হায়দরাবাদ, 10 এপ্রিল: মাস তিনেক আগের কথা, জানুয়ারির 28 ৷ 12 বছরের 'বনবাস' কাটিয়েছিল শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব ৷ কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাতের জাদুকাঠিতে 'বল্গাহীন' দেখাচ্ছিল ইস্টবেঙ্গলকে ৷ একযুগের অপেক্ষা শেষে ফের ট্রফি ঢুকেছিল ইস্টবেঙ্গলের ক্যাবিনেটে ৷ ওড়িশা এফসিকে হারিয়ে সুপার কাপ জিতে নিয়েছিল পদ্মাপাড়ের ক্লাব ৷ সমর্থকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, বুঁদ হয়েছিলেন সোনালী দিনের স্বপ্নে ৷
কলকাতার এক প্রধান লিগ শিল্ড জয়ের অঙ্ক কষছে, আরেক প্রধান সদ্য আই লিগ জিতে আগামী আইএসএল যাত্রার রোডম্যাপ বানাচ্ছে ৷ ঠিক সেসময়েই হারের অতলে কলকাতার আরেক প্রধান ৷ গত দু’বছর নবম ও এগারোতম স্থানে শেষ করা দলের কাছে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইতিহাসে এ বছর ‘সফলতম’ হলেও, তা কোনওভাবেই ইস্টবেঙ্গলোচিত নয় ৷ প্রতিবার এক দৃশ্য সমর্থকদেরও ব্যথা বাড়াচ্ছে ৷
সুপার কাপ ঘরে তুলতেই স্প্যানিয়ার্ডের প্রসস্তিতে ভরেছিল সোশাল মিডিয়ার দেওয়াল ৷ গত বছরের এপ্রিলে লাল-হলুদের দায়িত্ব নেন কুয়াদ্রাত ৷ বেসুরো ছন্দে বাজতে থাকা টিমে প্রাণ সঞ্চারের দায়িত্ব তাঁর বিশ্বস্ত কাঁধেই সঁপেছিল লাল-হলুদ ম্যানেজমেন্ট ৷ ভরসার দাম রেখেছিলেন কার্লেস ৷ দায়িত্ব নেওয়ার পরেই চটকদারি মন্তব্য করেননি, ডার্বিতে বিধ্বস্ত হয়েও দমে যাননি ৷ মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছিলেন ৷ অল্প আঁচে রান্না করার মতোই ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন দলকে ৷ তাঁর টোটকাতেই ইস্টবেঙ্গল শিবিরের আনাচে-কানাচে ধ্বনিত হচ্ছিল, 'খেলে দেখুন, বদলে গেছে' ৷ দু’মাসেই ফের উলটপুরাণ ৷
গত কয়েক বছরে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গী শুধুই ব্যর্থতা ৷ সঙ্গে দোসর স্পনসরের সঙ্গে সংঘাত এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের লাগাতার সাফল্য ৷ ফলে ক্রমাগত কোনঠাসা হচ্ছিল লাল-হলুদ শিবির ৷ সুপার কাপ জয়ে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের সেই গুমোট ভাবটা খানিক কেটেছিল ৷ 73 দিনেই যাবতীয় সাফল্যের ঝংকার উধাও ৷ দেওয়াল লিখন স্পষ্ট বলছে, ‘‘লাল-হলুদ রয়েছে লাল-হলুদেই’’ ৷
স্প্যানিশ হেডস্যরের জাদুকাঠিতেই যে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব তরতরিয়ে এগোচ্ছিল, তাঁরাই হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল কীভাবে ? সুপার কাপ জয়ের আত্মতুষ্টি ? বিদেশী বাছাইয়ে ম্যানেজমেন্ট ও কুয়াদ্রাতের ব্যর্থতা ? রেফারিংয়ের মতো মাঠের বাইরের সমস্যাকে নিজেরাই প্রকট করে তোলা ? যাত্রা শেষে নিঃসন্দেহে ব্যর্থতার ময়নাতদন্তে বসবে দল ৷
কোথায় পা ফসকাল শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব ?
- ছন্নছাড়া রক্ষণ...
আলোচনা শুরু করতে গেলে, আজকের ম্যাচে চেয়ে ভালো ভূমিকা হতে পারে না ৷ আইএসএলের প্লে-অফে পৌঁছলে পঞ্জাবকে হারালেই শুধু হত না, তাকিয়ে থাকতে হত চেন্নাইয়িন-গোয়া ম্যাচের দিকেও ৷ প্রাথমিক কাজটাই করতে পারল না ইস্টবেঙ্গল ৷ জয়ের হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে নেমে মুখ থুবড়ে পড়ল দল । ম্যাচের 18 মিনিটে গোল খাওয়া ইস্টবেঙ্গল যদিও প্রবলভাবে ম্যাচে ফিরেছিল ৷ একক দক্ষতায় বিশ্বমানের গোল করে গিয়েছিলেন সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ দলের তরুণ তুর্কি নাছোড়বান্দা মনোভাব নিয়ে খেললেও তা প্রতিফলিত হল না ক্লেইটন সিলভা, ভিক্টর ভাসকুয়েজের মতো খ্যাতনামা তারকাদের মধ্যে ৷
প্রথমার্ধের শেষে গোল করে পঞ্জাবকে এগিয়ে দিয়েছিলেন মাদিহ তালাল ৷ মুহূর্তের ভুলে নিজেদের গোলমুখ খুলে দিয়েছিলেন হিজাজি মাহের, হরমোনজোৎ খাবড়ারা ৷ এই অবস্থায় ড্রেসিংরুমে গিয়ে সাধারণত চার্জড-আপ হয়ে ফেরে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো দল ৷ এক্ষেত্রে হল উলটোটা ৷ কার্যত ঝিমিয়ে পড়া ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ একের পর এক ভুল করেই গেল ৷ শেষের দিকে হরমনজোৎ সিং খাবরা গোললাইন সেভ না-করলে পাঁচ গোল হজম করতে হত ।
প্রভসুখমন-শৌভিকের অনুপস্থিতিও ভোগাল লাল-হলুদকে ৷ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কার্ড সমস্যায় ছিলেন না গোলরক্ষক প্রোভসুখন গিল এবং মিডফিল্ডার সৌভিক চক্রবর্তী । গিলের না থাকা বড় ধাক্কা । কারণ পরিবর্ত মাঠে নামা গোলরক্ষক কমলজিৎ সিং পুরো মরসুমে একটিও ম্যাচ খেলেননি । যদিও ম্যাচে 18 মিনিটে দুরন্ত সেভে জাত চিনিয়েছিলেন তিনি ৷ তারপরেও একাধিক সেভ করেছেন ৷ কিন্তু প্রভসুখমন থাকলে আরও জমাট থাকত ইস্টবেঙ্গলের তেকাঠি ৷ অন্যদিকে, শৌভিকের অনুপস্থিতিতে কার্যত ভেঙে পড়েছে লাল-হলুদের রক্ষণ ৷ হিজাজি খানিক চেষ্টা করলেও খাবড়া একাধিকবার বালখিল্য ভুলে দলকে বিপদে ঠেলে দিলেন ৷
- বিদেশী বাছাইয়ে ব্যর্থতা...
জাভিয়ের সিভেরিও টোরো ও বোরহা ফার্নান্দেজকে ছেড়ে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ৷ বদলে দলে এসেছিলেন ভিক্টর ভাসকুয়েজ ও ফেলিসিও ব্রাউন ফোর্বস ৷ নামীদামি ক্লাবের জার্সি গায়ে চড়ানো দুই খেলোয়াড়ের মাঠে নড়াচড়া দেখলে চোখ কপালে উঠবে ৷ কলকাতা ময়দানের অবসর নেওয়া যেকোনও বাঙালি খেলোয়াড় ওই পজিশনে বেশি কার্যকর হবে ৷
- মাঠের বাইরের সমস্যাকে প্রকট করে তোলা...
প্রায় প্রতি ম্যাচের শেষেই রেফারিং নিয়ে সরব হয়েছেন দলের হেডস্যর ৷ তার উপর একাধিক ম্যাচে কার্ড দেখে ডাগ-আউটে ছিলেন না কুয়াদ্রাত ৷ কোচের এহেন শরীরিভাষা প্রভাব ফেলেছে দলে ৷ মাঠের নিজেদের বোঝাপড়ার অভাব নয়, ব্যর্থতার জন্য রেফারিংকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিলেন খেলোয়াড়রাও ৷
আরও পড়ুন: