নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন সরকারি ক্ষেত্রে ল্যাটারাল এন্ট্রি বা সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার মধ্য়েই এই সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা নিয়োগের ক্ষেত্রে কাজের সংস্কৃতির অমিলগুলিকে সংশোধন করা প্রয়োজন ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব ও ডিরেক্টর পদে বিশেষজ্ঞ হিসাবে পেশাদারদের সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা নিয়োগের জন্য এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল ৷ পরে এই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করা হয় ৷ এইক্ষেত্রে একটি বিষয় অনেকেরই নজর এড়িয়ে গিয়েছে ৷ তা হল, সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ কিন্তু একই রকম নয় ৷
কাজের পরিবেশে সম্পূর্ণ বৈপরীত্যের জন্য সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা হিসেবে নিয়োগ যাঁদের করা হবে, তা তাঁদের কর্মক্ষমতার জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হতে পারে ৷ যার ফলে সরকারি দফতরগুলির দৈনন্দিন কাজের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ৷ ফলে নতুন ধারণা ও দক্ষতা আনার জন্য সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হতে পারে । সরকারি ক্ষেত্রে পরিষেবা প্রদানের জন্য নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন জরুরি ।
যদিও বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ হয় দ্রুতগতিতে ৷ বজায় রাখা হয় গতিশীল পরিবেশ ৷ যেখানে প্রধানত মুনাফা বৃদ্ধি করা যায়, খরচ কমানো ও দক্ষতার উপর জোর দেওয়া হয় ৷ অন্যদিকে সরকারি মন্ত্রক এবং দফতরগুলি মূলত আমলাতান্ত্রিক ও শ্রেণিবদ্ধ প্রকৃতির হয় ৷ সেখানে জনকল্যাণ এবং শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয় ৷ বেসরকারি ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য পারফরম্যান্সের প্রয়োজনীয়তা ও লক্ষ্যপূরণ দরকার হয় ৷ তা ব্যক্তিগত ও দলগত, উভয়ক্ষেত্রেই সমান জরুরি ৷ সেই কারণে বেসরকারি ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স নির্ভর কর্মসংস্কৃতির উপর বেশি জোর দেওয়া হয় ৷
বেসরকারি সংস্থাগুলি নমনীয় হয় এবং উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের বদলে নিতে পারে ৷ পাশাপাশি প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়েও ভাবতে পারে বেসরকারি সংস্থাগুলি ৷ সরকারি ক্ষেত্রগুলি একটি নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থাকে ৷ নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে ধীর গতিতে চলে ৷ কোনও পরিবর্তন সহজে গ্রহণ করা হয় না ৷ যদিও কর্পোরেট বিশ্ব প্রতিটি সুযোগ দখলের দিকে নজর রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকেন্দ্রীকরণকে উৎসাহিত করে ৷ পাশাপাশি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও তা কার্যকর করার বিষয়টিকে মোকাবিলা করে ৷ অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রচলিত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা মেনেই চলা হয় ৷
প্রতিযোগিতামূলক ও যোগ্যতা-ভিত্তিক পদোন্নতি হল বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ৷ অথচ সরকারি দফতরগুলিতে কাজের সময়ের নিরিখে যাঁরা সিনিয়র, তাঁদেরই পদোন্নতি হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ৷ এখনও পর্যন্ত চাকরির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাই অন্যান্য বিষয়গুলির সঙ্গে সরকারি ক্ষেত্রে কাজ করার আগ্রহ তৈরিতে মূল প্রেরণা ৷ তা সত্ত্বেও বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মচারীরা প্রায়শই পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে ইনসেনটিভ পান ৷
টেকনোক্র্যাটরা যখন সরকারি ক্ষেত্রে সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা হিসাবে যাঁরা যোগদান করেন, তখন কাজের পরিবেশের এই পার্থক্য শুধুমাত্র কর্মসংস্কৃতি ও কর্মীদের কাজের অনুপ্রেরণাকে প্রভাবিত করবে, তা নয় ৷ বরং তাঁদের কাজের সন্তুষ্টি এবং তার জেরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার উপরও প্রভাব ফেলবে । একদিকে যখন বেসরকারি ক্ষেত্রে মুনাফা বৃদ্ধি করতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মূলনীতি নিয়ে চলে ৷ তাতেই উন্নতি হয় ৷ অন্যদিকে তখন সরকারি মন্ত্রক ও দফতরগুলি সামাজিক কল্যাণ এবং শেষ পর্যন্ত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উপর বেশি মনোযোগ দেয় ।
ম্যাক্স ওয়েবারের প্রস্তাবিত একটি ওয়েবেরিয়ান আমলাতন্ত্রের মডেল অনুসরণ করা হয় সরকারি ক্ষেত্রে ৷ যা অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক, পক্ষপাতমূলক নয় এমন এবং প্রকৃতিগত ভাবে সংগঠিত হয় । সরকারি আমলাতন্ত্র শ্রেণীবদ্ধ কাঠামো, পেশাদার, নিয়ম-নির্ভর, পক্ষপাতহীন, মেধা-নির্ভর এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ সরকারি কর্মচারীদের সংস্থা, যাঁরা একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী । এটা সাধারণত লক্ষ্য করা যায় যে সরকারি ক্ষেত্রের কর্মচারীরা উদ্ভাবনী কিছু করার চেয়ে চাকরির স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বেশি সতর্ক থাকেন ।
অন্যদিকে, বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ, ঝুঁকি নেওয়া এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা হয় ৷ এক্ষেত্রে নেতৃত্ব এবং দল-ভিত্তিক সংস্কৃতির উপর জোর দেওয়া হয় ৷ সহযোগিতা এবং একটি বিভাগের মধ্যে ও দুই বিভাগের মধ্যে যোগোযোগের বিষয়টি উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করে ৷ একটি সাধারণ সরকারি পরিবেশে লোকজনকে খুব প্রয়োজন না থাকলে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা যায় না ৷
এছাড়াও, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকর্তারা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দৈনন্দিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের চাপ সহ্য করতে অভ্যস্ত ৷ যা সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত আমলারা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন না । প্রকৃতপক্ষে, এর কারণ হল ব্যাপক প্রশিক্ষণ, যা আমলাদের এভাবে তৈরি করে ৷ সেই কারণে এই প্রশিক্ষণকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল একবার ভারতের ‘স্টিল ফ্রেম’ বলে উল্লেখ করেছিলেন । সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত আমলারা পেশাগত কর্মজীবনে একটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৷ তাই তাঁদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক ।
সরকারের সুবিধার জন্য এই প্রতিভাকে ব্যবহার করতে ও তা ঠিক রাখতে সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা হিসেবে সরকারে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার আগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এবং এর জন্য একটি বিস্তারিত ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত করাও জরুরি ৷ না-হলে একেবারে বিপরীত কাজের পরিস্থিতির কারণে কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন হলে এবং তার জেরে যদি সামঞ্জস্যের ঘাটতি হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তি কারোরই কোনও লাভ হবে না ৷
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেরির জেরে নীতি-পঙ্গুত্বের পথ প্রশস্ত হয় ৷ এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত বাছাই করা কর্মকর্তা এবং সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা হিসেবে নিযুক্ত হওয়াদের মধ্যে ফাটলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না । বিশেষজ্ঞরা, যাঁরা এই পদ্ধতিতে সরকারি ক্ষেত্রে কাজ করতে আসবেন, তাঁরা এই পরিস্থিতির জেরে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন এবং চুক্তির সময় শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে চাইবেন ৷ তাই সরকারি দফতরে সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে আমলা নিয়োগের ব্লুপ্রিন্ট চূড়ান্ত করার আগে নীতি-নির্ধারকদের এই পার্থক্যগুলি বিবেচনা করতে হবে ৷
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের। এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না৷)
(লেখক যোধপুরের এমবিএম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন)