কলকাতা, 29 নভেম্বর: চারদিকে নোংরা-আবর্জনা, জঙ্গল ৷ রেলের জমির একধার বরাবর বাঁশ ও প্লাস্টিক দিয়ে একের পর এক ঝুপড়ি ঘর ৷ সেখানেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই বসবাস দেড়শো পরিবারের ৷ পুরনো টালা ব্রিজের নিচে রেললাইন লাগোয়া এলাকা থেকে দেড়শো পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল 2019 সালে দেবীপক্ষের সূচনায় ৷ মাঝের পাঁচ বছরে পুরনো টালা ব্রিজ ভেঙে নতুন সেতু তৈরি হয়েছে ৷ এমনকি, দু’বছর আগে তার উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ কিন্তু, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, মাথার উপর পাকা ছাদ এখনও পাননি সেই পরিবারগুলি ৷
একদিকে যেমন রেলের জমিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে কিছু পরিবার ৷ অন্যদিকে, খালপাড়ে রীতিমতো ভাগাড়ের উপর বসবাস করছে আরও বেশ কিছু পরিবার ৷ মাঝে করোনা-সহ আমফানের মতো ঘূর্ণিঝড় দেখেছে রাজ্যের মানুষ ৷ কিন্তু, আজও মাথার উপরে ছাদ নেই সেই মানুষগুলির ৷
মাঝেরহাট ব্রিজ ভাঙার পরপর, রাজ্যের একাধিক পুরনো ব্রিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রশাসন ৷ সেখানেই টালা ব্রিজের জীর্ণ দশা ধরা পড়ে ৷ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় জরাজীর্ণ টালা ব্রিজ ভেঙে, নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে ৷ সেই মতো শুরু হয় প্রশাসনিক তৎপরতা ৷ 2019 সালে মহালয়া ঘরছাড়া হতে হয় সেখানকার কমবেশি দেড়শো পরিবারকে ৷ মাথার উপর যে ছাদ তারা তৈরি করেছিল, সেই ছাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় প্রশাসন ৷
তার পরিবর্তে অস্থায়ী শিবির করে, বিভিন্ন জায়গায় ভাগ করে পরিবারগুলিকে থাকার ব্যবস্থা করে কলকাতা পুরনিগমের বস্তি উন্নয়ন বিভাগ ৷ অভিযোগ, পরিবারগুলি বাঁশের কাঠামোয় প্লাস্টিক বাঁধা ঘরে ওঠার পর, আর ফিরে তাকায়নি কেউ ৷ ঝড়-জলে কখনও প্লাস্টিক ছিঁড়ে জলে ঘর ভেসে যায় ৷ আবার কখনও ঝড়ে প্লাস্টিক উড়ে চলে যায় ঝড়ে ৷ জল জমে থৈ-থৈ অবস্থা ৷ গরমকালে বাচ্চাদের নিয়ে সেই ঘরে থাকতে পারেন না তাঁরা ৷
অভিযোগ, 30 থেকে 37টি পরিবার যারা খালপাড়ের ওই অস্থায়ী শিবিরে আছেন, তাঁদের জন্য মাত্র দু’টি শৌচালয় ও স্নানাগার রয়েছে ৷ মহিলাদের ফুটপাথ ধরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হয় ৷ আর, সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়ের হানা তো লেগেই আছে ৷ অভিযোগ, একাধিকবার 1 নম্বর বরো চেয়ারম্যান তরুণ সাহাকে বলেও কোনও লাভ হয়নি বলেই দাবি করছেন উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দারা ৷
তাঁদের কথায়, "আমাদের বলেছিল পুনর্বাসন দেবে ৷ তারপর বলেছে টিনের বাড়ি করে দেবে ৷ পাঁচটা বছর কেটে গেলেও, দিচ্ছি-দেব করে চলে যাচ্ছে ৷ আর শেষমেষ এখন বলছে সবটাই জানে রাজ্য প্রশাসন ৷ তাঁদের হাতে কিছুই নেই ৷ একজন আরেকজনের ঘাড়ে দায় ঠেলছে ৷ আমাদের মাথার উপর পাকা ছাদ ভাঙলেও, তা ফিরিয়ে দেবার কোনও বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই ৷ অথচ ভোট এলে এরাই হাতজোড় করে এই ছেঁড়া প্লাস্টিকের ঘরের দরজায় এসে ভোট ভিক্ষে করছে ৷ এই যন্ত্রণা থেকে অবিলম্বে মুক্তি পেতে চাই আমরা ৷ আমাদের আধার কার্ড আছে, ভোটার কার্ড আছে, আমাদের বৈধ সমস্ত কাগজপত্র আছে। সরকার কাজের সুবিধায় আমাদের উচ্ছেদ করেছিল ৷ আমাদের অবিলম্বে মাথার উপর ছাদ ফিরিয়ে দেওয়া হোক ৷"
স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলির মধ্যে, কলকাতা স্টেশন লাগোয়া এলাকায় 36টি পরিবার, 91এ বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকায় 26টি পরিবার, খাল ধার লাগোয়া এলাকায় 37টি পরিবার, রেলের জমিতে 24টি পরিবার, গৌরীবাড়ি এলাকায় 12টি পরিবার ও সেতু লাগোয়া 15টি পরিবার এই ভোগান্তি, দুর্দশা নিয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে ৷
কলকাতা পুরনিগম সূত্রে খবর, এই সমস্যা সমাধানের জন্য বেলগাছিয়া এলাকায় একটি ফাঁকা জমি চিহ্নিত করা হয়েছিল প্রাথমিক স্তরে ৷ সেখানেই বাংলার বাড়ি প্রকল্পে ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ৷ তবে, আশপাশের বহুতলগুলির অভিযোগ ও আইনি জটিলতার জেরে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় ৷ এরপর আর নতুন করে কোনও চিন্তা ভাবনা করা হয়নি এই পরিবারগুলির জন্য ৷
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বস্তি উন্নয়ন সমিতির রাজ্য সম্পাদক সুখরঞ্জন দে বলেন, "মেয়র ফিরহাদ হাকিম থেকে শুরু করে, ব়রো চেয়ারম্যান, সবাই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বললেও বাস্তবে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলিকে খোলা আকাশের নিচে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে ৷ অবিলম্বে তাদের মাথার উপর পাকা ছাদের ব্যবস্থা করুক সরকার ৷"