বালুরঘাট, 19 মার্চ: একসময় ছিল কোদাল-বেলচার দুর্গ ৷ 1977 সাল থেকে 2009 সাল ৷ মধ্যের 10টি লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র ছিল আরএসপির দখলে ৷ প্রথমে পলাশ বর্মন, তারপর রণেন বর্মন ও প্রশান্তকুমার মজুমদার জমানার পর এই কেন্দ্রে শেষ হয় বামেদের মেজো শরিকের আধিপত্য ৷ 2014 সালে আরএসপি প্রার্থী বিমলেন্দু সরকারকে হারিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেন তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষ ৷ তবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হতেই ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে রাজ্যের শাসকদলের ৷ ঘাসফুলের জায়গা নেয় পদ্ম ৷ নতুন সাংসদ নির্বাচিত হন সুকান্ত মজুমদার ৷ গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই রাজনীতিবিদকে পরবর্তীতে দলের রাজ্য সভাপতি পদে নিয়োগ করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ৷ এখনও তিনি সেই পদে আসীন ৷
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে ৷ আগামী 26 এপ্রিল নিজেদের নতুন সাংসদ নির্বাচিত করবেন এই কেন্দ্রের ভোটাররা ৷ তার আগে গত পাঁচ বছরে সাংসদ সুকান্ত তাঁর সংসদীয় এলাকার জন্য কী কাজ করেছেন, নিজের সাংসদ কোটার টাকা কতটা খরচ করতে পেরেছেন, মানুষ তাঁর কাজে কতটা খুশি, সে সব নিয়েই তত্ত্বতালাশ চালাল ইটিভি ভারত ৷
সাংসদ কোটার অর্থ খরচের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের তথ্য কিন্তু সুকান্তকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছে ৷ করোনার জন্য কোনও সাংসদই প্রথম দু’বছর এই কোটার টাকা পাননি ৷ বাকি তিন বছরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে প্রায় সাড়ে 17 কোটি টাকা ৷ প্রশাসনিক তথ্য বলছে, এর মধ্যে 17 কোটি 38 লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছেন সুকান্ত ৷ সে সব প্রকল্পের অধিকাংশ বাস্তবায়িত হলেও বেশিরভাগই টেন্ডার হয়ে আটকে রয়েছে ৷ আরও কিছু প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ৷
সুকান্তর সাংসদ কোটার অর্থ মূলত খরচ হয়েছে নিচু স্তরে ৷ এর মধ্যে যেমন একাধিক এলাকায় সোলার লাইটের ইউনিট বসানো হয়েছে, তেমনই রয়েছে মার্ক 2 টিউবওয়েল, বিশেষভাবে সক্ষমদের তিন চাকার সাইকেল বিলি, দুঃস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করতে সেলাই মেশিন প্রদান, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের ল্যাপটপ প্রদান ইত্যাদি ৷ তাঁর কাজ নিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে ৷ অনেকে খুশি, অনেকে আবার অখুশি ৷ তাঁরা সাংসদের কাছে আরও বেশি আশা করেছিলেন ৷ তবে জেলায় রেলের উন্নয়নে বেশ ভালো কাজের উদাহরণ তৈরি করেছেন সাংসদ সুকান্ত ৷ এর মধ্যে যেমন রয়েছে বালুরঘাট স্টেশনকে অমৃত ভারত প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা, তেমনই বালুরঘাট স্টেশনে পিট ও সিক লাইনের কাজ, থমকে থাকা বালুরঘাট-হিলি রেল সম্প্রসারণ প্রকল্পকে ফের চালু করা, বিভিন্ন স্টেশনের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, একলাখি থেকে বালুরঘাট পর্যন্ত রেলের ইলেকট্রিফিকেশন, রেলের রেক পয়েন্ট নির্মাণ, বালুরঘাট-শিয়ালদা, বালুরঘাট-নবদ্বীপ ধাম নয়া ট্রেন, বালুরঘাট-হাওড়া ট্রেনকে সপ্তাহে পাঁচদিনে বর্ধিত করা, দিল্লিগামী ফরাক্কা এক্সপ্রেসকে বালুরঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারণ, বালুরঘাট থেকে বেঙ্গালুরু ও গুয়াহাটি পর্যন্ত নতুন ট্রেনের প্রস্তাব ইত্যাদি ৷
সাংসদের গত পাঁচ বছরের কাজে অবশ্য খুশি নন শুড়িপুকুর গ্রামের নুর আলম ৷ তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় সাংসদ কোনও কাজ করেননি ৷ এমনকি পথবাতি পর্যন্ত করে দেননি ৷ সাংসদ হিসাবে তাঁর আমাদের গ্রামেও কাজ করা উচিত ছিল ৷ অন্যান্য জায়গায় অবশ্য তিনি সে সব করেছেন ৷ কিন্তু ব্রাত্য থেকে গিয়েছে আমাদের গ্রাম ৷ সাংসদ হিসাবে এই গ্রামেও তাঁর কাছ থেকে সে সব কাজ আশা করেছিলাম ৷”
গঙ্গারামপুর শহরের নিত্যানন্দ সুত্রধর বলছেন, “সাংসদ সুকান্ত মজুমদার রেলের কিছু কাজ অবশ্যই করেছেন ৷ তবে তিনি পৌর এলাকার উন্নয়নে সেভাবে কোনও কাজ করেননি ৷ সামান্য যে কাজ হচ্ছে, তা রাজ্যের তরফেই হয়েছে ৷ সাংসদ হিসাবে তিনি পৌর এলাকায় কিছু কাজ করতেই পারতেন ৷ অবশ্য পঞ্চায়েত কিংবা পৌরসভাগুলি রাজ্য প্রশাসনের হাতে থাকায় সাংসদ হিসাবে সুকান্ত মজুমদার সেভাবে কাজও করতে পারেন না ৷ তাঁকে কাজ করতেও দেয় না ৷ এ বার সাংসদ নির্বাচিত হলে বিভিন্ন গ্রামে আলোর ব্যবস্থা, প্রতি বাড়ির নিকাশি ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় সঠিক মানুষকে ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর কাছে দাবি রাখছি ৷”
সাংসদের কাছে আশাটা একটু অন্যরকম ছিল বুনিয়াদপুর শহরের বাসিন্দা কেডি ভৌমিকের ৷ তিনি বলেন, “এই জেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব ৷ এর জন্য এখানে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা খুব বেশি ৷ জেলার ছেলেরা যাতে জেলায় কাজ পায়, তার কোনও উদ্যোগ সুকান্ত মজুমদার নেননি ৷ তাঁর দল কেন্দ্রের ক্ষমতায়, তিনি নিজে দলের রাজ্য সভাপতি ৷ তাই একটু চেষ্টা করলেই তিনি জেলায় শিল্প স্থাপন করতে পারতেন ৷ রেলের কারখানা চালু করতে পারতেন ৷ তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর বেকার কাজ পেত ৷”
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি সুভাষ ভাওয়াল বলছেন, “গত পাঁচ বছরে সাংসদ তেমন কোনও কাজই করেননি ৷ এই পাঁচ বছরে তিনি নিজের সাংসদ কোটায় 25 কোটি টাকা পেয়েছেন ৷ কিন্তু দু’একটি ছোট লাইট ছাড়া আমার চোখে তেমন কিছু উন্নয়ন ধরা পড়েনি ৷ সাংসদ হিসাবে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ৷ তিনি দাবি করছেন, তিনি নাকি নিজের সাংসদ কোটার অর্থ প্রায় পুরোটাই খরচ করতে পেরেছেন ৷ কিন্তু আমি যা শুনেছি, তাতে তিনি নিজের সাংসদ কোটার 35 শতাংশ অর্থও খরচ করতে পারেননি ৷ সময়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমরা এর পুরো হিসাব পাব ৷ পরিসংখ্যানই শেষ কথা বলবে ৷ ঊনিশে তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার অন্যতম ছিল হিলি থেকে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে মেঘালয়ের তুরা পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করা ৷ সেই কাজ এখনও হয়নি ৷ একদিন তিনি এ নিয়ে সংসদে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন ৷ তাতেই গোটা জেলায় উৎসব শুরু করে দিয়েছিল বিজেপি ৷ আর বিজেপির প্রতিশ্রুতির কী হয়, তা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ৷ যেখানে মোদিই নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি, তাঁর দলের সাগরেদ হয়ে সুকান্তবাবু আর কতটা প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন ! আমরাই বা তাঁর কাছে কতটা আশা করব !”
সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যেসব প্রকল্প থাকে তার মধ্যে অন্যতম রেল ৷ আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, গত পাঁচ বছরে রেলে যা কাজ হয়েছে তা যদি আগে কোনও সাংসদ করে থাকেন, তবে আমি নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে এই কেন্দ্রটি তৃণমূলকে ওয়ারওভার দিয়ে দেব ৷ আমরা কাজ করে মানুষকে দেখিয়েছি, পরিষেবা দিয়েছি ৷ বালুরঘাট থেকে একাধিক নতুন ট্রেন চালু হয়েছে ৷ হাওড়াগামী ট্রেন সপ্তাহে দু’দিন থেকে পাঁচদিন করা হয়েছে ৷ রেলে প্রচুর কাজ হয়েছে ৷ আগামীতেও অনেক কাজ হবে ৷ বুনিয়াদপুরে জাতীয় স্তরের স্টেডিয়াম নির্মাণের চেষ্টা চলছে ৷ ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বাণগড়ে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছি আমরা ৷ সেই টাকায় বাণগড়কে ঢেলে সাজানো হবে ৷ প্রচুর পর্যটক আসবেন ৷ মানুষের কর্মসংস্থানও হবে ৷ আমার সাংসদ কোটার প্রায় সম্পূর্ণ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে ৷ এ বার সব জেলা প্রশাসনের উপর নির্ভর করছে ৷ আমরা গত নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তার প্রায় সবটাই পূরণ করতে পেরেছি ৷ যে সব কাজ এখনও অসম্পূর্ণ আছে, আগামী পাঁচ বছরে তা সম্পূর্ণ করাই আমার এ বারের প্রতিশ্রুতি ৷ এর সঙ্গে বালুরঘাট থেকে একলাখি পর্যন্ত ডবল লাইন আর বেঙ্গালুরু বা দক্ষিণ ভারতের অন্য কোথাও পর্যন্ত ট্রেন চালু করা আমার প্রধান লক্ষ্য ৷ কথা হয়েই আছে ৷ সুকান্ত মজুমদার জিতলেই ট্রেন চালু হয়ে যাবে ৷”
আরও পড়ুন: