কলকাতা, 5 ফেব্রুয়ারি: জাতীয় গেমসের আসরে বাংলার সাফল্যে আবারও সঙ্গী বিতর্ক ৷ প্রশাসনের 'আমরা-ওরা' অভিযোগের ফল ভোগ করতে হল বাংলার যোগাসনের দলকে। 'চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স' হয়েও জুটল না বাংলার লোগো ও প্রতীক দেওয়া ট্রাকস্যুট এবং জার্সি। নিজেদের পোশাকে অংশ নিয়েই সোনা-রুপোর পদক গলায় ঝোলালেন রাজ্যের মেয়েরা।
ঋতু মণ্ডল সোনা জিতলেন ট্র্যাডিশনাল যোগায়। সর্বশ্রী মণ্ডল এবং সাথী মণ্ডল সোনা পেয়েছেন রিদিমিক পেয়ার ইভেন্টে। আর্টিস্টিক সিঙ্গল ইভেন্টে সোনা শিল্পা দাসের ঝুলিতে। ট্র্যাডিশনাল ইভেন্টে রুপো সাথী মণ্ডলের। সোনা-রুপোর সামগ্রিক যোগফলে 'চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স' ট্রফি এসেছে বাংলার ঘরে। জাতীয় গেমসে সফল বাংলার মেয়েরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের দলেও জায়গা করে নিয়েছেন। যোগাসনে বাংলাকে সাফল্য এনে দেওয়া মেয়েদের উঠে আসা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। যার নেপথ্যে রয়েছে লড়াইয়ের ছবি। সাধারণভাবে যোগাসন মানে আমাদের কাছে কেবলমাত্র ফিটনেস বাড়ানোর খেলা। কিন্তু অ্যাডভান্স যোগাসন বাড়তি কিছু। সেই বাড়তি চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন বাড়তি জোগান ৷
ঋতু মণ্ডল হুগলির হিন্দমোটরের মেয়ে। বাবা রাজমিস্ত্রী, মা গৃহবধু। বাড়িতে দাদা অসুস্থ হওয়ার পরে যোগব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। দাদাকে দেখেই যোগাসন শুরু ঋতুর। বলছিলেন, "দাদার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। অসুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শে বাবা দাদাকে যোগাসনে ভর্তি করে দেয়। দাদাকে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। হিন্দমোটরের উদয়ন সংঘ ক্লাবে আমি যোগা শিখেছি। দাদাই আমার কোচ।"
জাতীয় গেমসে যাওয়ার সময় কেউ খোঁজ রাখেনি। সেদিনের খোঁজ না-রাখা মানুষগুলোই এখন অভিনন্দনের হাত বাড়াচ্ছেন। ঋতু বলছেন, "পদক ছিনিয়ে আনতে না-পারলে কেউই মনে রাখবে না জানতাম। আশা করি এবার পরিবর্তন আসবে জীবনে।" এশিয়ান গেমসকে পাখির চোখ করে আগামীর প্রস্তুতি শুরু করতে চান তিনি।
![NATIONAL GAMES](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/05-02-2025/23480965_wb_ng.jpg)
মুর্শিদাবাদের কান্দির বাসিন্দা শিল্পা দাস। পাড়ার এক পরিচিত দিদিকে দেখে এবং তাঁর পরামর্শে দশ বছর বয়সে যোগাভ্যাস শুরু তাঁর। ফিজিক্যাল এডুকেশন নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করা শিল্পা ফিজিক্যাল এডুকেশনেই জীবন গড়তে চান। সাফল্যের আরেক নাম সর্বশ্রী মণ্ডলের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানে। বাবা যোগব্যায়ামের শিক্ষক। তাঁর কাছে যোগশিক্ষার হাতেখড়ি সর্বশ্রীর। ফিজিক্যাল এডুকেশন নিয়ে পড়াশোনা করা সর্বশ্রী বলছেন, "রিদিমিক যোগার আলাদা কোনও পরিকাঠামো নেই বাংলায়। আমরা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গানের তালে তালে এটা প্র্যাকটিস করি।"
সাথী মণ্ডল তৃতীয় শ্রেণী থেকে থেকে যোগাসন করছেন। প্রথমে যোগাসন নিয়ে তাঁর কোনও পরিকল্পনা ছিল না। প্রতিবেশী স্বপ্না পালকে দেখে অনুপ্রাণিত তিনি। বাবা টোটো চালান। মা বেসরকারি হাসপাতালের নার্স। সবমিলিয়ে যোগাকে বাহন করেই জীবনের রাজপথে এগোতে চান সফল প্রত্যেকে। রাজ্য সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই অর্থ এবং চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় ফিরে প্রতিশ্রুতির কতটা পালন হয়, তা তাঁরা দেখতে চান।
হৃষিকেশে বাংলার যোগাসনের এই ফিল-গুড আবহেও লুকিয়ে অবহেলার ছবি। সেখানে রয়েছে রাজ্য যোগাসনের পারস্পরিক টানাপোড়েনের গল্প। বাংলা দলের মেয়েদের কোচ সুজাতা চৌধুরী বলছেন, "ওদের জন্য খুবই ভালোলাগছে ৷ ওরা পশ্চিমবঙ্গের নাম সারা দেশের সামনে উজ্জ্বল করেছে।চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্সের খেতাব পেয়েছে ৷ যোগাসনে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান শীর্ষে।" আনন্দের এই আবহে অবহেলার গল্পও বললেন তিনি ৷ তাঁর কথায়, "বাংলার অলিম্পিক সংস্থা থেকে কোনওরকমের ড্রেসকোড বা ট্রাকস্যুট কিছু দেওয়া হয়নি। আমরা নিজেদের পয়সায় এসেছি, হোটেলে থেকেছি। প্রত্যেকটা রাজ্যেরই ড্রেসকোড আছে অথচ আমাদের নেই।"
এ ব্যাপারে রাজ্য যোগাসন অ্যাসোসিয়েশনের সচিব গৌতম সিনহা বলছেন, "দল নির্বাচন অল বেঙ্গল যোগাসন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন করে। ওদের দিল্লির অনুমোদন রয়েছে। অন্যান্য কয়েকটি সংস্থার মত যোগাসনেও সমস্যা রয়েছে। তবে ওরা যোগাযোগ না-করলে কী করে পাবে। যোগাসনের পোশাক তো বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে পড়ে আছে। অল বেঙ্গল যোগাসন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের তরফে কেউ যোগাযোগ করেনি। দলটা কবে গিয়েছে তার খবর পর্যন্ত জানায়নি।"
গৌতম সিনহার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন অঞ্জন রায়। অল বেঙ্গল যোগাসন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব বলছেন, "আমরা তো ডাক পেয়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ওখানে গৌতম সিনহার কাছে আমাদের পোশাক চেয়েছিলাম। আমাদের বলা হয়েছিল গোডাউনে রাখা আছে। গোডাউনে গিয়ে জানতে পারি আমাদের পোশাক তৈরিই হয়নি। বলা হয়েছিল যাওয়ার দিন দেওয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। বিওএ প্রেসিডেন্ট চন্দন রায়চৌধুরী বলেছিলেন বিমানে পাঠাবেন। সেটাও হয়নি। পুরোটাই মিথ্যে বলছেন গৌতম সিনহা।"
গণ্ডগোল যে হয়েছে তা বিওএ মানছে। প্রেসিডেন্ট চন্দন রায়চৌধুরী বলছেন, "এত জন প্রতিযোগীর খবর রাখা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার জন্য রাজ্য সংস্থা রয়েছে। যারা পোশাক পায়নি, তারাই বলতে পারবে। আমাদের শেফ দ্য মিশন ওদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ওরা সমস্ত নথি নিয়ে এলেই আমরা রেলের যাতায়াত সমেত সব টাকার ব্যবস্থা করে দেব।"