ETV Bharat / opinion

হাসিনার শাসনের পতনে ভারতের নিরাপত্তায় আশঙ্কার মেঘ - Bangladesh Crisis - BANGLADESH CRISIS

Bangladesh Crisis: ছাত্রদের ব্যাপক বিক্ষোভের পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন । বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে । ভবিষ্যতে হয়তো বিএনপি-র নেতৃত্বে সরকার হবে সেদেশে ৷ সামগ্রিক পরিস্থিতি ভারতের জন্য অনুকূল নয় ৷ কী কী সমস্যায় পড়তে পারে ভারত, কীভাবে তার মোকাবিলা করা উচিত, সেই নিয়ে লিখেছেন ড. রেভেল্লা ভানু কৃষ্ণ কিরণ ৷

Bangladesh Crisis
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ (এএনআই)
author img

By DR Ravella Bhanu Krishna Kiran

Published : Aug 13, 2024, 8:49 PM IST

বিক্ষোভের কাছে নতিস্বীকার করে ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গত 5 অগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন ৷ তার পর গত বৃহস্পতিবার নোবেল বিজয়ী মহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ অন্তর্বর্তী সরকারে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) ও নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সংগঠন জামায়েত ই ইসলামিও (জেইআই) রয়েছে৷ আগামী নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসবে ও সম্ভবত খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন । তা সত্ত্বেও ভারত-বিরোধী এই অন্তর্বর্তী সরকার নয়াদিল্লি-ঢাকার সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে ৷ এই সম্ভাব্য পরিবর্তন স্পষ্টতই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব কমাবে ৷ যার ফলে ভারতের নিরাপত্তা কৌশল উল্লেখযোগ্যভাবে ধাক্কা খাবে । বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের দিক থেকে যোগাযোগ, উদ্বাস্তুদের নিয়ে ঝুঁকি, জঙ্গি কার্যকলাপ, বঙ্গোপসাগর ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেখা হয় ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে 4 হাজার 96 কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নেয় ৷ যা ভারতকে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য উন্নত রাখতে প্রবেশাধিকার দেয় এবং বঙ্গোপসাগরের পথেও সেই সুযোগ তৈরি করে ৷ ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের অর্থ বাংলাদেশের স্থলপথ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহণ বিলম্বিত হতে পারে ৷ একই সঙ্গে 2023 সালের নভেম্বরে চালু হওয়া আগরতলা-আখাউড়া আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগেও সমস্যা তৈরি হতে পারে ৷ চিকেনস নেক (শিলিগুড়ি করিডোর) ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্ব ভারতের অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকীর্ণ পথ । কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল এই অঞ্চলে যেকোনও বাধা ও গোলমাল এই অঞ্চলটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে ৷ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় ৷

উদ্বাস্তুদের নিয়ে ঝুঁকি

বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে৷ হাসিনার অনুগামীরা ভারতে শরণার্থী হিসেবে থাকতে চাইছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন ৷ তাছাড়া সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা নতুন সরকারের অধীনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন ৷ তার জেরে স্থানীয় রাজনীতি ও নিরাপত্তার উপর প্রভাব পড়তে পারে । বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য মেঘালয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় রাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে ৷ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) সীমান্তে অনুপ্রবেশ রুখতে নজরদারি বাড়িয়েছে ৷

সন্ত্রাসবাদ

সন্ত্রাস-বিরোধী সহযোগিতা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ৷ কারণ, ভারতবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি ভৌগোলিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ব্যবহার করে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে ৷ পাকিস্তানে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির দ্বারা ভারত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের শিকার ৷ ওই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি বাংলাদেশকে ভারতে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করে । হাসিনার শাসনকালে সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ভারতবিরোধী দমন-পীড়ন করা হয়েছে । গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ঢাকা নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রেখেছে এবং 2013 সালে ভারতের সঙ্গে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিও করেছে । বহুবার বাংলাদেশের তরফে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম (উলফা)-এর সদস্যদের গ্রেফতার করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ।

খালেদা জিয়ার শাসনকালে (1991-1996 ও 2001-2006) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন ও তাদের বাংলাদেশে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল ৷ আইএসআই যাতে উলফা, ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন) এবং অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ)-এর মতো উত্তর-পূর্বের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করতে পারে, তার জন্য সবরকম সাহায্য করেছে বিএনপি-জেইআই জোট সরকার ৷ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য জঙ্গিদের ঢাকা থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল তারা । বাংলাদেশে বর্তমান যা পরিস্থিতি আর ভবিষ্যতে বিএনপি-জেইআই এর সরকার তৈরি হলে, তা আইএসআই এর জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে ৷ তাহলে আইএসআই আবার উত্তর-পূর্বের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে ও বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি (হুজি)-কে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে ৷ উত্তর-পূর্বে ফের সন্ত্রাসবাদ শুরু করার সুযোগ পেয়ে যাবে তারা ৷ তাছাড়া খালেদা জিয়ার পুত্র তারেকের সঙ্গে আইএসআই এবং উলফা প্রধান পরেশ বড়ুয়া এবং দাউদ ইব্রাহিম-সহ সন্ত্রাসবাদীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা অবশ্যই ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বিপদ ডেকে আনবে ।

বঙ্গোপসাগর

আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের শীর্ষে অবস্থিত বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে নয়াদিল্লির প্রাথমিক স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, এটা মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী ৷ এই প্রণালী বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক চোকপয়েন্ট এবং এটা ভারত মহাসাগরকে দক্ষিণ চিন সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে । তাই বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, এই অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান ও আগ্রাসী উপস্থিতি দূরে রাখতে ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা নয়াদিল্লির জন্য প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ৷ বর্তমান সংকটের ধারাবাহিকতা ও সম্ভাব্য জিয়া সরকারের অধীনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে, ভারত বঙ্গোপসাগরে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে ৷ কারণ, চিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে তার প্রভাব বিস্তারের জন্য এই সংকটের সুযোগ নেবে । বাংলাদেশের নতুন শাসন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে ৷ বাংলাদেশের এই অস্থিরতা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষীদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় অনুশীলন করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে ৷ এই সহযোগিতা ও সমন্বয় করা হয় জলবায়ু নিরাপত্তা, মানব পাচার, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান এবং বিমসটেক (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য ৷

সামরিক সহযোগিতা

বাংলাদেশ যাতে চিনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়, সেই কারণে ভারত ওই দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে ৷ নয়াদিল্লি ও ঢাকা উভয়ই যৌথ সামরিক মহড়া 'সম্প্রীতি', প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, চিকিৎসা সহায়তা এবং ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে জড়িত । বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার, উপকূলরক্ষী টহল নৌকা, যোগাযোগ সরঞ্জাম কেনার জন্য 500 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রেডিট লাইনের অধীনে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে এবং রাশিয়ান-অরিজিন মিগ-29 ও এমআই-17 হেলিকপ্টারের রক্ষণাবেক্ষণে খুচরো জিনিসপত্র কেনার জন্যও আলোচনা চলছে ৷ বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা সামরিক সহযোগিতার ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা, যা বেজিংয়ের পালটা হিসাবে একটি সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল ।

মনে হচ্ছে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে এবং বিএনপি-জেইআই-এর নেতৃত্বে ভারতবিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চিনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা ছিল । অতীতেও তারা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ভারত বিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । বর্তমানে শেখ হাসিনার মার্কিন ভিসা বাতিল যুক্তরাষ্ট্রের অসৎ উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে । সংরক্ষণের বিরুদ্ধে ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা হিংসাত্মক বানিয়েছে আইএসআই ও চিনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রকের দ্বারা প্রশিক্ষিত জেইআই-এর ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্র শিবির (আইসিএস) ৷ যার জেরে আওয়ামী লীগ নেতা এবং অভিনেতা শান্ত ও তাঁর বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ড, লোকশিল্পী রাহুল আনন্দের বাসভবন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং হিন্দুদের ওপর হামলার মতো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে । এখন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ভারতের প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য হল অ্যাক্ট ইস্ট নীতির একটি প্রধান অংশীদার এবং বিমসটেকের একটি নির্ভরযোগ্য মিত্রকে একটি মৌলবাদী ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না করার বিষয়টি নিশ্চিত করা । সেই পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লির প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হল আগত সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য দ্রুত অগ্রসর হওয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে যুক্ত করে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলিকে সক্রিয় করা । উল্লেখযোগ্যভাবে, হাসিনার কট্টর সমর্থনের জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান ভারত বিরোধী মনোভাব রোধ করার প্রস্তাবগুলিকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের জন্য বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে, যা একটি কঠিন কাজ । একটি অনিবার্য পরিস্থিতিতে, যদি নতুন সরকার ভারত বিরোধী পন্থা অব্যাহত রাখে, ভারতকে অবশ্যই র (রিসার্চ অ্য়ান্ড অ্যানালিসিস উইং)-এর ‘অপারেশন ফেয়ারওয়েল’ এর মতো একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করতে হবে ৷ যেটা তৈরি করা হয়েছিল আইএসআই-পন্থী, সিআইএ-পন্থী এরশাদের শাসনের (1983-1990) বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করতে এবং ওই সরকারকে পদত্য়াগে বাধ্য করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে ৷

বিক্ষোভের কাছে নতিস্বীকার করে ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গত 5 অগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন ৷ তার পর গত বৃহস্পতিবার নোবেল বিজয়ী মহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ অন্তর্বর্তী সরকারে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) ও নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সংগঠন জামায়েত ই ইসলামিও (জেইআই) রয়েছে৷ আগামী নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসবে ও সম্ভবত খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন । তা সত্ত্বেও ভারত-বিরোধী এই অন্তর্বর্তী সরকার নয়াদিল্লি-ঢাকার সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে ৷ এই সম্ভাব্য পরিবর্তন স্পষ্টতই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব কমাবে ৷ যার ফলে ভারতের নিরাপত্তা কৌশল উল্লেখযোগ্যভাবে ধাক্কা খাবে । বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের দিক থেকে যোগাযোগ, উদ্বাস্তুদের নিয়ে ঝুঁকি, জঙ্গি কার্যকলাপ, বঙ্গোপসাগর ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেখা হয় ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে 4 হাজার 96 কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নেয় ৷ যা ভারতকে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য উন্নত রাখতে প্রবেশাধিকার দেয় এবং বঙ্গোপসাগরের পথেও সেই সুযোগ তৈরি করে ৷ ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের অর্থ বাংলাদেশের স্থলপথ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহণ বিলম্বিত হতে পারে ৷ একই সঙ্গে 2023 সালের নভেম্বরে চালু হওয়া আগরতলা-আখাউড়া আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগেও সমস্যা তৈরি হতে পারে ৷ চিকেনস নেক (শিলিগুড়ি করিডোর) ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্ব ভারতের অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকীর্ণ পথ । কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল এই অঞ্চলে যেকোনও বাধা ও গোলমাল এই অঞ্চলটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে ৷ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় ৷

উদ্বাস্তুদের নিয়ে ঝুঁকি

বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে৷ হাসিনার অনুগামীরা ভারতে শরণার্থী হিসেবে থাকতে চাইছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন ৷ তাছাড়া সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা নতুন সরকারের অধীনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন ৷ তার জেরে স্থানীয় রাজনীতি ও নিরাপত্তার উপর প্রভাব পড়তে পারে । বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য মেঘালয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় রাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে ৷ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) সীমান্তে অনুপ্রবেশ রুখতে নজরদারি বাড়িয়েছে ৷

সন্ত্রাসবাদ

সন্ত্রাস-বিরোধী সহযোগিতা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ৷ কারণ, ভারতবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি ভৌগোলিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ব্যবহার করে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে ৷ পাকিস্তানে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির দ্বারা ভারত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের শিকার ৷ ওই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি বাংলাদেশকে ভারতে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করে । হাসিনার শাসনকালে সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ভারতবিরোধী দমন-পীড়ন করা হয়েছে । গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ঢাকা নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রেখেছে এবং 2013 সালে ভারতের সঙ্গে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিও করেছে । বহুবার বাংলাদেশের তরফে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম (উলফা)-এর সদস্যদের গ্রেফতার করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ।

খালেদা জিয়ার শাসনকালে (1991-1996 ও 2001-2006) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন ও তাদের বাংলাদেশে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল ৷ আইএসআই যাতে উলফা, ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন) এবং অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ)-এর মতো উত্তর-পূর্বের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করতে পারে, তার জন্য সবরকম সাহায্য করেছে বিএনপি-জেইআই জোট সরকার ৷ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য জঙ্গিদের ঢাকা থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল তারা । বাংলাদেশে বর্তমান যা পরিস্থিতি আর ভবিষ্যতে বিএনপি-জেইআই এর সরকার তৈরি হলে, তা আইএসআই এর জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে ৷ তাহলে আইএসআই আবার উত্তর-পূর্বের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে ও বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি (হুজি)-কে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে ৷ উত্তর-পূর্বে ফের সন্ত্রাসবাদ শুরু করার সুযোগ পেয়ে যাবে তারা ৷ তাছাড়া খালেদা জিয়ার পুত্র তারেকের সঙ্গে আইএসআই এবং উলফা প্রধান পরেশ বড়ুয়া এবং দাউদ ইব্রাহিম-সহ সন্ত্রাসবাদীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা অবশ্যই ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বিপদ ডেকে আনবে ।

বঙ্গোপসাগর

আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের শীর্ষে অবস্থিত বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে নয়াদিল্লির প্রাথমিক স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, এটা মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী ৷ এই প্রণালী বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক চোকপয়েন্ট এবং এটা ভারত মহাসাগরকে দক্ষিণ চিন সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে । তাই বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, এই অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান ও আগ্রাসী উপস্থিতি দূরে রাখতে ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা নয়াদিল্লির জন্য প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ৷ বর্তমান সংকটের ধারাবাহিকতা ও সম্ভাব্য জিয়া সরকারের অধীনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে, ভারত বঙ্গোপসাগরে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে ৷ কারণ, চিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে তার প্রভাব বিস্তারের জন্য এই সংকটের সুযোগ নেবে । বাংলাদেশের নতুন শাসন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে ৷ বাংলাদেশের এই অস্থিরতা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষীদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় অনুশীলন করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে ৷ এই সহযোগিতা ও সমন্বয় করা হয় জলবায়ু নিরাপত্তা, মানব পাচার, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান এবং বিমসটেক (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য ৷

সামরিক সহযোগিতা

বাংলাদেশ যাতে চিনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়, সেই কারণে ভারত ওই দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে ৷ নয়াদিল্লি ও ঢাকা উভয়ই যৌথ সামরিক মহড়া 'সম্প্রীতি', প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, চিকিৎসা সহায়তা এবং ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে জড়িত । বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার, উপকূলরক্ষী টহল নৌকা, যোগাযোগ সরঞ্জাম কেনার জন্য 500 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রেডিট লাইনের অধীনে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে এবং রাশিয়ান-অরিজিন মিগ-29 ও এমআই-17 হেলিকপ্টারের রক্ষণাবেক্ষণে খুচরো জিনিসপত্র কেনার জন্যও আলোচনা চলছে ৷ বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা সামরিক সহযোগিতার ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা, যা বেজিংয়ের পালটা হিসাবে একটি সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল ।

মনে হচ্ছে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে এবং বিএনপি-জেইআই-এর নেতৃত্বে ভারতবিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চিনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা ছিল । অতীতেও তারা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ভারত বিরোধী শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । বর্তমানে শেখ হাসিনার মার্কিন ভিসা বাতিল যুক্তরাষ্ট্রের অসৎ উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে । সংরক্ষণের বিরুদ্ধে ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা হিংসাত্মক বানিয়েছে আইএসআই ও চিনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রকের দ্বারা প্রশিক্ষিত জেইআই-এর ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্র শিবির (আইসিএস) ৷ যার জেরে আওয়ামী লীগ নেতা এবং অভিনেতা শান্ত ও তাঁর বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ড, লোকশিল্পী রাহুল আনন্দের বাসভবন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং হিন্দুদের ওপর হামলার মতো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে । এখন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ভারতের প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য হল অ্যাক্ট ইস্ট নীতির একটি প্রধান অংশীদার এবং বিমসটেকের একটি নির্ভরযোগ্য মিত্রকে একটি মৌলবাদী ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না করার বিষয়টি নিশ্চিত করা । সেই পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লির প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হল আগত সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য দ্রুত অগ্রসর হওয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে যুক্ত করে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলিকে সক্রিয় করা । উল্লেখযোগ্যভাবে, হাসিনার কট্টর সমর্থনের জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান ভারত বিরোধী মনোভাব রোধ করার প্রস্তাবগুলিকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের জন্য বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে, যা একটি কঠিন কাজ । একটি অনিবার্য পরিস্থিতিতে, যদি নতুন সরকার ভারত বিরোধী পন্থা অব্যাহত রাখে, ভারতকে অবশ্যই র (রিসার্চ অ্য়ান্ড অ্যানালিসিস উইং)-এর ‘অপারেশন ফেয়ারওয়েল’ এর মতো একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করতে হবে ৷ যেটা তৈরি করা হয়েছিল আইএসআই-পন্থী, সিআইএ-পন্থী এরশাদের শাসনের (1983-1990) বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করতে এবং ওই সরকারকে পদত্য়াগে বাধ্য করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে ৷

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.