ৷

ভারতে এসে পিআর ঠাকুর কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমে হরিণঘাটা ও পরে হাঁসখালি বিধানসভা থেকে জয়ী হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন ৷ এরপর নাগরিকত্ব ইস্যুতে রাজনীতির নানা রং ঢুকেছে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে ৷ বাংলার ভোটব্যাঙ্কে দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন মতুয়ারা ৷ সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপি- সব দলই নাগরিকত্ব ইস্যুতে ভোট আদায়ে মাঠে নেমেছে ৷

আগামী সোমবার, 20 মে বনগাঁয় আবার একটা ভোট ৷ নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে বনগাঁর বুথে বুথে কণ্ঠি গলায় মতুয়ারা ভোট দেবেন ৷ এখন রাজনীতির বদান্যতায় মতুয়া মহাসঙ্ঘ দ্বিধাবিভক্ত ৷ 2009 সালে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে জন্ম নেওয়া বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হন তৃণমূলের গোবিন্দ চন্দ্র নস্কর ৷ পরের নির্বাচনে 2014 সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন প্রমথরঞ্জন ও বীণাপানি দেবীর বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ৷ 2015 সালের কপিলকৃষ্ণের আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ৷

2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁয় বিজেপির ঝুলিতে ছিল 4 শতাংশেরও কম ভোট ৷ তবে এরপরে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতে ধারাবাহিকভাবে বিজেপি তাদের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ক্রমশ বাড়িয়েছে ৷ 2014 সালে তারা পেয়েছিল 19 শতাংশের সামান্য বেশি ভোট ৷ এরপর 2015 সালের উপ-নির্বাচনে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় 24.17 শতাংশ ৷ আর 2019-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি যে শুধু তাদের ভোটের ঝুলি প্রায় 48.85 শতাংশে ভরিয়েছিল তাই নয়, তারা তৃণমূলকে পরাস্ত করে আসনটি জিতেও নেয় ৷ বনগাঁ কেন্দ্রে গেরুয়া পতাকা ওড়ানো ঠাকুরবাড়ির সন্তান শান্তনু ঠাকুর জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন ৷

2011 সালে রাজ্যে পালাবদল হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ মতুয়ারা যে প্রমথরঞ্জনের স্ত্রী বীণাপানি দেবীকে 'বড়মা' বলে পুজো করতেন, তাঁর হাত ধরে মমতাকে একসময়ে নাগরিকত্বের প্রশ্নে আশ্বাস দিতেও দেখা গিয়েছিল ৷ 2019 সালে বীণাপানি দেবীর মৃত্যু হয় ৷ তিনি বেঁচে থাকতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু'বার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেখেছেন ৷ কিন্তু, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনও সমাধান দেখে যেতে পারেননি ৷

Bangaon LS tough fight between TMC and BJP
বনগাঁ লোকসভায় বিজেপির শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস (ইটিভি ভারত)

গত 11 মার্চ দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ লাগু করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যে প্রচারে এসে সিএএ আইনে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ৷ এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইন প্রণয়নের আগে থাকতে সিএএ-র তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন ৷ তাঁর দাবি, এই আইনে নাগরিকত্বের আবেদন জানালেই আবেদনকারী বিদেশি হয়ে যাবেন ৷ তাছাড়া বাংলায় বসবাসকারী মতুয়াদের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড রয়েছে ৷ তাঁরা রাজ্যের সব সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছেন ৷ তাই তাঁরা সবাই ভারতের নাগরিক ৷ বরং নতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করলে সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হতে পারেন মতুয়ারা, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷

বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে কল্যাণী ও হরিণঘাটা পড়ে নদিয়া জেলায় ৷ বাকি পাঁচটি বিধানসভা বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা এবং স্বরূপনগর উত্তর 24 পরগনা জেলার মধ্যে পড়ে ৷ এর মধ্যে নদিয়ার দু'টি বিধানসভা বিজেপির দখলে ৷ উত্তর 24 পরগনায় একমাত্র স্বরূপনগর ছাড়া বাকি সবক'টিতে একুশের নির্বাচনে গেরুয়া পতাকা উড়েছে ৷

খাতায়-কলমে এই বনগাঁ লোকসভায় মতুয়া কত শতাংশ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে ৷ ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি থেকে দু'রকম তথ্য পাওয়া যায় ৷ মতুয়া মহাসংঘের অন্যতম নেত্রী মমতা বালা ঠাকুরের সমর্থকরা বলেন এখানে 32 শতাংশ মতুয়ার বাস ৷ বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের অনুগামীদের মতে, এই লোকসভা কেন্দ্রে প্রায় 42 শতাংশ মতুয়া ভোটার রয়েছে ৷ যে যাই বলুক, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ আসনে এই মুহূর্তে নির্ধারক শক্তি অবশ্যই মতুয়া সম্প্রদায় ৷

এবার মতুয়া নেত্রী মমতা বালাকে লোকসভায় টিকিট দেয়নি তৃণমূল নেতৃত্ব ৷ পরিবর্তে তাঁকে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠিয়েছে দল ৷ বদলে তৃণমূল ভরসা রেখেছে বিজেপির টিকিটে জেতা এবং দল পরিবর্তন করা বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের উপর ৷ বিশ্বজিতের মতুয়াদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো বনগাঁয় ফের ঘাসফুল ফোটাতে চাইছেন ৷

অন্যদিকে, মতুয়াদের মন জয়ে কোনও কসুর বাকি রাখছে না বিজেপি নেতৃত্ব ৷ প্রধানমন্ত্রী মোদি, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা সকলেই ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে নতমস্তক হয়েছেন ৷ লক্ষ্য একটাই বনগাঁ থেকে শান্তনুর দ্বিতীয় বার জয়, আর সিএএ-কে তুরূপের তাস করে মতুয়াদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আদায় ৷

নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিজেপির আশ্বাস এবং সিএএ কি আবারও তাদের বনগাঁর মসনদে ফিরিয়ে আনবে ? নাকি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলবে না এবং ঘাসফুল আবারও বনগাঁয় ফেরত আসবে, তার উত্তর দেবে 4 জুন ৷

আরও পড়ুন:

  1. নৌ-শিল্পে ভাটা, উদাস বলাগড় আবারও ভোটের লাইনে
  2. নামেই জিআই ট্যাগ, ধুঁকছে বাংলার তাঁত; কী বলছে তাঁত শিল্পীদের জনাদেশ ?
  3. 'আমাদের ভোট আমাদেরই থাক', ঝাড়গ্রামে ভোট সমীকরণে কুড়মিরা, লাভ কার ?
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.