হায়দরাবাদ, 1 জুন: 2019 এর পর থেকে বঙ্গে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি ৷ গত লোকসভা নির্বাচনে 18টি আসন জিতেছিল গেরুয়া শিবির ৷ উত্তরবঙ্গ উজাড় করে পদ্মশিবিরের ভোটবাক্স ভরিয়েছিল ৷ ফলে বঙ্গে আরও জোরালোভাবে দাঁত ফোটাতে উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি বাকি আসনেও নজর দিয়েছে বিজেপি ৷ শেষ মুহূর্তে ‘একলা চলা’র নীতি নেওয়া তৃণমূল মরিয়া একাধিক দুর্নীতি, অভিযোগের হার্ডলস পেরিয়ে রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ৷ একাধিক আসনে ‘ফ্যাক্টর’ হতে পারে বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতাও ৷
44 দিন ধরে, 7 দফায় রাজ্যে চলল 42 আসনের ভোটগ্রহণ ৷ বাংলায় 30টি আসন দখলের টার্গেট বেঁধে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৷ বারবার এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর ডেপুটি ৷ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্ত চষে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ জনতার দরবারে মার্কশিট পেতে অপেক্ষা 4 জুনের ৷ তার আগে ইটিভি ভারতের সঙ্গে দেখে নেওয়া যাক কোন আসনে কে এগিয়ে ? আর কোথায় লড়াই একেবারে হাড্ডাহাড্ডি ?
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত কোচবিহার বারবারই খবরের শিরোনামে ৷ শীতলকুচির ঘটনা দেশীয় মানচিত্রে ঐতিহাসিক স্থান মাহাত্ম্য আরও বাড়িয়েছে ৷ উত্তরবঙ্গের অন্য়তম হেভিওয়েট কেন্দ্রে লড়াই ছিল দ্বিমুখী ৷ পদ্মপ্রার্থী নিশীথ প্রামাণিকের প্রতিপক্ষ তৃণমূলের জগদীশ বর্মা বাসুনিয়া ৷
2021 সালের নির্বাচনে সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে আড়াই লক্ষ ভোটে জিতেছিলেন জগদীশচন্দ্র বর্মা বাসুনিয়া ৷ অন্যদিকে, কোচবিহার থেকে জেতা নিশীথ প্রামাণিক শুধু সাংসদই নন, অমিত শাহের ডেপুটিও বটে ৷ জগদীশ বাসুনিয়া প্রার্থী হলেও তাঁর পিছনে বকলমে রয়েছেন দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহ ৷
2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে উদয়নকে 57 ভোটে হারানো নিশীথ, সংসদ ছেড়ে বিধানসভায় ফেরেননি ৷ উপনির্বাচনে দেড় লক্ষাধিক ভোটে জেতেন উদয়ন ৷ নিশীথের নিজের বুথে হেরে যান বিজেপি প্রার্থী অশোক মণ্ডল ৷ ফলে কোচবিহার বিজেপির ক্ষেত্রে কার্যত প্রেস্টিজ ফাইট।লড়াই এখানে সেয়ানে সেয়ানে ৷
2. আলিপুরদুয়ার (Alipurduars)
বাম থেকে রাম, ভায়া তৃণমূল ৷ এককালের বামদুর্গে এখন পদ্মের আধিপত্য ৷ সেখানে আবার ঘাসফুল ফোটানোর মরিয়া চেষ্টা করছে তৃণমূল ৷ কালজানি নদী তীরবর্তী শহরে লড়াইয়ে নেমেছিলেন বিজেপির মনোজ টিগ্গা ও তৃণমূলের প্রকাশ চিক বরাইক ৷ মাদারিহাট-বীরপাড়ার বিজেপি বিধায়ক মনোজ বিধানসভায় বিজেপির চিফ হুইপ ৷
2004 ও 2009 সালে আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন মনোজ ৷ অন্যদিকে প্রকাশ 2021 সাল থেকে আলিপুরদুয়ারের জেলা তৃণমূল সভাপতি ৷ আলিপুরদুয়ারের লড়াই মূলত দু’দলের সংগঠনের এবং চা-বাগানের ভোটের ৷
3. জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri)
একপাশে রয়েছে বাংলাদেশ, আরেক পাশে ভুটান সীমান্ত । চা-বাগান, নদী, পাহাড় আর জঙ্গলবেষ্টিত জেলা একসময় ছিল লাল-দুর্গ ৷ 2011 সাল থেকে ক্রমশ তৃণমূলের দখলে আসতে শুরু করে ৷ 2014 সালে জলপাইগুড়ি লোকসভা আসন থেকে জয়ী হয় তৃণমূল ৷ 2019 সালে তা চলে যায় বিজেপির দখলে ৷
এবার বিজেপি, তৃণমূলের পাশাপাশি আলোচনায় রয়েছে সিপিএমও ৷ বিদায়ী সাংসদ ড. জয়ন্তকুমার রায়কেই ফের প্রার্থী করেছে বিজেপি ৷ তৃণমূল টিকিট দিয়েছে নির্মলচন্দ্র রায়কে, বামেদের প্রার্থী দেবরাজ বর্মণ ৷ বিজেপি ‘চালকের আসনে’ থাকলেও, নদীমাতৃক লোকসভা আসনে লড়াই এবার ত্রিমুখী ৷
4. দার্জিলিং (Darjeeling)
পাহাড়, ঘন জঙ্গল ও সমতল, শৈলরানি আদপে তিন সৌন্দর্যের সমাহার ৷ টানা তিনটি লোকসভা ভোটে দার্জিলিঙের কুর্সি গিয়েছে বিজেপির দখলে ৷ যশবন্ত সিং, এসএস আলুওয়ালিয়ার হাত ধরে রাজু বিস্তার হাতে ব্যাটনই শুধু আসেনি, ক্রমশ শক্ত হয়েছে পদ্মের ‘শিকড়’ ৷
এবারও বিদায়ী সাংসদ রাজু বিস্তাতেই ভরসা রেখেছে বিজেপি ৷ অন্যদিকে পাহাড়ের সমীকরণ বদলাতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেসও ৷ রাজ্যের প্রাক্তন আমলা গোপাল লামাকে অনিত থাপার বিজিপিএমের সঙ্গে জোটে প্রার্থী করেছে শাসকদল ৷ বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ডাঃ মুনীশ তামাং ৷ ‘নিশ্চিত’ আসনে বিস্তার কিঞ্চিত ভ্রুকুটি বাড়িয়েছে কার্শিয়াংয়ের বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা ‘নির্দল’ হয়ে ভোটে লড়া ৷ তবে অনেকের মতে বিস্তার দিকেই পাল্লা ভারী ৷
এত বড় রঙ্গ... বিজেপি, তৃণমূল ও কংগ্রেস, রায়গঞ্জের তিন প্রার্থীই ‘দলবদলু’ ৷ বিজেপির টিকিটে বিধানসভায় যাওয়া কৃষ্ণ কল্যাণী এখন তৃণমূলের ‘বাঁশিওয়ালা’, জোড়াফুল থেকে পদ্মে ঝাঁপিয়েছেন কার্তিক চন্দ্র পাল ৷ অন্যদিকে একদা ফরওয়ার্ড ব্লকের দাপুটে নেতা আলি ইমরান রমজ ওরফে ভিক্টর এবার কংগ্রেস প্রার্থী ৷
নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর আসনে এবার ব্যাকফুটে বিজেপি ৷ ধারেভারে এগিয়ে রয়েছেন রায়গঞ্জের ‘বিজেপি’ বিধায়ক ৷ যদিও গোয়ালপোখার-সহ একাধিক অঞ্চলে ভোট কাটতে পারেন ভিক্টর ৷ ফলে একদা প্রিয়রঞ্জনের গড়ে শেষ পর্যন্ত মূল ফ্যাক্টর হতে চলেছে কংগ্রেস ৷ অন্তত তেমনটাই বলছে জেলার রাজনৈতিক মহল ৷
এক সময়ের লাল-গড় বালুরঘাটে এখন উড়ছে গেরুয়া নিশান ৷ এবারও এই আসনে বিজেপি প্রার্থী, অধুনা দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ৷ তৃণমূল প্রার্থী করেছে রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য বিপ্লব মিত্রকে ৷ ফলে বালুরঘাটে কার্যত সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি ৷ দু’দফায় জেলা সফর করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৷
ফলে তৃণমূল এই আসন জিততে কতটা মরিয়া, তা স্পষ্ট ৷ এই আসন জিতলে সেটাই হবে তৃণমূলের ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের ইউএসপি ৷ ফলে আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী জেলায় জমজমাট কুর্সি দখলের লড়াই ৷
বিহার-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা লোকসভা কেন্দ্র ৷ বিধানসভার নিরিখে তৃণমূল 4-3 ‘গোলে’ এগিয়ে থাকলেও গত লোকসভায় কংগ্রেস গড়ে পদ্ম ফুটিয়েছিলেন খগেন মুর্মু ৷ এবারও তিনিই গেরুয়াশিবিরের ভরসা ৷ লড়াইয়ে রয়েছেন প্রাক্তন আইপিএস প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মালদা উত্তরে বিজেপি বেশ কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় ৷
8. মালদা দক্ষিণ (Malda Dakshin)
ডিলিমিটেশনের পর 2009 সালে এই কেন্দ্র তৈরি হয় ৷ সেই সময় থেকে পরপর তিনবার এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী ৷ এবার তাঁর বদলে প্রার্থী হয়েছেন ছেলে ঈশা খান চৌধুরী ৷ চোরাকারবারি এবং দুষ্কৃতীদের ‘গোল্ডেন করিডরে’ এবার ত্রিমুখী লড়াই ৷
বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী এই আসনে খানিক সুবিধাজনক জায়গায় আছেন বলেই মনে করা হচ্ছে ৷ তবে, ঈশা খানও যথেষ্ট কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী ৷
সাড়ে তিন দশকের বামদুর্গে ফাটল ধরিয়ে 2004 ও 2009, টানা দু'বার জঙ্গিপুর থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷ একদা বাম ও কংগ্রেসের ভাগাভাগি করে নেওয়া আসনে ঘাসফুল ফোটে 2019 সালে ৷ তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ হন খলিলুর রহমান ৷ এবারও তাঁকেই প্রার্থী করেছে জোড়াফুল শিবির ৷ উলটোদিকে রয়েছেন বিজেপি নেতা ধনঞ্জয় ঘোষ ৷
ফলে জঙ্গিপুরে এবার লড়াই মূলত টিএমসি বনাম বিজেপি ৷ কংগ্রেসের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুস সাত্তারের নাতি মর্তুজা হোসেন ওরফে বকুল ৷ সংখ্যালঘু ভোটের পাশাপাশি ভোট কাটাকুটির অঙ্কে তিনি ‘ফ্যাক্টর’ হতে পারেন ৷
নবাবের দরবার থেকে কে সংসদের চৌকাঠ ডিঙোবে ? সিপিএমের ভরসা রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম । প্রাক্তন সাংসদ আবু তাহের খানের ‘অভিজ্ঞতা’কে হাতিয়ার করেছে রাজ্যের শাসকদল ৷ মুর্শিদাবাদের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষও জয় পেতে মরিয়া ৷ একমাত্র মুর্শিদাবাদ ছাড়া বাকি ছ’টি বিধানসভাই তৃণমূলের দখলে ৷ ফলে অধীর ‘গড়ে’ অ্যাডভান্টেজ ‘মমতা অ্যান্ড কোং’ ৷
তবে, এই একটি আসন সম্বন্ধে বামেরা আশাবাদী ৷ অধীর-সেলিমের যুগলবন্দিতে ভর করে মুর্শিদাবাদের বৈতরণী পার করতে আশাবাদী সিপিআইএম ৷
কংগ্রেসের 'বেতাজ বাদশা' অধীর রঞ্জন চৌধুরী ৷ বহরমপুরে এতদিন অন্য প্রতীকে দাঁড়ানো কার্যত নিয়মরক্ষা বলেই ভাবা হত ৷ সেই ধারণাটা খানিক বদলেছে 2024 সালে ৷ তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়েছেন ইউসুফ পাঠান ৷ রাজনৈতিক কেরিয়ারে প্রথমবার সংখ্যালঘু প্রার্থীর মুখোমুখি কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা ৷
অপরদিকে বিজেপিও এলাকার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক নির্মলকুমার সাহাকে দাঁড় করিয়ে, অধীরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে ৷ অধীর ম্যাজিক কি তবে একটু ফিকে ? এলাকার বেশিরভাগ মানুষ বলছেন, লড়াইটা কঠিন ঠিকই, তবে অধীর অধীরের জায়গাতেই ৷
‘ক্যাশ ফর কোয়েরি’ কেস ৷ লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে দেশের অন্যতম আলোচিত বিষয় ৷ যদিও তা তৃণমূল স্তরের ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করেছে, তা ভাববার বিষয় ৷ কিন্তু তার ফলে মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজ হওয়াকে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বিজেপি ৷ ফলে তা রাজ্যের অন্যতম জৌলুশপূর্ণ সাংসদের কপালে ভাঁজ বাড়াতেই পারে ৷ অন্যদিকে কৃষ্ণনগরে ক্রমশ প্রকট হয়েছে তৃণমূলের অর্ন্তদন্দ্ব ৷
ফলে একদা বাম গড়ে এসএম সাদি কতটা ভোট কাটেন, তার উপর জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভর করছে ৷ সেই অঙ্কের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বধূ, পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার অমৃতা রায়ও ৷
2019 সালে রানাঘাটে পদ্ম-ফোটান বিজেপির জগন্নাথ সরকার ৷ নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের কয়েকদিন আগে ফুল বদলেছিলেন রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক ৷ তৃণমূলে গিয়েই লোকসভার টিকিট পেয়েছেন ডাক্তারবাবু এবং জগন্নাথ সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুটমণি অধিকারী ৷ 2019 সালে প্রায় 2 লক্ষ 34 হাজার ভোটে জেতা জগন্নাথ সরকার রাজনীতিতে পোড়খাওয়া ৷
যদিও গত লোকসভায় রানাঘাট আসনে প্রথমে মুকুটমণির নামই ঘোষণা করেছিল বিজেপি ৷ সেসময় বাদকুল্লা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুকুটমণি ইস্তফা দিলেও তাঁর নমিনেশন বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন ৷ বদলে প্রার্থী হন জগন্নাথ ৷ ফলে রানাঘাটে লড়াই এবার অনেকটা দ্বিমুখী ৷ মুকুটমণি মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও যথেষ্ট প্রভাবশালী ৷ ফলে রানাঘাটেও লড়াই সেয়ানে সেয়ানে ৷
14. বর্ধমান পূর্ব (Bardhaman Purba)
বর্ধমান পূর্বের কুর্সি তৃতীয়বারের জন্য ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের ৷ জেলায় এবার দ্বিমুখী লড়াই হলেও বাম ভোট বড় ফ্যাক্টর । রাজ্যের শস্য ভাণ্ডার বলা হয় এই জেলাকে । সুনীল মণ্ডলের জেতা আসনে এবার ড. শর্মিলা সরকারকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । বিজেপি প্রার্থী করেছে কবিয়াল বিধায়ক অসীম সরকারকে । সিপিএমের প্রার্থী নীরব খাঁ ।
2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস সব আসনেই জিতে যায় । কিন্তু কোনও কোনও বিধানসভায় 2019 লোকসভার নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কমে যায় । রাজনৈতিক মহল বলছে, মূল লড়াই হতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির । তবে সিপিএমের ভোট বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে ।
15. বর্ধমান–দুর্গাপুর (Bardhaman–Durgapur)
বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ একদা লাল দুর্গে এখন পদ্মফুলের রমরমা ৷ সেখানেই এবার দিলীপকে এগিয়ে দিয়েছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ৷ তৃণমূল এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদকে ৷ 1983 সালের বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডারের ব্যাটে বিজেপি মাঠের বাইরে যায় কি না, সেটাই এখন দেখার ৷ অভিজ্ঞ নেতা সুকৃতি ঘোষালকে প্রার্থী করেছে সিপিআইএম ৷
এখানে প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কৃষক ও শ্রমিক - দুই শ্রেণির ভোটার ৷ বামেদের শ্রমিক সংগঠনের সৌজন্যে সেই ভোট সুকৃতির ঝুলিতে গেলে তিনিই হয়ে উঠবেন জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর ৷
নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছে আসানসোল লোকসভা নির্বাচন । গত কয়েক দশকে আসানসোলে এমন শান্ত নির্বাচন দেখেছেন কি না, কেউ মনে করতে পারছেন না । এককালে ছিল বামদুর্গ ৷ সেই দুর্গের পতন হয় বিজেপির হাত ধরে ৷ 2019 সালেও বিজেপি এই আসন ধরে রেখেছিল ৷ কিন্তু 2022 সালে উপ-নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে হারতে হয় বিজেপিকে ৷ অতীতেও এই কেন্দ্রটি বারবার ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্র্যময় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কারণে । তারকা প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের পরপর দু’বার জয় । তাঁর দলত্যাগ । মুনমুন সেনের মতো তারকা প্রার্থীর পরাজয় এবং শেষমেষ মুম্বইয়ের সুপারস্টার শত্রুঘ্ন সিনহার আগমন এবং বিজেপির হাতছাড়া আসানসোল ৷
এবারও আসানসোলে বিরোধীদের ‘খামোশ’ করতে শত্রুঘ্ন সিনহাতেই ভরসা রেখেছে শাসকদল ৷ অন্যদিকে বিজেপি প্রথমে পবন সিংয়ের নাম ঘোষণা করলেও তিনি নাম তুলে নেন ৷ দীর্ঘ টালবাহানার পর দলের দু’বারের সাংসদ এসএস আলুওয়ালিয়াকে টিকিট দিয়েছে পদ্মশিবির ৷ যদিও দলীয় টানাপোড়েনে কার্যত ব্যাকফুটে বর্ষীয়াণ নেতা ৷ ফলে অনেকেই বলছেন, এখানে অ্যাডভান্টেজ শত্রুঘ্ন ৷
17. বোলপুর (Bolpur)
অনুব্রতহীন রাঙামাটির দেশে এখন মন ভোলাচ্ছে নানা রঙের রাজনীতি ৷ ! দীর্ঘ 43 বছর এই কেন্দ্রে বাম শাসন ছিল ৷ তারপর আসে তৃণমূল ৷ দ্বিতীয়বার এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন অসিত কুমার মাল ৷ অন্যদিকে, বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহা 2015 সালে সাঁইথিয়া পৌরসভায় জয়ী হয়ে কাউন্সিলর হয়েছিলেন ৷ এবার তিনিই বোলপুর লোকসভার প্রার্থী ৷
আবার দলের দীর্ঘদিনের সঙ্গী নানুরের বাসিন্দা শ্যামলী প্রধানকে প্রার্থী করেছে সিপিআইএম ৷ 2016 সালে তৃণমূলের ভরাবাজারে নানুর বিধানসভা থেকে তৃণমূলকে পরাজিত করে বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি ৷ ফলে বোলপুর লোকসভায় এবার কার্যত ত্রিমুখী লড়াই ৷ তবে এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, তৃণমূল হয়তো এবারেও শেষ বাজি মারবে ৷
18. বীরভূম (Birbhum)
একদা বামদুর্গ হিসাবে পরিচিত ছিল বীরভূম লোকসভা কেন্দ্র । 2009 সালে অনুব্রত মণ্ডলের নেতৃত্বে বাম-গড় দখল করেন অভিনেত্রী শতাব্দী রায় । তারপর 2014 ও 2019 সালেও এই কেন্দ্রে ঘাসফুলই ফোটে ৷ এবারও তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী তিনবারের জয়ী সাংসদ শতাব্দী রায় ।
অন্যদিকে দেবাশিস ধরের প্রার্থীপদ বাতিল হওয়ার আঁচ আগেই পেয়েছিল বিজেপি ৷ ফলে ‘স্টপগ্যাপ’ হিসেবে হিন্দু সংহতি মঞ্চের দেবতনু ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করে তারা। অন্যদিকে, বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিলটন রসিদ । শতাব্দীর ক্যারিশমায় খানিক পিছিয়ে থাকলেও লড়াইয়ের ময়দানে জমি ছাড়েনি বিরোধীরা ৷
19. বনগাঁ (Bongaon)
বনগাঁ বরাবরই অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । একদা সেখানে লালের আধিক্য থাকলেও আজ সে সব অতীত । বনগাঁয় এবার বিজেপি বনাম প্রাক্তন বিজেপি ৷ ডিলিমিটেশনের পর বনগাঁ আসন থেকে প্রথম অ-তৃণমূল সাংসদ হন শান্তনু ঠাকুর ৷ অন্যদিকে 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাগদা থেকে জয়ী হওয়া বিজেপির বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল ৷ নাগরিকত্ব চালেই মতুয়াদের মন জিতে ফের বনগাঁর কুর্সিতে বসতে চান শান্তনু ঠাকুর, ওপরদিকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই আস্থা রাখছেন বিশ্বজিৎ ৷
পার্থ ভৌমিক, বরাবরের তৃণমূল । প্রতিপক্ষ অর্জুন সিং আবার গতকালের তৃণমূল, আজকের বিজেপি । ভোটযুদ্ধের আবহে পার্থ-অর্জুনের এই নির্বাচনী লড়াই মনে করিয়ে দেয় 'মহাভারতের' যুদ্ধের কথা । একদা সিপিএমের ‘গড়’ বলে পরিচিত ব্যারাকপুরে জোড়াফুল ফুটিয়েছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী ৷ প্রবীণ রাজনীতিবিদের পরপর দু’বার সাংসদ হওয়ার পিছনে মালির ভূমিকা পালন করেছেন অর্জুনই ৷ বর্তমানের দু’জনেই বিজেপি’র ছত্রছায়ায় ৷ অর্জুন সাংসদ হয়ে ‘ক্যামাক স্ট্রিটে’ ফিরলেও ফের প্রত্যাবর্তন হয়েছে গেরুয়া শিবিরে, প্রার্থীও হয়েছেন ৷
ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র । ব্যারাকপুর, আমডাঙা, জগদ্দল, নৈহাটি, বীজপুর, ভাটপাড়া এবং নোয়াপাড়া । তারমধ্যে ভাটপাড়ায় অর্জুন-পুত্র পবন ছাড়া 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাকি আসন গিয়েছিল তৃণমূলের ঝুলিতে ৷ জগদ্দলের সোমনাথ শ্যাম, নোয়াপাড়ার মঞ্জু বসু, আমডাঙার রফিকুর রহমান কিংবা ব্যারাকপুরের রাজ চক্রবর্তী ৷ প্রত্যেকেই প্রকাশ্যে অর্জুন-বিরোধী ৷ ফলে ‘নিজের ঘরে’ ফের পদ্ম ফোটাতে অর্জুনের সামনে বিস্তর হার্ডলস ৷
21. হাওড়া (Howrah)
লোকসভা নির্বাচনে জোর লড়াই হাওড়ায় ৷ মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ আর তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে এবারে বিজেপির রথীন চক্রবর্তী ৷ এক সময় যিনি ছিলেন হাওড়ার মেয়র ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ৷ এই কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রচারে এগিয়ে থাকার দাবি বামেরা করলেও, ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও অনেকটাই পিছিয়ে তারা ৷
2021 বিধানসভা নির্বাচনে সব ক'টি আসনেই তৃণমূল নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখতে পেরেছিল ৷ যদিও ক্রমশ বদলেছে সেই ছবিটা ৷ ফলে ‘প্রাচ্যের শেফিল্ড’ চিন্তা বাড়াচ্ছে রাজ্যের শাসকদলের ৷
একদিকে দু’বারের তৃণমূল সাংসদ সাজদা আহমেদ ৷ তাঁর স্বামী সুলতান আহমেদ ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আর তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ভূমিপূত্র বিজেপি প্রার্থী অরুণ উদয় পাল চৌধুরী ৷ 2017 সালে সুলতানের মৃত্যুর পর, 2018 উপনির্বাচনে সাজদা আহমেদকে উলুবেড়িয়া কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিলেন মমতা ৷ স্বামীর ছেড়ে যাওয়া আসনে জিতে লোকসভায় যান সাজদা ৷ 2019 সালে তাঁকে ফের প্রার্থী করেন মমতা ৷ সেবারেও নিরাশ করেননি তিনি ৷ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে 2 লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছিলেন তিনি ৷
যদিও এবার কোনও প্রার্থী বহিরাগত নন ৷ সরাসরি উলুবেড়িয়ার মাটিতে রাজনীতি করে বেড়ে উঠেছেন অরুণ উদয় ৷ সাঁকরাইল ও আমতায় অরুণ উদয়ের হয়ে মোদি-শাহ সভাও করেছেন ৷ তৃণমূলের 30 শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট হাতিয়ার হলে, অরুণ উদয়ের নজরে বাকি 70 শতাংশ হিন্দু ভোট ৷ যার মধ্যে 50 শতাংশ ভোট নিজের দিকে আনতে পারলে, তৃণমূলকে ধরাশায়ী করতে পারেন তিনি ৷
তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র ৷ আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় গত তিনবারের সাংসদ এই কেন্দ্রে ৷ এবারেও শ্রীরামপুর লোকসভায় প্রার্থী হিসেবে বেশ শক্তিশালী কল্যাণ ৷ আর তাঁর বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন কবীর শঙ্কর বোস ৷ যিনি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন জামাইও বটে ৷
কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআইএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর শ্রীরামপুরের ঘরের মেয়ের তকমা নিয়ে প্রচারে নেমেছিলেন ৷ যদিও রাজনৈতিক মহলের অভিমত, শ্রীরামপুরে দীপ্সিতা তৃণমূলের ভোট কাটতে পারলে কবীর শঙ্করের ভাগ্যেও শিঁকে ছিড়তে পারে ৷
24. হুগলি (Hooghly)
2019 সালে এই কেন্দ্র থেকেই জিতেছিলেন বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্য়ায় ৷ এবারও ওই আসনে তাঁকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি ৷ অন্যদিকে, কয়েকদিন আগে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রিয়েলিটি শো’তে গিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ তারপরেই অভিনয় জগতে একদা সতীর্থকে চ্যালেঞ্জ করেই রাজনৈতিক ইনিংস শুরু করেছেন রচনা ৷
2019 সালে 70 হাজারেরও বেশি ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের রত্না দে নাগ’কে হারিয়ে প্রথমবার সাংসদ হন লকেট ৷ তিনি হুগলির উন্নয়নে 17 কোটি খরচের দাবি করলেও, দেখা মেলে না বলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্থানীয়রা ৷ যদিও রাজনৈতিক মহল বলছে, লকেট হারলে তা যথেষ্ট আশ্চর্যের ৷
বাম দুর্গ হিসেবে পরিচিত আরামবাগ লোকসভা 2014 সালের পর থেকে তৃণমূলের দখলে ৷ তবে গত বিধানসভায় এই এলাকায় ভালো ফল করেছে বিজেপি ৷ ত্রিমুখী লড়াইয়ে এবার জেতার ব্যাপারে 100 শতাংশ আত্মবিশ্বাসী তিন দলই ৷ এ বার লোকসভা নির্বাচনে তিনটিই একেবারে নতুন মুখ । এখানে তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন মিতালি বাগ । বিজেপির প্রার্থী অরূপকান্তি দিগার । আর সিপিআইএম-এর সৈনিক বিপ্লব মৈত্র ।
বিনা যুদ্ধে কেউ কারওকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ ৷ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দার মাত্র 1142টি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন । এবার তাঁকে টিকিট দেয়নি দল ৷ ফলে ব্যালটে কে বাজিমাত করবেন, তা নিয়ে দোলাচলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও ৷
26. তমলুক (Tamluk)
বিজেপির টিকিটে লড়ছেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ৷ তাঁর বিরুদ্ধে দুই তরুণ, তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য ও সিপিআই(এমে)র সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ লড়াইটা আবার 'অধিকারী পরিবার' বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ৷ ফলে লড়াইটা উন্নয়ন বা মানুষের সমস্যার থেকেও বেশি 'অস্তিত্বরক্ষার' ৷
গত বিধানসভা ভোটে তমলুক কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ময়না, হলদিয়া এবং নন্দীগ্রামের দখল নেয় বিজেপি ৷ বাকি চারটি - তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, নন্দকুমার, মহিষাদলে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থীরা ৷ সব বিধানসভাগুলির মোট ভোট মিলিয়ে তৃণমূল মাত্র 21টি ভোটে বিজেপির থেকে এগিয়ে ছিল ৷ ফলে তাম্রলিপ্তে খানিকটা হলেও ‘অ্যাডভান্টেজ’ অভিজিৎ ৷
27. কাঁথি (Kanthi)
পূর্ব মেদিনীপুরকে বাংলার রাজনীতিতে 'অধিকারী গড়' বলা হয় ৷ তা গত বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে নন্দীগ্রাম থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে প্রমাণ করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ৷ সেই পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনে আরও একবার 'অস্তিত্বরক্ষার' লড়াই ৷ যেখানে বিজেপির প্রার্থী বিরোধী দলনেতার ছোট ভাই সৌমেন্দু অধিকারী ৷ বিদায়ী সাংসদ তথা বাবা শিশির অধিকারীর জায়গায় লড়াই করছেন তিনি ৷
2019 লোকসভায় এই কাঁথি ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের ৷ তাই রাজ্যের শাসকদলের লক্ষ্য জেতা আসনে 'অস্তিত্বরক্ষা' করা ৷ যে লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভরসা রেখেছেন পটাশপুরের বিধায়ক উত্তম বারিকের উপর ৷
28. ঘাটাল (Ghatal)
ঘাটালে হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের (হিরণ) নাম ঘোষণা করেছিল বিজেপি ৷ অন্যদিকে তৃণমূলের টিকিটে যে ফের দেবই দাঁড়াচ্ছেন, তা স্পষ্টই ছিল ৷ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর লড়াইয়ে মুখোমুখি পর্দার দুই প্রাক্তন সতীর্থ ৷ হিরণের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে অনেকই সমালোচনায় মাতেন, ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ককে ‘হিরো হিরণ’ বলেও সম্বোধন করেন অনেকে ৷ নায়কের ফিল্মোগ্রাফি দাগ না-কাটলেও রাজনৈতিক কেরিয়ার যথেষ্ট উজ্জ্বল ৷ ফুল বদলে বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হয়েছেন ৷
অন্যদিকে, দেব ঘাটালের দু’বারের সাংসদ ৷ ফিল্মোগ্রাফি, রাজনৈতিক কেরিয়ার দু'য়েই হিরণের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ঘাটালে কঠিন লড়াই হয়েছে, এমনটাই অভিমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ৷
একটা সময়ে লাল দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রাম । 2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন । তবে 2011 সালের বিধানসভা ভোটে সেখানে ফোটে ঘাসফুল ৷ এরপর 2014 সালের লোকসভা নির্বাচনে ইতিহাস গড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী উমা সরেন সিপিআইএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটের ব্যবধানে হারান ৷
তবে 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় মোদি-ঝড় । মাত্র 11 হাজার ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী বীরবাহা সরেন টুডুকে পরাজিত করেন বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম । ঝাড়গ্রাম লোকসভায় মূলত লড়াই তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিআইএম-এর মধ্যে ৷ তবে এবারের নির্বাচনে এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর কুড়মি ভোট ।
এককালের লাল-গড় মেদিনীপুরের কুর্সি দখলে এবার মূল লড়াই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ৷ সম্মুখসমরে রাজ্যের শাসক দল ও প্রধান বিরোধী দলের দুই মহিলা বিধায়ক ৷ গতবারের জয়ী দিলীপ ঘোষ প্রার্থী হয়েছেন বর্ধমান-দুর্গাপুরে ৷ তাঁর বদলে এখানে বিজেপি প্রার্থী করেছে বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলকে ৷ অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস এবার প্রার্থী করেছে জুন মালিয়াকে ৷
মেদিনীপুর লোকসভার অধীনে যে সাতটি বিধানসভা রয়েছে, সেগুলি হল - মেদিনীপুর, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত খড়গপুর গ্রামীণ, অবাঙালি অধ্যুষিত খড়গপুর সদর, কেশিয়াড়ি, দাঁতন, নারায়ণগড় ও পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা । 2021 সালে এই সাত বিধানসভার মধ্যে শুধুমাত্র খড়গপুর সদরেই জিততে পেরেছে বিজেপি ৷
ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্ত জমিতে 2014 সালে ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন মৃগাঙ্ক মাহাতো ৷ 2019 সালে তৃণমূলের সেই মৃগাঙ্ক মাহাতোকে হারিয়েই পুরুলিয়ার সাংসদ হন বিজেপির জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো ৷ এবারও দল তাঁকেই টিকিট দিয়েছে । 2024 সালে তিনি কি জয় ধরে রাখতে পারবেন ?
পুরুলিয়া জেলায় এবার লড়াইটা চতুর্মুখী । বিজেপির জ্যোতির্ময় ছাড়াও জোড়াফুলের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন শান্তিরাম মাহাতো । বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী হয়েছেন পোড় খাওয়া কংগ্রেস নেতা নেপাল মাহাতো । তার সঙ্গে আবার আদিবাসী কুড়মি সমাজের প্রার্থী হয়েছেন অজিত প্রসাদ মাহাতো । এছাড়াও ফরওয়ার্ড ব্লকও আলাদাভাবে প্রার্থী দিয়েছে পুরুলিয়ায় ৷ গেরুয়া শিবিরের রক্তচাপ বাড়ানোর পক্ষে যা যথেষ্ট ৷
32. বাঁকুড়া (Bankura)
বাঁকুড়ায় ঘাসফুলের হয়ে লড়ছেন তালড্যাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী ৷ অন্যদিকে বিদায়ী সাংসদ সুভাষ সরকার এখন দেশের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীও ৷ যদিও সংসদীয় এলাকায় যথেষ্ঠ ‘সুনাম’ রয়েছে তাঁর ৷ দলের কর্মীরাই ঘরে তালাবন্ধ করেও রেখেছিল ৷ ফলে বাঁকুড়ায় বিজেপির ফেরার রাস্তা কণ্টকাদীর্ন ৷ এহেন পরিস্থিতিতে, পাল্লা যে কিছুটা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে, সেটা বলাই বাহূল্য ৷
33. বিষ্ণুপুর (Bishnupur)
‘গৃহদাহ’ আগেই ঘটে গিয়েছে, ঘর ভেঙে পথ আলাদা হয়েছে সৌমিত্র খাঁ ও সুজাতা মণ্ডলের ৷ একদা স্বামীর হয়ে প্রচারে নামা সেই সৌমিত্রর প্রাক্তন ঘরণীকেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল ৷ বিচ্ছেদের পর থেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে তরবারি শানিয়েছেন দু’জনে ৷ ফলে বিষ্ণুপুরে শুধু ফাইটই নয়, আকর্ষণীয় হয়েছে ভোটপ্রচারও ৷
34. দমদম (Dum Dum)
সময়ে সময়ে এখানকার ভোটাররা তাঁদের সাংসদ বদল করেছেন ৷ বাম, কংগ্রেস, বিজেপি ঘুরে 2009 সাল থেকে দমদম তৃণমূলের দখলে ৷ এবার ত্রিমুখী লড়াই ৷ তৃণমূলের সৌগত রায়ের সঙ্গে লড়াইয়ে রয়েছেন কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআইএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী ও বিজেপির শীলভদ্র দত্ত ৷
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুজন চক্রবর্তী তৃণমূলের ভোট কাটলে সৌগতর চতুর্থবার সাংসদ হওয়ার রাস্তা বন্ধুর হয়ে উঠতে পারে ৷
35. বারাসত (Barasat)
2009 সাল থেকে এই কেন্দ্র তৃণমূলের দখলে রয়েছে ৷ তিনবারের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবার চতুর্থবার জয়ের লড়াইয়ে নেমেছেন ৷ তাঁকে টক্কর দিতে ময়দানে রয়েছেন বাম প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার ৷ একাধিক বিতর্কে জড়িত স্বপন মজুমদার যত ভোট এগিয়েছে, তত ব্যাকফুটে গিয়েছেন ৷ ফলে সমস্তকিছু ঠিক থাকলে চতুর্থবার সংসদের নিম্নকক্ষে যাওয়ার রাস্তা খানিকটা প্রশস্ত হয়েই রয়েছে তৃণমূলের অভিজ্ঞ সাংসদের ৷
এই মুহূর্তে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্র ৷ সন্দেশখালি কাণ্ডের জেরে জাতীয় ক্ষেত্রে শিরোনামে উঠে এসেছে বসিরহাট ৷ যার ঘটনাপ্রবাহ এখনও চলছে ৷ যাবতীয় অভিযোগ, দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে ফের এই কেন্দ্রে জিততে হাজি নুরুল ইসলামে ভরসা রেখেছে তৃণমূল ৷ বিজেপি প্রার্থী করেছে সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ রেখা পাত্রকে ৷ সিপিএমও ওই এলাকার মানুষের জন্য লড়তে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া নিরাপদ সরদারকে টিকিট দিয়েছে এবার ৷ নিরাপদ সন্দেশখালির বিধায়কও ছিলেন ৷
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা লোকসভা কেন্দ্রে গতবার জিতেছিলেন নুসরত জাহান রুহি ৷ যদিও অভিনেত্রী-সাংসদের সৌজন্যে একাধিকবার মুখ পুড়ছে শাসকদলের ৷ ফলে 'হটস্পট' বসিরহাট কেন্দ্রে কুর্সি দখলের লড়াইয়ে কে জিতবেন, সেদিকেই এখন নজর রাজ্যবাসীর ৷
37. জয়নগর (Jaynagar)
বিরাট ভোটে গতবার জিতেছিলেন প্রতিমা মণ্ডল ৷ এবারও তাঁর উপরেই ভরসা রেখেছে দল ৷ তুলনায় খানিক ব্যাকফুটে বিজেপি প্রার্থী অশোক কাণ্ডারী ৷
38. মথুরাপুর (Mathurapur)
একসময় মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্র ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি ৷ সেখানেই তৃণমূলের হয়ে জয়ের হ্যাটট্রিক করেছিলেন বিদায়ী সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়া ৷ অসুস্থতার কারণে তাঁকে প্রার্থী করতে পারেনি শাসক দল ৷ বদলে প্রার্থী হয়েছেন বাপি হালদার ৷ প্রবলভাবে লড়াইয়ে আছেন বিজেপি প্রার্থী অশোক পুরকাইতও ৷
এলাকায় উন্নয়ন হয়নি, এমনটা বলার লোক খুব কম রয়েছে । একমাত্র সমস্যা নদী বাঁধ সংক্রান্ত ৷ বিধানসভায় উপকূল তীরবর্তী এলাকায় প্রতি বছর নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গোটা এলাকা ৷ সেই সমস্যা হাতিয়ার করেই পদ্ম ফোঁটাতে মরিয়া গেরুয়া শিবির ৷
39. ডায়মন্ড হারবার (Diamond Harbour)
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ 2014 সালে 47 বছরের বাম গড়ে জোড়াফুল ফুটিয়েছিলেন তৃণমূল সেনাপতি ৷ কংগ্রেস নেতা সৌমেন মিত্রর জেতা আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন অভিষেক ৷ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, 10 বছরে ডায়মন্ড হারবার এবং অভিষেক কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছেন ৷ 2021 বিধানসভায় ভোটেও সাতটি আসনই এসেছে তৃণমূলের ঝুলিতে ৷
সিপিআইএমের তরুণ নেতা প্রতীক উর রহমান কিংবা বিজেপির অভিজিৎ দাস (ববি) শিরোনামে উঠে এলেও তাঁরা যে অভিষেককে হারিয়ে দেবেন, তা তাঁদের সমর্থকরাও জোর দিয়ে বলতে পারছেন না ৷ একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদি কিংবা অমিত শাহের এই কেন্দ্রকে ‘উপেক্ষা’ অভিষেকের পথ আরও মসৃণ করেছে ৷
1984 সালের লোকসভা ভোটে হেরে গিয়েছিলেন হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ৷ সংসদীয় রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৷ পরেরবারই আরেক ‘আনকোরা’ প্রার্থী মালিনী ভট্টাচার্য হারিয়ে দেন মমতাকে ৷ কৃষ্ণা বসুর পর থেকে আর যাদবপুর থেকে লোকসভায় কেউ টানা দু’বার যেতে পারেননি ৷ কবীর সুমন, সুগত বসু, মিমি চক্রবর্তী হয়ে সায়নী ঘোষ ৷ প্রত্যেকবার প্রার্থী বদলেছেন মমতা ৷
চমকের রাজনীতিতে বিশ্বাসী যাদবপুরে বারবার প্রার্থী বদলানো তৃণমূলের প্রতীক 15 বছর অক্ষত ৷ ফলে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী সায়নী ৷ যদিও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুবনেত্রী জিতলেও পথটা সুগম হবে না ৷ 2019 সালে তৃণমূল পেয়েছিল মোট ভোটের প্রায় 48 শতাংশ। যার এক তৃতীয়াংশ ভাঙড় থেকে এসেছিল । এবার সেই ভাঙড় বিধানসভাই তৃণমূলের সবচেয়ে মাথাব্যথার কারণ ৷ আইএসএফ প্রার্থী ভাঙড়ে তৃণমূলের ভোট কতটা নিজের ঝুলিতে আনেন, তার উপরই নির্ভর করবে ভোটের ভাগ্য ৷ ফলে ভোট কাটাকুটিতে বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় বা সিপিআইএমের সৃজন ভট্টাচার্য জিতে গেলেও আশ্চর্যের হবেন না ৷
41. কলকাতা দক্ষিণ (Kolkata Dakshin)
তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তঘাঁটি বলেই বরাবর পরিচিত কলকাতা দক্ষিণ ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গড়’ এখন মালা রায়ের দাপটে ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর সুব্রত বকসি, হালফিলে মালা রায় । নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতার মানুষের সমর্থন বারবার জিতে নিয়েছে ঘাসফুল শিবির । গত 26 বছর ধরে তৃণমূলের জিতে আসা আসনে এবারও মালা রায়েই ভরসা রেখেছে শাসকদল ৷
অন্যদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত আসনে দেবশ্রী চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে বিজেপি ৷ লড়াইয়ে রয়েছেন শায়রা শাহ হালিমও ৷
42. কলকাতা উত্তর (Kolkata Uttar)
রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসনে এবার কার্যত 'প্রেস্টিজ ফাইট' ! তিনবারের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম তাঁর একদা সতীর্থ তাপস রায় ৷ উত্তর কলকাতায় নেতা বলে পরিচিত তাপসের তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদান এই আসনে ভোটের পাটিগণিতটাই আমূল বদলে দিয়েছে ৷
দুই হেভিওয়েটের লড়াইয়ের প্রচারে কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য খানিক ‘ম্রিয়মাণ’ হলেও তিনিই সম্ভবত এই কেন্দ্রে তুরুপের তাস হতে পারেন ৷ কারণ শেষ পর্যন্ত ভোট কাটাকুটির অঙ্কে তিনিই হয়তো নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে চলেছেন ৷
- তথ্যসূত্র: জাতীয় নির্বাচন কমিশন