ETV Bharat / opinion

ইরানে ঢুকে ইজরায়েলের টার্গেটেড কিলিং ! মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি, ভারতে কী প্রভাব? - Middle East Tension

author img

By DR Ravella Bhanu Krishna Kiran

Published : Aug 5, 2024, 3:13 PM IST

Middle East Tension: যুদ্ধের দোড়গোড়া দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য ৷ ইরানে ঢুকে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল ৷ এর পালটা আক্রমণ হানবে ইরানও ৷ এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব ৷ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব পড়বে ভারতেও ৷ কারণ মধ্যপ্রাচ্য ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন লিখছেন রাবেলা ভানু কৃষ্ণ কিরণ ৷

Middle East War
ইজরায়েলের হামলায় প্যালেস্তাইনের পরিস্থিতি (ছবি সূত্র - সংবাদ সংস্থা এপি)

হায়দরাবাদ, 5 অগস্ট: ইজরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটসে গত 27 জুলাই রকেট হামলা চালিয়েছিল হিজবুল্লা ৷ এই হামলায় নিহত হয় 12 শিশু ৷ সেই হামলার পরে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বেইরুটের দক্ষিণ শহরতলিতে হিজবুল্লার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে টার্গেট করে ইজরায়েল ৷ যিনি গাজা যুদ্ধের সমান্তরালে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে পালটা আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন ৷ পাশাপাশি 30 জুলাই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার উপরও ইজরায়েলের তরফে হামলা চালানো হয় ৷ ইরানে নিজের বাসভবনে মৃত্যু হয় এই হামাস নেতার ৷ ইরানের প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান দিতে এসেছিলেন তিনি ।

ইরান ও প্যালেস্তাইন, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে প্রতিরোধে নেমেছে ইজরায়েল ৷ এরই মাঝে গুরুতর আঘাত হিসাবে ইজরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা আল-আকসা ফ্লাড অপারেশনের পরিকল্পনাকারী (7 অক্টোবর হামলা) হামাসের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার মহম্মদ দেইফকে হত্যা করেছে ৷ 13 জুলাই বিমান হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে ।

ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে শত্রুতা

জঙ্গিগোষ্ঠীর শীর্ষনেতাদের টার্গেট করে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পর ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে 40 বছরের পুরনো শত্রুতা এবং এর প্রতিরোধ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে । সম্প্রতি নেতা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু হামাসকে কীভাবে প্রভাবিত করবে? ইরান এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী কী ইজরায়েলের উপর হামলার প্রতিশোধ নিতে চলেছে? ইজরায়েল এবং আমেরিকা ভবিষ্যতে হুমকির জবাব দেওয়ার জন্য কীভাবে তৈরি হচ্ছে, এসব প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে, যা বিশ্বকে ব্যথিত করছে ।

2017 সালে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর চেয়ারম্যান হন হানিয়া ৷ এরপর থেকে তিনি একজন কৌশলগত পরিকল্পনাকারী, আঞ্চলিকভাবে ও বিশ্বব্যাপী হামাসের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে নেভিগেট করার ক্ষেত্রে একজন প্রধান নেতা হয়ে উঠেছিলেন ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তিনি 7 অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালানোর পর তুরস্ক, চিন ও রাশিয়ার কাছে পৌঁছনোর মাধ্যমে হামাসের জন্য সমর্থন পেতে সফল হয়েছিলেন ৷ হামাসের হাতে বন্দি ইজরায়েলিদের মুক্তির জন্য আলোচনায়ও তিনি যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন ।

তবে তাঁর মৃত্যু গাজা এবং মধ্যপ্রাচ্য উভয় ক্ষেত্রেই হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা । প্রকৃতপক্ষে হানিয়া হত্যা হামাসের আদর্শিক বা অপারেশনাল সক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করার কথা নয়, কিন্তু এর ফলে হামাসের কার্যকলাপে ক্ষণস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে । দলের নেতৃত্ব 2004 সালে হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ইয়াসিন এবং আবদেল আজিজ-আল-রান্টিসিকে হত্যা দেখেছে ৷ কিন্তু তাও হামাসকে নির্মূল করা যায়নি ৷ বরং পরিবর্তে দলটি আরও শক্তিশালী হয়েছে । আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদরা মনে করছেন, হানিয়ার মৃত্যু হলেও ইয়ানিয়া সিনওয়ারের নেতৃত্বে হামাস তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে ৷ সিনওয়ার হামাসকে সম্পূর্ণরূপে 24 ব্যাটালিয়নে যোদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিলেন, যা 7 অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ।

ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ পছন্দ

এর আগেও ইরান সরাসরি যুদ্ধ লিপ্ত হতে চায়নি ৷ বরং প্রতিরোধের ভাবনা থেকে প্রক্সি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে পছন্দ করে ৷ তবে তার ভূখণ্ড ঢুকে হানিয়াকে হত্যা করা হল, যা ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পক্ষে লজ্জাজনক ! পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ড পরবর্তীতে ইরানি এবং আরব বিশ্বের জনগণকে বোঝাতে কঠোর জবাবের প্রত্যাশা করে । তবে এখনই সরাসরি ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না ইরান বলেই মনে হচ্ছে ৷ যদি অদূর ভবিষ্যতে ইরান সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয় তাহলে সংঘর্ষটি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হবে ।

ইরান ইতিমধ্যেই তার 'এরানাস ইউনিটি' কৌশলের মাধ্যমে ইজরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ৷ এই কৌশলে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সদস্যদের অক্ষ দ্বারা যৌথ সামরিক অভিযান জড়িত । ইরান যদি তার প্রক্সিদের দ্বারা ইজরায়েলের উপর একযোগে বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সম্ভবত ব্যাপারটি খুব ধ্বংসাত্মক হবে এবং যুদ্ধে আমেরিকাকে ইজরায়েলের পক্ষ নিতে বাধ্য করবে, যা ইজরায়েল চায় ।

এছাড়া ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর ইরানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে ৷ কারণ মার্কিন ডলারের থেকে ইরানের রিয়ালের দাম হ্রাস পেয়েছে । ফলস্বরূপ যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা ইরানের স্বার্থে নয়, তবে ইরানের কৌশলটি পুরো মাত্রার যুদ্ধের পরিবর্তে হতে পারে ৷ এটি আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া এড়াতে আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে সংঘাত চালিয়ে যেতে চায় ।

ইরান এবং তার সমর্থিত প্রতিরোধের অক্ষ যার মধ্যে রয়েছে হামাস, লেবাননের হিজবুল্লা, ইয়েমেনের হুথি, কাতাইব হিজবুল্লাহ, ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ, ইরাকের শিয়াদের 47তম পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট ব্রিগেড (পিএমইউ) এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সিরিয়া হামাসের দ্বারা ইজরায়েলের ওতেফ আজা অঞ্চলে বসতি এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলার মতো অন্যান্য বিকল্পগুলি বেছে নিতে পারে ৷ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আল-তানফ, আল-রুকবান এবং আল-মালিকিয়া পূর্ব সিরিয়ার ইরাকের সীমান্তের কাছে ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ দ্বারা গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা ইসরায়েলের বসতি ।

হিজবুল্লা ইজরায়েলে হামলা চালাতে পারে

কাতাইব হিজবুল্লা চলতি বছরের 31 জুলাই বৈরুতে তার হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইজরায়েলকেও পরবর্তীতে আক্রমণ করতে পারে । ইজরায়েলের টার্গেট হত্যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ জুড়ে ইজরায়েল-বিরোধী অভিযানকে উদ্দীপিত করেছে এবং সেইসঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীর নিয়োগ প্রচেষ্টাকে বাড়িয়েছে । জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি কূটনৈতিক মিশন, ইহুদি প্রবাসী এবং আমেরিকান নাগরিকদের আক্রমণ করে যে কোনও জায়গায় ইজরায়েল এবং আমেরিকান স্বার্থের বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়িয়ে তুলতে পারে ।

ইজরায়েলের নিলি ইউনিট (ইসরায়েলের অনন্তকাল মিথ্যা নয়) 7 অক্টোবরের হামলায় ভূমিকা পালনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্মূল করার জন্য তাদের খোঁজ করছে । 2023 সালের ডিসেম্বরে ইরানের শীর্ষ কমান্ডার রেজা মুসাভি এবং 2024 সালের জানুয়ারিতে হামাস নম্বর 2 সালেহ আল-আরুরি ও এখন হানিয়া হত্যা, এর মাধ্যমে ইজরায়েল হামাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং অন্যান্যদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে ৷ এই বার্তি হল যে, তাঁরা কোন জায়গাতেই নিরাপদ নেই ৷

সমসাময়িক প্রতিশোধের ভাবনা থেকে ইজরায়েলের বিমানবাহিনীর প্রধান টোমার বার সতর্ক করেছিলেন যে,দেশের নাগরিকদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে এমন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ইজরায়েল ৷ পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেছেন, ইজরায়েল তার আকাশ পথে প্রতিরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের সঙ্গে তাদের মিশনটি সম্পন্ন করার জন্য সর্বোত্তম শক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে ।

ইজরায়েলকে আশ্বাস হোয়াইট হাউসের

ইতিমধ্যে হোয়াইট হাউস ইরান এবং তার প্রক্সি গোষ্ঠীর সমস্ত হুমকির বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে । এর জন্য আমেরিকার দুটি নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার প্রস্তুত রয়েছে ৷ পাশাপাশি ইউএসএস রুজভেল্ট এবং ইউএসএস বুল্কেলি, ইউএসএস ওয়াস্প এবং ইউএসএস নিউইয়র্কের সঙ্গে ওমান উপসাগরে এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উভচর প্রস্তুত গোষ্ঠীর অংশ ৷ উপরন্তু আমেরিকা পদক্ষেপ নিচ্ছে ইজরায়েলকে সম্ভাব্য ইরানি আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধজাহাজ, অতিরিক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা-সক্ষম ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার, ফাইটার জেট এবং স্থল-ভিত্তিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা অস্ত্র পাঠানোর ।

ভারতের পরিণতি মারাত্মক

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে ভারতেরও গুরুতর পরিণতি হতে পারে ৷ কারণ মধ্যপ্রাচ্য ভারতের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷ এটি ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রধানত সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পারস্য উপসাগরের অন্যান্য আরব রাজ্যগুলির সঙ্গেও সমৃদ্ধ । উত্তেজনা বাড়তে থাকায় এয়ার ইন্ডিয়ার ইজরায়েলের তেল আবিব থেকে 8 অগস্ট পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত করেছে ৷ যার ফলে ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে । এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ভারত নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব লেবানন ছেড়ে দিতে বলে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে ।

মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ফোরক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্ব উদ্বিগ্ন ৷ এই অঞ্চলটি যুদ্ধের দোড়গড়ায় দাঁড়িয়ে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক ফলাফলকে প্রভাবিত করবে । হামাস, হিজবুল্লা এবং বিশেষ করে ইরানের ভূখণ্ডে ঢুকে ইজরায়েলের হামলা বড় ধাক্কা খেয়েছে, তা পরবর্তীতে সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে ।

ওই দেশগুলি একটি পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধের মাধ্যমে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার বা রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং গোপন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং কার্যকর উপায়ের জন্য একটি ব্যাপক মূল্যায়ন পরিচালনা করছে । যদি ইরান এবং তার প্রতিরোধের অক্ষকে একতিত্র হয় এবং ইজরায়েল ও আমেরিকা একসঙ্গে হয় তবে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা শীঘ্রই বাস্তবে পরিণত হবে ।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একজন আমেরিকান শিক্ষাবিদ ওয়াল্টার রাসেল মিড মনে করেন, বৈরুত এবং তেহরানে ইজরায়েলের হামলা ইরান এবং হিজবুল্লাকে ইজরায়েলের ক্ষমতার পরিবর্তে যুদ্ধের পরিবর্তে প্রতিশোধ নেওয়ার বিকল্পগুলি বিবেচনা করতে বাধা দিতে পারে । তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেদিকে তাকিয়ে বিশ্ব ৷

(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)

হায়দরাবাদ, 5 অগস্ট: ইজরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটসে গত 27 জুলাই রকেট হামলা চালিয়েছিল হিজবুল্লা ৷ এই হামলায় নিহত হয় 12 শিশু ৷ সেই হামলার পরে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বেইরুটের দক্ষিণ শহরতলিতে হিজবুল্লার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে টার্গেট করে ইজরায়েল ৷ যিনি গাজা যুদ্ধের সমান্তরালে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে পালটা আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন ৷ পাশাপাশি 30 জুলাই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার উপরও ইজরায়েলের তরফে হামলা চালানো হয় ৷ ইরানে নিজের বাসভবনে মৃত্যু হয় এই হামাস নেতার ৷ ইরানের প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান দিতে এসেছিলেন তিনি ।

ইরান ও প্যালেস্তাইন, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে প্রতিরোধে নেমেছে ইজরায়েল ৷ এরই মাঝে গুরুতর আঘাত হিসাবে ইজরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা আল-আকসা ফ্লাড অপারেশনের পরিকল্পনাকারী (7 অক্টোবর হামলা) হামাসের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার মহম্মদ দেইফকে হত্যা করেছে ৷ 13 জুলাই বিমান হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে ।

ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে শত্রুতা

জঙ্গিগোষ্ঠীর শীর্ষনেতাদের টার্গেট করে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পর ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে 40 বছরের পুরনো শত্রুতা এবং এর প্রতিরোধ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে । সম্প্রতি নেতা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু হামাসকে কীভাবে প্রভাবিত করবে? ইরান এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী কী ইজরায়েলের উপর হামলার প্রতিশোধ নিতে চলেছে? ইজরায়েল এবং আমেরিকা ভবিষ্যতে হুমকির জবাব দেওয়ার জন্য কীভাবে তৈরি হচ্ছে, এসব প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে, যা বিশ্বকে ব্যথিত করছে ।

2017 সালে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর চেয়ারম্যান হন হানিয়া ৷ এরপর থেকে তিনি একজন কৌশলগত পরিকল্পনাকারী, আঞ্চলিকভাবে ও বিশ্বব্যাপী হামাসের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে নেভিগেট করার ক্ষেত্রে একজন প্রধান নেতা হয়ে উঠেছিলেন ৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তিনি 7 অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালানোর পর তুরস্ক, চিন ও রাশিয়ার কাছে পৌঁছনোর মাধ্যমে হামাসের জন্য সমর্থন পেতে সফল হয়েছিলেন ৷ হামাসের হাতে বন্দি ইজরায়েলিদের মুক্তির জন্য আলোচনায়ও তিনি যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন ।

তবে তাঁর মৃত্যু গাজা এবং মধ্যপ্রাচ্য উভয় ক্ষেত্রেই হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা । প্রকৃতপক্ষে হানিয়া হত্যা হামাসের আদর্শিক বা অপারেশনাল সক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করার কথা নয়, কিন্তু এর ফলে হামাসের কার্যকলাপে ক্ষণস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে । দলের নেতৃত্ব 2004 সালে হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ইয়াসিন এবং আবদেল আজিজ-আল-রান্টিসিকে হত্যা দেখেছে ৷ কিন্তু তাও হামাসকে নির্মূল করা যায়নি ৷ বরং পরিবর্তে দলটি আরও শক্তিশালী হয়েছে । আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদরা মনে করছেন, হানিয়ার মৃত্যু হলেও ইয়ানিয়া সিনওয়ারের নেতৃত্বে হামাস তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে ৷ সিনওয়ার হামাসকে সম্পূর্ণরূপে 24 ব্যাটালিয়নে যোদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিলেন, যা 7 অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ।

ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ পছন্দ

এর আগেও ইরান সরাসরি যুদ্ধ লিপ্ত হতে চায়নি ৷ বরং প্রতিরোধের ভাবনা থেকে প্রক্সি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে পছন্দ করে ৷ তবে তার ভূখণ্ড ঢুকে হানিয়াকে হত্যা করা হল, যা ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পক্ষে লজ্জাজনক ! পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ড পরবর্তীতে ইরানি এবং আরব বিশ্বের জনগণকে বোঝাতে কঠোর জবাবের প্রত্যাশা করে । তবে এখনই সরাসরি ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না ইরান বলেই মনে হচ্ছে ৷ যদি অদূর ভবিষ্যতে ইরান সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয় তাহলে সংঘর্ষটি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হবে ।

ইরান ইতিমধ্যেই তার 'এরানাস ইউনিটি' কৌশলের মাধ্যমে ইজরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ৷ এই কৌশলে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সদস্যদের অক্ষ দ্বারা যৌথ সামরিক অভিযান জড়িত । ইরান যদি তার প্রক্সিদের দ্বারা ইজরায়েলের উপর একযোগে বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সম্ভবত ব্যাপারটি খুব ধ্বংসাত্মক হবে এবং যুদ্ধে আমেরিকাকে ইজরায়েলের পক্ষ নিতে বাধ্য করবে, যা ইজরায়েল চায় ।

এছাড়া ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর ইরানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে ৷ কারণ মার্কিন ডলারের থেকে ইরানের রিয়ালের দাম হ্রাস পেয়েছে । ফলস্বরূপ যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা ইরানের স্বার্থে নয়, তবে ইরানের কৌশলটি পুরো মাত্রার যুদ্ধের পরিবর্তে হতে পারে ৷ এটি আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া এড়াতে আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে সংঘাত চালিয়ে যেতে চায় ।

ইরান এবং তার সমর্থিত প্রতিরোধের অক্ষ যার মধ্যে রয়েছে হামাস, লেবাননের হিজবুল্লা, ইয়েমেনের হুথি, কাতাইব হিজবুল্লাহ, ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ, ইরাকের শিয়াদের 47তম পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট ব্রিগেড (পিএমইউ) এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সিরিয়া হামাসের দ্বারা ইজরায়েলের ওতেফ আজা অঞ্চলে বসতি এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলার মতো অন্যান্য বিকল্পগুলি বেছে নিতে পারে ৷ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আল-তানফ, আল-রুকবান এবং আল-মালিকিয়া পূর্ব সিরিয়ার ইরাকের সীমান্তের কাছে ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ দ্বারা গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা ইসরায়েলের বসতি ।

হিজবুল্লা ইজরায়েলে হামলা চালাতে পারে

কাতাইব হিজবুল্লা চলতি বছরের 31 জুলাই বৈরুতে তার হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইজরায়েলকেও পরবর্তীতে আক্রমণ করতে পারে । ইজরায়েলের টার্গেট হত্যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ জুড়ে ইজরায়েল-বিরোধী অভিযানকে উদ্দীপিত করেছে এবং সেইসঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীর নিয়োগ প্রচেষ্টাকে বাড়িয়েছে । জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি কূটনৈতিক মিশন, ইহুদি প্রবাসী এবং আমেরিকান নাগরিকদের আক্রমণ করে যে কোনও জায়গায় ইজরায়েল এবং আমেরিকান স্বার্থের বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়িয়ে তুলতে পারে ।

ইজরায়েলের নিলি ইউনিট (ইসরায়েলের অনন্তকাল মিথ্যা নয়) 7 অক্টোবরের হামলায় ভূমিকা পালনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্মূল করার জন্য তাদের খোঁজ করছে । 2023 সালের ডিসেম্বরে ইরানের শীর্ষ কমান্ডার রেজা মুসাভি এবং 2024 সালের জানুয়ারিতে হামাস নম্বর 2 সালেহ আল-আরুরি ও এখন হানিয়া হত্যা, এর মাধ্যমে ইজরায়েল হামাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং অন্যান্যদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে ৷ এই বার্তি হল যে, তাঁরা কোন জায়গাতেই নিরাপদ নেই ৷

সমসাময়িক প্রতিশোধের ভাবনা থেকে ইজরায়েলের বিমানবাহিনীর প্রধান টোমার বার সতর্ক করেছিলেন যে,দেশের নাগরিকদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে এমন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ইজরায়েল ৷ পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেছেন, ইজরায়েল তার আকাশ পথে প্রতিরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের সঙ্গে তাদের মিশনটি সম্পন্ন করার জন্য সর্বোত্তম শক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে ।

ইজরায়েলকে আশ্বাস হোয়াইট হাউসের

ইতিমধ্যে হোয়াইট হাউস ইরান এবং তার প্রক্সি গোষ্ঠীর সমস্ত হুমকির বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে । এর জন্য আমেরিকার দুটি নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার প্রস্তুত রয়েছে ৷ পাশাপাশি ইউএসএস রুজভেল্ট এবং ইউএসএস বুল্কেলি, ইউএসএস ওয়াস্প এবং ইউএসএস নিউইয়র্কের সঙ্গে ওমান উপসাগরে এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উভচর প্রস্তুত গোষ্ঠীর অংশ ৷ উপরন্তু আমেরিকা পদক্ষেপ নিচ্ছে ইজরায়েলকে সম্ভাব্য ইরানি আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধজাহাজ, অতিরিক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা-সক্ষম ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার, ফাইটার জেট এবং স্থল-ভিত্তিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা অস্ত্র পাঠানোর ।

ভারতের পরিণতি মারাত্মক

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে ভারতেরও গুরুতর পরিণতি হতে পারে ৷ কারণ মধ্যপ্রাচ্য ভারতের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷ এটি ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রধানত সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পারস্য উপসাগরের অন্যান্য আরব রাজ্যগুলির সঙ্গেও সমৃদ্ধ । উত্তেজনা বাড়তে থাকায় এয়ার ইন্ডিয়ার ইজরায়েলের তেল আবিব থেকে 8 অগস্ট পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত করেছে ৷ যার ফলে ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে । এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ভারত নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব লেবানন ছেড়ে দিতে বলে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে ।

মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ফোরক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্ব উদ্বিগ্ন ৷ এই অঞ্চলটি যুদ্ধের দোড়গড়ায় দাঁড়িয়ে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক ফলাফলকে প্রভাবিত করবে । হামাস, হিজবুল্লা এবং বিশেষ করে ইরানের ভূখণ্ডে ঢুকে ইজরায়েলের হামলা বড় ধাক্কা খেয়েছে, তা পরবর্তীতে সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে ।

ওই দেশগুলি একটি পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধের মাধ্যমে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার বা রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং গোপন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং কার্যকর উপায়ের জন্য একটি ব্যাপক মূল্যায়ন পরিচালনা করছে । যদি ইরান এবং তার প্রতিরোধের অক্ষকে একতিত্র হয় এবং ইজরায়েল ও আমেরিকা একসঙ্গে হয় তবে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা শীঘ্রই বাস্তবে পরিণত হবে ।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একজন আমেরিকান শিক্ষাবিদ ওয়াল্টার রাসেল মিড মনে করেন, বৈরুত এবং তেহরানে ইজরায়েলের হামলা ইরান এবং হিজবুল্লাকে ইজরায়েলের ক্ষমতার পরিবর্তে যুদ্ধের পরিবর্তে প্রতিশোধ নেওয়ার বিকল্পগুলি বিবেচনা করতে বাধা দিতে পারে । তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেদিকে তাকিয়ে বিশ্ব ৷

(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.