হায়দরাবাদ, 10 মার্চ: নজির ভেঙে ব্রিগেড থেকেই লোকসভার প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করেছে তৃণমূল ৷ প্রার্থীদের পরিচয় দিয়ে, ব়্যাম্পে হাটিয়ে যেভাবে লোকসভা ভোটের ঢাকে কাঠি দিল রাজ্যের শাসকদল, তা অতীতে দেখেনি বাংলা ৷
1998 সালের লোকসভা ভোটে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে তৃণমূল ৷ তারপর থেকে কোনওবার লোকসভার আগে প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেনি জোড়াফুল শিবির ৷ অষ্টম লোকসভার ভোটের আগে প্রথা ভাঙল ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যান্ড কোং’ ৷
আটদিন আগে প্রথম প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ তালিকায় ঠাঁই মিলেছিল এ রাজ্যের 20 জনের ৷ এখনও 22টি আসনে প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেনি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ৷ অন্যদিকে, স্টেপ-আউট করে বৃত্ত সম্পন্ন করে ফেলেছে তৃণমূল ৷ দেখা যাচ্ছে, বিজেপি’র ঘোষিত বহু আসনেই কার্যত সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি ৷ পদ্মশিবির শীঘ্রই দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করতে চলেছে ৷ তা হলে টক্করের তালিকা যে আরও বাড়বে তা বলাই বাহূল্য ৷
বিষ্ণুপুরে ‘গৃহদাহ’
শিরোনাম আংশিক ভুল ৷ ‘গৃহদাহ’ আগেই ঘটে গিয়েছে, ঘর ভেঙে পথ আলাদা হয়েছে সৌমিত্র খাঁ ও সুজাতা মণ্ডলের ৷ একদা স্বামীর হয়ে প্রচারে নামা সেই সৌমিত্রর প্রাক্তন ঘরণীকেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল ৷
বিচ্ছেদের পর থেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে তরবারি শানিয়েছেন দু’জনে ৷ ফলে বিষ্ণুপুরে শুধু ফাইটই নয়, আকর্ষণীয় হতে চলেছে ভোটপ্রচারও ৷ কোন গোপন কথাটি রবে না গোপনে, তা জানতেই উৎসুক জনতা ৷
হুগলিতে ‘নায়িকা সংবাদ’
2019 সালে এই কেন্দ্র থেকেই জিতেছিলেন বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্য়ায় ৷ এবারও ওই আসনে তাঁকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি ৷ অন্যদিকে, কয়েকদিন আগে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রিয়েলিটি শো’তে গিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ তারপর থেকেই শোয়ের সঞ্চালিকা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের টিকিট পাওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল ৷
ব্রিগেডের মঞ্চে শুধু তাতে সিলমোহরই পড়েনি ৷ অভিনয় জগতে একদা সতীর্থকে চ্যালেঞ্জ করেই রাজনৈতিক ইনিংস শুরু করলেন রচনা ৷ 2019 সালে 70 হাজারেরও বেশি ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের রত্না দে নাগ’কে হারিয়ে প্রথমবার সাংসদ হন লকেট ৷ তিনি হুগলির উন্নয়নে 17 কোটি খরচের দাবি করলেও, দেখা মেলে না বলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্থানীয়রা ৷ ফলে গঙ্গাপাড়ে লড়াই এবার জমজমাটি ৷
ঘাটালে ‘হিরোগিরি’
ঘাটালে হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের (হিরণ) নাম ঘোষণা করেছিল বিজেপি ৷ অন্যদিকে তৃণমূলের টিকিটে যে ফের দেবই দাঁড়াচ্ছেন, তা স্পষ্টই ছিল ৷ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর লড়াইয়ে মুখোমুখি পর্দার দুই প্রাক্তন সতীর্থ ৷
হিরণের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে অনেকই সমালোচনায় মাতেন, ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ককে ‘হিরো হিরণ’ (হিরো হীরালালের অপভ্রংশ) বলেও সম্বোধন করেন অনেকে ৷ নায়কের ফিল্মোগ্রাফি দাগ না কাটলেও রাজনৈতিক কেরিয়ার যথেষ্ট উজ্জ্বল ৷ ফুল বদলে বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হয়েছেন ৷ অন্যদিকে, দেব ঘাটালের দু’বারের সাংসদ ৷ ফিল্মোগ্রাফি, রাজনৈতিক কেরিয়ার দু'য়েই হিরণের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ঘাটালে কঠিন লড়াই হবে, এমনটাই অভিমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ৷
বনগাঁয় ‘শান্তুনুর বদলা বিশ্বজিৎ’
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হওয়া শান্তনু ঠাকুর এখন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ৷ মতুয়া বেল্টকে বরাবরই সিএএ, এনআরসি ইস্যু নিয়ে লাগামে আনতে চায় তৃণমূল ৷ অন্যদিকে, অন্যান্য রাজ্যে নাগরিকত্বে সরব বিজেপি মতুয়া ভোটের দিকে তাকিয়ে খানিক নরম ৷
2021 সালে বাগদা থেকে বিধায়ক হয়েই দল বদলেছিলেন বিশ্বজিৎ দাস ৷ ভোটের মার্জিন খুব বেশি না হলেও তাঁকেই শান্তনুর বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে তৃণমূল ৷ দু’দলের কাছেই লড়াইটা কঠিন ৷
রানাঘাটে বিজেপি বনাম ‘প্রাক্তন’ বিজেপি
দিনদুয়েক আগে ফুল বদলেছেন রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক ৷ তৃণমূলে গিয়েই লোকসভার টিকিট পেয়েছেন ডাক্তারবাবু ৷ রানাঘাটে বিজেপির জগন্নাথ সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন মুকুটমণি অধিকারী ৷
2019 সালে প্রায় 2 লক্ষ 34 হাজার ভোটে জেতা জগন্নাথ সরকার রাজনীতিতে পোড়খাওয়া ৷ যদিও গত লোকসভায় রানাঘাট আসনে প্রথমে মুকুটমণির নামই ঘোষণা করেছিল বিজেপি ৷ সেসময় বাদকুল্লা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুকুটমণি ইস্তফা দিলেও তাঁর নমিনেশন বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন ৷ বদলে প্রার্থী হন জগন্নাথ ৷
বালুরঘাটে ‘প্রেস্টিজ ফাইট’
2019 সালে বালুরঘাট থেকে জেতা সুকান্ত মজুমদার এখন বিজেপির রাজ্য সভাপতি ৷ দিলীপের ছেড়ে যাওয়া হটসিটে বসা সুকান্ত এখন অনেক বেশি ‘রাজনৈতিক’ ৷ তাঁর বিরুদ্ধে হরিরামপুরের বিধায়ক বিপ্লব মিত্রকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল ৷ সাধন পাণ্ডের মৃত্যুর তাঁর হাতেই ক্রেতাসুরক্ষা দফতরের দায়িত্ব সঁপেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ ফলে বালুরঘাটে দুই দলের নয়, দুই প্রার্থীরও সম্মানের লড়াই ৷
আলিপুরদুয়ারে শক্ত লড়াই
2023 সালে প্রকাশ চিক বরাইককে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে তৃণমূল ৷ উচ্চকক্ষে পাঠানোর পরের বছরই তাঁকে নিম্নকক্ষের লড়াইয়ে নামাল দল ৷ রাজ্যের মন্ত্রী বুলুচিক বরাইকের ছেলে দেশের দরিদ্রতম সাংসদদের অন্যতম, ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ ৷ যদিও ‘বিচারপতি’ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমের খোঁচায় চাকরি হারিয়েছিলেন তাঁর দিদি সুস্মাচিক বরাইক ৷ অন্যদিকে, 2016 সাল থেকে মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিজ্ঞা এখন বিধানসভায় বিজেপির চিফ হুইপ ৷ ফলে আলিপুরদুয়ারের লড়াইয়ে নজর থাকবে রাজনৈতিক মহলের ৷
কোচবিহারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বনাম বিধায়ক
2021 সালের নির্বাচনে সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে আড়াই লক্ষ ভোটে জিতেছিলেন জগদীশচন্দ্র বর্ম বাসুনিয়া ৷ অন্যদিকে, কোচবিহার থেকে জেতা নিশীথ প্রামাণিক শুধু সাংসদই নন, অমিত শাহের ডেপুটিও বটে ৷ ফলে বিজেপির ক্ষেত্রে কার্যত প্রেস্টিজিয়াস ফাইট।
রবিবারের ব্রিগেডের পরতে পরতে চমকের বন্দোবস্ত করেছিল রাজ্যের শাসকদল ৷ একদিকে যেমন টিকিট পেলেন না মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহান, সেভাবে দুই প্রাক্তন ক্রিকেটারকে রাজনীতির বাইশ গজে নামিয়ে ‘খেলা’ ঘোরানোর বার্তা দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ ব্রিগেডের দায়িত্বে থাকা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলেও, ‘সেনাপ্রধান’ যে তিনিই, প্রার্থীদের সঙ্গে ব়্যাম্পে হেঁটে তা বুঝিয়েছেন মমতা ৷ তৃণমূল সুপ্রিমোর বাকি 22 প্রার্থীর বদলে বিজেপি কাদের টিকিট দেয়, সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল ৷
আরও পড়ুন: