কলকাতা, 13 এপ্রিল: টিকিটের তুলনায় 225 টাকা বেশি মিলেছিল সিএসটিসির বাসের কন্ডাক্টরের ব্যাগে ৷ ব্যাগ বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে শো-কজ করা হয়েছিল ৷ দোষী সাব্যস্ত করে মাইনে কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর । তিনি এই টাকা অস্বচ্ছভাবে আত্মসাৎ করেননি প্রমাণ করতে আদালত চত্বরে জুতো ছিঁড়ে গিয়েছে ওই কন্ডাক্টরের ৷ আইনি লড়াইয়ে কেটে গিয়েছে যৌবনের 18 বছর ৷ অবশেষে 53 বছরে এসে শাপমুক্ত হলেন তিনি । ওই ব্যক্তিকে 19 বছরের তাঁর বকেয়া মাইনে মিটিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ৷
কী ঘটেছিল ?
সালটা ছিল 2005 ৷ বরানগরের বাসিন্দা উত্তমকুমার ঠাকুরের তখন বয়স ছিল 35 ৷ পেশায় বাস কন্ডাক্টর । সিএসটিসির বরানগর কাশিপুর ডিপোতে কর্মরত ছিলেন সেসময় । 2005 সালের এক সকালে বাসের প্রথম যাত্রীকে খুচরো টাকা দেওয়ার জন্য চালকের কাছ থেকে 500 টাকা খুচরো নিয়েছিলেন তিনি । কিছুদূর বাস যাওয়ার পর মাঝ পথে সিএসটিসির কর্তব্যরত আধিকারিকরা চেকিংয়ের জন্য বাসে ওঠেন ৷ আধিকারিকরা টিকিট বিক্রি মিলিয়ে দেখেন উত্তমের ক্যাশ বাক্সে 225 টাকা বেশি । কেন এই টাকা টিকিট বিক্রির থেকে বেশি হল, উত্তমের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা । উত্তম তাঁদের জানিয়েছিলেন, 500 টাকা বাস চালকের কাছ থেকে খুচরো নিয়েছিলেন ।
হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন উত্তম
এরপরেও সিএসটিসির আধিকারিকরা উত্তমকুমার ঠাকুরের ব্যাগ বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাঁকে শোকজ করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন । কিন্তু বিভাগীয় তদন্তের সময় কেন কন্ডাক্টারের কাছে বাড়তি এই টাকা এলো সেই প্রসঙ্গে তৎকালীন ওই বাস চালককে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করেননি কর্তব্যরত আধিকারিকরা বলে অভিযোগ । একতরফাভাবে উত্তমকে শুধু দোষী সাব্যস্তই নয়, তাঁর বেতন কমিয়ে দেওয়া এবং তাঁর সমস্ত বৈধ ভাতা বন্ধ করে দেওয়ারও নির্দেশ দেন তদন্তকারীরা ।
পরে সিএসটিসির চেয়ারম্যানের কাছে অ্যাপিল করেন উত্তম । কিন্তু চেয়ারম্যান বা তাঁর দফতর উত্তমের আবেদনের শুনানি না করেই বিষয়টি দীর্ঘদিন ফেলে রাখেন বলে অভিযোগ । তারপরেই 2006 সালে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন উত্তম । হাইকোর্টের নির্দেশেই সিএসটিসির অ্যাপিলেট সাইড উত্তমের বিরুদ্ধে আধিকারিকদের নির্দেশ বহাল রেখেছিল । সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করেই ফের কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন উত্তম ।
মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে ওঠে ৷ উত্তমকুমার ঠাকুরের পক্ষের আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরী আদালতে জানান, "উত্তমকে উপযুক্ত নথিপত্র না-দিয়েই তাঁর বক্তব্য না শুনে, একতরফাভাবে সিএসটিসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছে । শুধু তাই নয়, সেদিন ঘটনার সময় উপস্থিত বাস চালককে কোনওরকম জিজ্ঞাসাবাদ করেনি সিএসটিসি ৷ অথচ উত্তমকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া হয় । ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস রুলের 52 নম্বর ধারা না মেনেই একতরফাভাবে উত্তমের মাইনে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে তাঁকে 15 হাজার টাকা বেতন কম দেওয়া হচ্ছে ।"
হাইকোর্ট পরিবহণ দফতরের কাছে বারবার উত্তম ঠাকুরের ফাইল তলব করে ৷ কিন্তু পরিবহণ দফতর তাঁর কোন ফাইলই আদালতে পেশ করতে পারে না ৷ এই বিষয়ে প্রশ্নও তোলেন আইনজীবী আশিস চৌধুরী । তিনি দাবি করেন, "তাহলে যাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো আশ্চর্যজনকভাবে তাঁরই ফাইল হারিয়ে গেল সুতরাং সিএসটিসি কর্তৃপক্ষ স্বচ্ছভাবে এই প্রক্রিয়া করেনি ৷ তাই তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া হোক ।" রাজ্য পরিবহণ দফতরের পক্ষের আইনজীবী নয়নচাঁদ বিহানি আদালতে জানান, "সমস্ত পরিবহণ দফতরের নিয়ম মেনে উত্তমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু কীভাবে ফাইল হারিয়ে গেল সে বিষয়ে তিনি আদালতকে স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি ।"
আদালতের নির্দেশ
এরপরেই শুক্রবার বিচারপতি পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, উত্তমকুমার ঠাকুরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি । পাশাপাশি 2005 সাল থেকে তাঁর যে বেতনের 15000 টাকা কম দেওয়া হচ্ছিল, তা অবিলম্বে আগের বেতন পরিকাঠামোয় ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তিনি যে বর্ধিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন এতদিন সেই সবকিছু এবং বকেয়া বেতনের টাকা আগামী তিনমাসের মধ্যে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি ।
আরও পড়ুন: