বহরমপুর, 11 মে: বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার গড় মুর্শিদাবাদে জাতীয় কংগ্রেসকে এখনও প্রাসঙ্গিক রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চরিত্রটির নাম নিয়ে বঙ্গবাসীর বিশেষ কোনও সন্দেহ নেই ৷ আজও নেই, আগেও ছিল না ৷ সেই অধীররঞ্জন চৌধুরী নিজের রাজনৈতিক জীবনে আরও একবার পরীক্ষায় বসতে চলেছেন আগামী 13 মে ৷ ওই দিন মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কেন্দ্র থেকে অধীর ষষ্ঠ বারের জন্য প্রার্থী ৷
এতদিন কখনও তৃণমূল কংগ্রেসের গায়ক-প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন, কিংবা নিজের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক ছায়াসঙ্গী, যিনি পরে দল বদলে ঘাসফুলে নাম লেখান, সেই অপূর্ব সরকার ওরফে ডেভিড অথবা আরও আগে বামফ্রন্টের ত্রিদিব বা প্রমথেশের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নেমেছেন বহরমপুরের 'মুকুটহীন নবাব' ৷ এবার তাঁর সামনে গুজরাতের তারকা ক্রিকেটার, তৃণমূলের ইউসুফ ৷ আর বিগত কয়েক দশক ধরে বহরমপুরের আনাচে কানাচে বাড়তে থাকা বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী, এলাকার জনপ্রিয় শিক্ষক ডাঃ নির্মল সাহা ৷ একসময় এখানে বাম শরিক রেভোলিউশনারি সোশালিস্ট পার্টি বা আরএসপির দাপট ছিল ৷ আবার যখন তৃণমূলের অস্তিত্ব ছিল না, সেই তখন থেকে এখানে প্রার্থী দিয়ে আসছে বিজেপি ৷
সালটা 1999 ৷ তখন বাংলায় সিপিএম ৷ সদ্য কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় ৷ সেবারের লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রের তিন-তিনবারের আরএসপি সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়কে পরাজিত করলেন অধীর ৷ ব্যবধান ছিল 95 হাজারের কিছু বেশি ৷ তারপর থেকে বহরমপুরে অধীর চৌধুরী জয়ী হবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি ৷ বরং প্রশ্ন ছিল, কংগ্রেসের পরে দ্বিতীয় স্থানে কোন দল থাকবে ? কোন বিরোধী প্রার্থী কত ভোটের মার্জিনে হারবেন ? 2009 সাল পর্যন্ত আরএসপির প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ৷ 2014 সালে তৃণমূল কংগ্রেসের গায়ক ইন্দ্রনীল সেন দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন ৷ আরএসপি তৃতীয় স্থানে নেমে যায় ৷ 2019 সালের লোকসভা ভোটে একদা ছায়াসঙ্গী ডেভিডের বিরুদ্ধে জিতলেও অধীরের ভোট-ব্যবধান 1 লক্ষেরও বেশ খানিকটা কম ছিল ৷ 1999 সালের পর এই প্রথম ৷ এতেই কি বহরমপুরে আশার আলো দেখছে তৃণমূল-বিজেপি ?
তৃণমূলের ইউসুফ পাঠানের বিরুদ্ধে 'বহিরাগত' তকমা খাড়া করেছে কংগ্রেস-বিজেপি ৷ অন্যদিকে এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক নির্মল সাহা যথেষ্ট পরিচিত ৷ কোভিডকালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ৷ বিভিন্ন সময়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসাও করেছেন ৷ যার জেরে জেলাজুড়ে জনপ্রিয়তাও যথেষ্ট ৷
বিজেপি সরকারকে ধরাশায়ী করতে একসময় 'ইন্ডিয়া' তৈরি হয়েছিল ৷ দেশের মধ্যে জোটের সদস্য দলগুলি আসন বণ্টন করে লড়বেন, তেমনটা কথা হয়েছিল ৷ পশ্চিমবঙ্গে সেই কথা 'কথাই' থেকে গিয়েছে ৷ রাহুল যখন উত্তরবঙ্গে ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা করছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় এই জোট ভাঙার কথা ঘোষণা করছেন ৷ এই জোট ভাঙার জন্য তিনি ও তাঁর দল সমানভাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরকেই দায়ী করেছে ৷
পাঁচ-পাঁচবারের কংগ্রেস সাংসদও বহরমপুর থেকে লড়ার জন্য তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ৷ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আহ্বান জানিয়েছেন ৷ ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, "দিদি আমাকে হারাতে চাইছেন ৷ আমাকে হারাতে পারলে তাঁরা মনে করছেন, বাংলায় সবচেয়ে বড় জয় হবে ৷ আমি চেয়েছিলাম, খোকাবাবু দাঁড়ান কিংবা দিদি দাঁড়ান ৷ এই বহরমপুর লোকসভায় অধীরকে পরাজিত করতে পারলে সেটা খোকাবাবু আর দিদির জয় হবে ৷ আর অধীরকে পরাজিত করতে না পারলে সেটা দিদি আর খোকাবাবুর পরাজয় ৷ ওরা শুধু এইটুকু কথা বলুন ৷ আমায় হারাতে পারলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব ৷"
এই চ্যালেঞ্জের কোনও উত্তর মমতা বা অভিষেক দিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি ৷ এপ্রিল-মে'র প্রবল তাপপ্রবাহে তৃণমূল সুপ্রিমো একের পর এক কেন্দ্রে গিয়ে প্রার্থীদের সমর্থনে জনসভা করেছেন ৷ এক দিনে একাধিক জেলাতেও গিয়েছেন ৷ এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত বহরমপুরে কিন্তু পা রাখেননি তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ সেখানে ইউসুফের হয়ে প্রচার সেরেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাহলে কি দিদি একপ্রকার মেনে নিয়েছেন যে বহরমপুরে অধীর অপরাজেয় ?
লড়াইটা কি এবারে আরও একটু কঠিন ? ডেভিড জয়ের ব্যবধান কমিয়েছিলেন। পাঠান কি শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন ? বহরমপুরে তৃণমূল নেতাদের জমায়েতে কান পাতলে এটাও শোনা যাচ্ছে, তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একটা বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। গেরুয়া শিবির কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কে কতটা থাবা বসাচ্ছে সেটা জানতে চান তাঁরা। আর সেই অঙ্কে শেষ হাসি ইউসুফ পাঠান হাসেন কি না, প্রশ্ন তাঁদের ৷ অধীরও তাকিয়ে রয়েছেন তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা বহরমপুরের দিকে ৷ বহু রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাক্ষী মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ষষ্ঠ বারের জন্যে তাঁকেই বেছে নেবে, নাকি ঐতিহ্যের লালবাগে নতুন কোনও রাজনৈতিক ফুল ফুটবে, সেটা জানার জন্য অপেক্ষার অবসান হবে 4 জুন ৷
আরও পড়ুন: